এক আত্মপ্রত্যয়ী নারী-নুরুননাহার ফয়জননেসা by লতিফা আকন্দ

নুরুননাহার ফয়জননেসা এখন নেই, কোথাও নেই। তাঁর আত্মা অমরত্ব পেয়েছে নীল গগনে নীহারিকা হয়ে। তিনি এখন স্মৃতিতে ঠাঁই পেয়েছেন। কত কথা আমরা ভুলে যাই, হারিয়ে ফেলি কত স্মৃতি। তারই মাঝে কিছু কিছু স্থায়িত্ব পায় আমাদের চেতনায়। এই নিজের চেতনা, নিজ নিজ উপলব্ধিনির্ভর এবং একটি সরলরেখায় গ্রন্থিত করা যায় না।

সেদিন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে তাঁর স্মরণে মিলিত হয়েছিলাম ১ নম্বর নিউ বেইলি রোডে। অধ্যাপক নওশাবা শুরুতে বললেন, ‘নাহার আপাকে এখন পাস্ট টেন্সে সম্বোধন করছি। কদিন আগেই তিনি বর্তমানে ছিলেন, নিমেষে অতীতের গর্ভে চলে গেলেন।’ রোকেয়া হলের একজন হাউস টিউটর কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘আমরা কাউকে না-বলা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো তাঁকেই বলতাম। তিনি সমাধানের ক্ষেত্রে আমার জীবনে অনন্য অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন প্রবল আত্মবিশ্বাসী ও উদারমনা। উদার মানবিক গুণ যাঁর, তিনিই অপরের দুঃখের সমস্যার সমাধান খোঁজেন তাঁর অন্তরঙ্গ আলোকে।’
এগুলো তাঁর প্রচারের বিষয় ছিল না। তাই তাঁর প্রয়াণের পর কেউ কেউ ছুটে এসে কিছু বলে ঋণ শোধ করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন—আত্মীয়, অনাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, কাছের ও দূরের—সবারই আছে কম-বেশি এসব স্মৃতি আছে। আমারও কত স্মৃতি—নাহারের সেই হাসিভরা মুখ। হাসি তাঁর বৈশিষ্ট্য। সম্বোধনে, অভ্যর্থনায় আন্তরিকতা ফুটে উঠত তার হাসিমাখা মুখে। নানা প্রতিকূলতা ও সমস্যার মধ্যেও তার প্রকাশ ছিল শান্ত, পরিচ্ছন্ন। বড় উদাহরণ দুই দফায় রোকেয়া হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন। এ যেন সব বাধাবিপত্তি দুই হাতে সরিয়ে সাঁতরে নিজেকে প্রবহমান রাখা এবং সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নিজেকে জয়ী করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। অত্যন্ত ব্যস্ত জীবনেও তাঁর ক্লান্তির পরিচয় পাওয়া যায়নি। চ্যালেঞ্জ নিতে ও ভালোবাসতে তার সৃজনী শক্তির দৃষ্টান্ত অনেক। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবাযত্ন কেন্দ্র ‘ছায়ানীড়’; শহীদ স্মৃতি বেদি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ স্মৃতিফলক, রোকেয়া হল এবং সর্বোপরি ওই হলে রোকেয়ার স্মৃতি আগামী প্রজন্মের কাছে ধরে রাখার প্রতিষ্ঠান ‘বেগম রোকেয়া ফাউন্ডেশন’।
আমরা অনেকে অনেক কিছু ভাবি, কিন্তু ভাবনা বাস্তবায়ন করতে পারেন কজন? যাঁরা পারেন, তাঁরাই ধন্য। সেদিন রোকেয়া হলে রোকেয়া দিবসে উৎসবমুখর বড় হলটায় তাঁকে সম্মানে ভূষিত করা হলো। পাঠ করা হলো তাঁর শুভেচ্ছাবাণী, তখন কিন্তু নাহার মৃত্যুর মুখোমুখি, অন্য কারও জন্য স্বহস্তে লিখে বাণী পাঠানো ওই রোগ যন্ত্রণাদগ্ধ অবস্থায় আমার অসম্ভব মনে হয়। তবু এ রকমের সাহসের পরিচয় জীবনভর দিয়ে গেছেন। ওপার থেকে শিকড় বিচ্ছিন্ন (ভারত থেকে) হয়ে এসে এই বাংলাদেশকে মাতৃভূমির বিকল্প সবাইকে নিয়ে নতুন একটা দেশ গড়ার কাজে অবদান রাখা এ আত্মপ্রত্যয় অনুকরণীয়। যেমন স্বচ্ছন্দে স্বামীর অঞ্চল বরিশালের গ্রামের আত্মীয়স্বজন ও দূরসম্পর্কীয়কে আপন করে গ্রহণ করা, তাদের জীবনে অভিভাবক হয়ে প্রতিষ্ঠিত করা সহজসাধ্য নয়।
‘উইমেন ফর উইমেন’-এ আমরা সবাই সদস্য। নাহার, যাঁকে তাঁর বন্ধুরা ‘নুরন আপা’ বলত, সবাই তাঁর মতামতের খুব দাম দিত। একটা প্রতিষ্ঠানকে বোঝা, তার প্রতিবন্ধকতা সহজে হূদয়ঙ্গম করতে পারা এবং তার সঠিক পরিচালনা করার যে দূরদৃষ্টি থাকতে হয়, তা তাঁর ছিল। তাঁর বিস্তার ছিল নানা সমাজ-উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে। মহিলা পরিষদে তাঁর স্থান শীর্ষে ছিল। আমাদের সাখাওয়াত মেমোরিয়াল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন তাঁরই ভাবনাপ্রসূত এবং তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। নাহার অনেক চিন্তারও ধারক ও বাহক ছিলেন। তাঁর ধৈর্য ছিল অপরিসীম। কোনো দিন তাঁকে উত্তেজিত হতে দেখিনি। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি ছিল অসাধারণ।
তাঁর কর্মস্থল ও আমার কর্মস্থলের দালানকোঠাগুলো আলাদা ছিল। তাই দেখা-সাক্ষাৎ হতো না হলের অনুষ্ঠান বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া। রোকেয়া হলের বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানে তাঁকে পুরস্কার নিতে দেখেছি। রেডিও পাকিস্তান, পরে রেডিও বাংলাদেশে তাঁর শিশু-কিশোরদের অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’ সুদক্ষ পরিচালনার প্রশংসা আজও সবার মুখে মুখে। তিনি রান্নায় পারদর্শী ছিলেন এবং খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসতেন। তাঁর বাড়ির পরিপাটি সুন্দর পরিবেশ আমাদের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দিত। হাত বাড়ালেই সব পাচ্ছি, সব ইতিবাচক। তাঁর যা মনে হতো, অকপটে প্রকাশ করা তাঁর ধরন ছিল। কথার পেছনে তাঁর যুক্তি তাৎক্ষণিকভাবে খাড়া থাকত। তিনি মমতাময়ী মা, কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী এবং স্বপেশায় আন্তরিকভাবে নিবেদিত ছিলেন। আরেকটি দিক, তাঁর ধর্মের অনুশীলন।
মৃত্যুর মাস কয়েক আগে আমরা সাখাওয়াত সাবেকিরা দীপশিখা স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে মিলিত হই। দীপশিখা স্কুলের নাম রোকেয়া স্কুল রাখা হয়। আমরা তাদের অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম। একেবারে শেষে অনুষ্ঠানসূচির বাইরে নাহার আমাদের ছাত্রছাত্রীসহ দোয়া-দরুদ পাঠ করতে বললেন। যত দিন বিন্দুমাত্র ক্ষমতা ছিল, তিনি দ্বিধাহীন ব্যবহার করে গেছেন অসুখটাকে উপেক্ষা করে। আমি জানি, কেউ তাঁর কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী অবস্থায় বিলাপ-অভিযোগ শোনেননি। যত দিন পেরেছেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নামাজ-কলমা পড়ে গেছেন, একেবারে অন্তিম মুহূর্তেও (মেয়ের মুখে শুনেছি)।
অসম্ভব সহনশীল, ধৈর্যের প্রতীক এই নারীকে যতটুকু জেনেছি, ততটুকু গুছিয়ে অন্যকে জানানোর অপারগতায় ক্ষমাপ্রার্থী আমি তাঁর লতিফা আপা (তাঁর বেশ কয়েক বছরের বড়)।
লতিফা আকন্দ: শিক্ষাবিদ।

No comments

Powered by Blogger.