ইউক্রেন: ঠান্ডা লড়াই, গরম লড়াই by হাসান ফেরদৌস

প্রায় ৪০ বছর আগের ঘটনা, কিন্তু দিন-তারিখ স্পষ্ট মনে আছে। ৬ মে। আমি তখন কিয়েভে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তার নাম ছিল ইউক্রেনের জাতীয় কবি তারাস শেভচেনকোর নামানুসারে। রুশ জারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিলেন শেভচেনকো। তাই তাঁকে কারাবন্দী করা হয়, নিষিদ্ধ করা হয় তাঁর গ্রন্থ। শেভচেনকো মারা যান ১৮৬১ সালের ১০ মার্চ। জারের নির্দেশ ছিল, মৃত্যুর পরেও তাঁর মরদেহ ইউক্রেনে নেওয়া চলবে না। অনেক দেনদরবারের পর শেভচেনকোর মরদেহ ইউক্রেনে নেওয়া হয় ৬ মে। তাই দিনটি জাতীয়তাবাদী ইউক্রেনিদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সোভিয়েত আমলে শেভচেনকো সম্মানিত হয়েছিলেন, রাষ্ট্রীয় খরচে ইউক্রেনের নানা শহরে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের চোখে তিনি ছিলেন রুশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছিল শেভচেনকোর বিশাল এক মর্মর মূর্তি। অলিখিত নির্দেশ ছিল, অন্য সময় বাধা না থাকলেও ৬ মে তাঁর মূর্তির পাদদেশে কোনো পুষ্পস্তবক রাখা যাবে না। ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ যাতে মাথাচাড়া না দিতে পারে, সরকারি নির্দেশের সেটাই ছিল লক্ষ্য। পরদিন জানা গেল, আমাদের ক্লাস-ক্যাপ্টেন
ইগর তারাশেনকোকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ছেলেটি অতি প্রত্যুষে শেভচেনকোর মূর্তির পাদদেশে একগুচ্ছ লাল টিউলিপ রেখে এসেছিল। সে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে পারেনি।
সেই কিয়েভ এখন রুশবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। পশ্চিমের অধিকাংশ রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মত, পুতিন যেভাবে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তা নগ্ন আগ্রাসন। কিন্তু ক্রিমিয়ার ব্যাপারটা একদম সাদাকালো নয়। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করুন:
১। ইউক্রেনের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ গণতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি মহা চোর হতে পারেন, পুতিনের কথায় ওঠাবসায় আগ্রহী হতে পারেন, কিন্তু তাঁর নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। পশ্চিমারা ইয়ানুকোভিচের পতনে হাততালি দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া বলছে, বিপ্লব নয়, অস্ত্রের মুখে তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
২। ইউক্রেনের এই বিপ্লবের হোতাদের কেউ কেউ উগ্র জাতীয়তাবাদী। যেমন স্ভাবোদা বা স্বাধীনতা নামের একটি দলের কেউ কেউ খোলামেলাভাবেই ‘ফ্যাসিস্ট’। এর এক নেতা সম্প্রতি ইউক্রেনের সরকারি টেলিভিশন কেন্দ্রে গিয়ে পরিচালককে মারধর করেন। কারণ, কেন্দ্রটি মস্কোর বক্তব্য গুরুত্বসহকারে প্রচার করছিল।
৩। যে ক্রিমিয়া নিয়ে এত কাণ্ড, ৬০ বছর আগেও তা ছিল রাশিয়ার অন্তর্গত। ১৯৫৪ সালে, যখন ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য, সোভিয়েত নেতা নিকিতা খ্রুশ্চভ উপহার হিসেবে অঞ্চলটি ইউক্রেনের নামে লিখে দিয়েছিলেন। একই দেশ, শুধু কাগুজে হাতবদল।
৪। একসময় ক্রিমিয়ার প্রধান জনগোষ্ঠী ছিল তুর্কি বংশোদ্ভূত তাতার। স্তালিনের আমলে তাদের তাড়িয়ে সেখানে ঢোকানো হয় রুশদের। এখন ক্রিমিয়ার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ রুশ, ২৫ শতাংশ ইউক্রেনীয়। তাতার ১১ শতাংশেরও কম। সেখানে সাম্প্রতিক গণভোটে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষে যে ৯০ শতাংশ ভোট পড়ে, সেসব ভোটদাতার অধিকাংশই রুশ।
সন্দেহ নেই, মস্কো ক্রিমিয়ার গণভোটে যথাসম্ভব প্রভাব রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ কথাও সত্য, ভোট যেমনই হোক, ক্রিমিয়ার রুশরা মস্কোর পক্ষেই ভোট দেবেন। শুধু ক্রিমিয়া নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের অনেক রুশপ্রধান এলাকাও রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলাবে। ইউক্রেনের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, জীবনযাত্রার মান নিচু। মস্কো থেকে সস্তা গ্যাস না এলে তাদের রান্নার চুলা ধরানো কঠিন হবে। এ অবস্থায় ক্রিমিয়ার রুশরা মস্কোর সঙ্গে যোগ দিতে চাইবেন—এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর কিয়েভে যারা ক্ষমতা দখল করেছে, তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবভঙ্গি গোটা ইউক্রেনের রুশ জাতিভুক্ত মানুষদের ভালো লাগেনি। এই উগ্র জাতীয়তাবাদীদের প্ররোচনাতেই দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে রুশ ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যদিও দেশের অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষ রুশ ভাষাভাষী।
পুতিনের অবশ্য অন্য অঙ্কও মাথায় ছিল। ক্রিমিয়ায় রয়েছে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নৌবহর। ওদেসা সমুদ্রবন্দর রাশিয়ার অর্থনীতির অন্যতম ধমনি। যেকোনো মূল্যে তা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন পুতিন। ক্রিমিয়া দখল করার নেতিবাচক আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার কথা মস্কো আগেই জানত। তবু মস্কো যে সে কাজটিই করল, তার একটি সম্ভাব্য কারণ পশ্চিমা দেশগুলোকে সে এ কথা বোঝাতে চেয়েছে, পৃথিবীর নেতৃত্বে এখন আর এক আমেরিকা নেই। মস্কোকেও হিসাবে রাখতে হবে।
রাশিয়ায় পুতিনের এই সিদ্ধান্ত প্রবল সমর্থন পাবে, সে হিসাবও তাঁর মাথায় ছিল। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক গভীর, কেবল ভাষা ও সংস্কৃতিগত নয়, ঐতিহাসিকও। রুশ সাম্রাজ্যের শুরু কিয়েভ থেকে, রুশ অর্থোডক্স চার্চের শুরুও কিয়েভ থেকে। ইউক্রেন ছিল গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান শস্যভান্ডার। উভয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে একযোগে। ফলে, এই দুই দেশের মধ্যে একধরনের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে।
তবু কেন ইউক্রেন মস্কোর প্রতি এত বিরূপ? আসলে, ইউক্রেনে রুশবিরোধী জাতীয়তাবাদী প্রবণতা শেভচেনকোর সময়ে যেমন ছিল, তেমনি ছিল সোভিয়েত আমলেও। সোভিয়েত-উত্তর পর্বেও সে বিরোধিতা কমেনি। অবশ্য সে প্রবণতা মুখ্যত ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশভাষী-অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গেই থাকতে চায়।
সব অঙ্ক মাথায় রেখে খুব ভেবেচিন্তেই ক্রিমিয়ার ওপর হাত বসিয়েছেন পুতিন। তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য আমেরিকা ও তার বন্ধুদের একটি বার্তা পৌঁছানো। পরাশক্তি হিসেবে রুশরা একসময় বিশ্বের শ্রদ্ধা পেয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার ফলে সে সম্মান হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সবচেয়ে অপমানজনক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার আশপাশের দেশগুলোতে আমেরিকার সামরিক আস্তানা গড়ে তোলা। প্রতিরক্ষা বর্মের নামে পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র আখড়া নির্মাণ করা হয়েছে। মুখে বলা হয়, ইরানের হুমকি এড়াতে এই ব্যবস্থা, কিন্তু ছেলেভোলানো সে যুক্তি খুব বেশি লোক পাত্তা দেয়নি। মস্কো তো নয়ই। যেভাবে তড়িঘড়ি করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ও ন্যাটোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বিত করা হয়, তাও মস্কো খুব ভালো চোখে দেখেনি।
এ কথা ভাবা একদম ভুল নয় যে কেজিবির সাবেক কর্মকর্তা পুতিন পশ্চিমের এই অপমানের বদলা চান। সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্য থেকে বিশেষত ইউক্রেন, মালদোভা ও বেলারুশ নিয়ে দ্বিতীয় সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়তে চান। পুতিন যদি এমন অবলীলায় অন্য দেশের ভূখণ্ড দখল করতে পারেন, তবে তাঁর খিদে বাড়বে বৈ কমবে না। সেদিক থেকে মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রতিবাদের যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু তাই বলে ক্রিমিয়ার সূত্রে পুরোদস্তুর ঠান্ডা যুদ্ধ বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আমেরিকা ইতিমধ্যে পুতিনের নিকটবান্ধবদের ওপর নানা রকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বাদ দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু রাশিয়াকে বাদ দিয়ে চলতি দুনিয়ার প্রধান কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যেমন, সিরিয়া ও ইরানের ব্যাপারে আলোচনা এগোতে হলে রাশিয়ার সম্মতি চাই। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্ন, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি মূল্য—যে বিষয়ই টেবিলে তোলা হোক, রাশিয়াকে বাদ দিয়ে উপায় নেই।
আমেরিকা খুব ভালো করেই জানে, পুতিনের ওপর চাপ দিয়ে খুব বেশি আদায় করা যাবে না। শুধু ইউক্রেন নয়, পুরো পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। পুতিন চাইলে জার্মানি বা ব্রিটেনের গলায় রক্ত তুলে দিতে পারেন। সে কথা জানা সত্ত্বেও ওবামা যে নানা হম্বিতম্বি করছেন, তার আসল কারণ অভ্যন্তরীণ। এ বছর নভেম্বরে আমেরিকায় মধ্যবর্তী নির্বাচন, তাতে ওবামার দল ডেমোক্রেটিক পার্টির বেধড়ক মার খাওয়ার কথা। ইরান ও সিরিয়ার ব্যাপারে তাঁর আপসমুখী মনোভাবের জন্য এ দেশের দক্ষিণপন্থীদের কাছে তাঁর পরিচয় ‘হাঁটু কাঁপা ওবামা’। পুতিনের এক থাবাতেই তিনি যদি জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানরা নির্বাচনের আগে তাঁকে কিমা বানিয়ে ছাড়বে।
ওবামা কড়া কথা বলে ও লোক দেখানো ব্যবস্থা নিয়ে হয়তো নয়া ঠান্ডা লড়াই শুরু করতে পারবেন, কিন্তু তাতে কমরেড পুতিনের হাঁটুর কাঁপন জাগবে, এমন কথায় বিশ্বাস হয় না।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.