মঞ্জুর হত্যা মামলা

দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে মঞ্জুর হত্যা মামলাটি ঝুলে থাকা আমাদের বিচারব্যবস্থার একটি মন্দ নজির হয়ে আছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি মন্দ নজির হবে যদি এই মামলায় আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে এবং তথ্য-প্রমাণের অভাবে প্রকৃত অপরাধীরা খালাস পেয়ে যান। সেই বিবেচনায় গত বৃহস্পতিবার ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত যে মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন, সেটিকে আমরা ন্যায়সংগত বলেই মনে করি। রাষ্ট্রপক্ষই তদন্তে ত্রুটি আছে, এই যুক্তিতে অধিকতর তদন্তের আবেদন জানিয়েছিল। আদালত আগামী ২২ এপ্রিল প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সংঘটিত সেনা-অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এম এ মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার সেনা আইনে সেনা বিদ্রোহের বিচার করলেও জিয়া ও মঞ্জুর হত্যার বিচার করেনি। ১৯৯৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিহত এম এ মঞ্জুরের ভাই আইনজীবী আবুল মনসুর আহমেদ মঞ্জুর হত্যার বিচার চেয়ে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা করেন। ওই বছরের ২৭ জুন এরশাদসহ পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। গত ১০ ফেব্রুয়ারি মামলাটির রায় দেওয়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল।
কিন্তু ২৯ জানুয়ারি আদালতের বিচারক পরিবর্তন করায় নতুন বিচারক ওই তারিখে রায় না দিয়ে নতুন যুক্তিতর্ক পেশ করার তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। ইতিমধ্যে মার্কিন সাংবাদিক ও গবেষক লরেন্স লিফশুলৎজ প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকায় ১৯৮১ সালের সেনা-অভ্যুত্থান ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে পাঁচ কিস্তিতে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখেন, যিনি পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ৭ নভেম্বরের সেনা-অভ্যুত্থান নিয়ে লিখেছিলেন বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভল্যুশন নামে একটি সত্যানুসন্ধানী বই। লিফশুলৎজের প্রতিবেদনে এমন কিছু তথ্য আছে, যা আগে প্রকাশিত হয়নি, এমনকি সিআইডির তদন্তেও অনুদ্ঘাটিত থেকে গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় আদালতের নির্দেশনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বিবাদীপক্ষের বিরোধিতা অযৌক্তিক বলেই মনে করি। কেননা, যেকোনো মামলার ন্যায়বিচারের জন্য উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ থাকা জরুরি। অসম্পূর্ণ তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা পরিচালিত হলে প্রকৃত অপরাধী যেমন খালাস পেয়ে যেতে পারেন, তেমনি নির্দোষ ব্যক্তির ওপরও শাস্তির খড়্গ নেমে আসতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যত বিলম্বই হোক না কেন এম এ মঞ্জুর হত্যার অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন না করলে একদিন ইতিহাসের কাছে আমাদের দায়বদ্ধ হতে হবে। এম এ মঞ্জুরের স্বজনদের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তিনি যদি অপরাধ করেও থাকেন, আদালতের মাধ্যমেই তাঁর সাজা হতে পারত। কিন্তু সেটি হয়নি বলেই এই হত্যারহস্যের উন্মোচন এবং অপরাধীদের শাস্তি জরুরি।

No comments

Powered by Blogger.