মুক্তির সংগ্রাম শুরু হোক

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর সেই অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় আমাদের সংগ্রামের রূপরেখাটি ঘোষণা করেছিলেন—তিনি বলেছিলেন, সংগ্রামটি স্বাধীনতার এবং মুক্তির। ওই বক্তৃতার প্রতিটি কথা তিনি প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, একটা প্রতিজ্ঞাও ছিল প্রতিটি ঘোষণার পেছনে, প্রজ্ঞা তো ছিলই। এই প্রজ্ঞার প্রতিফলন ছিল তাঁর স্বাধীনতা ও মুক্তিকে আলাদা করে দেখায়। স্বাধীনতা হচ্ছে প্রধানত বস্তুগত, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত। ভৌগোলিক স্বাধীনতা হয়, যা নয় মাস যুদ্ধ করে আমরা অর্জন করেছি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও হয়, যা কিছু মানুষ অর্জন করেছে। কিন্তু মুক্তি অনেক ব্যাপক বিষয়। উত্তর উপনিবেশী তত্ত্ববাদী ও সক্রিয় যোদ্ধা ফ্রানৎস ফাঁনো লিখেছিলেন, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক মুক্তি যতটা সহজ, মনের উপনিবেশ মুক্তি ততটা নয়। একাত্তরে আমাদের যে মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তা প্রকৃতই একটি কঠিন সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমরা তিন পা এগোলে দুই পা পেছাই, কারণ, আমাদের শিক্ষাকে তার বাহন করতে পারিনি, সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি, শ্রেয়চিন্তাকে তলিয়ে দিতে দিয়েছি বস্তু-মোহের আড়ালে। পড়ার ও চিন্তার সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে লোভের সংস্কৃতির কাছে।
দেশের একটা বিশালসংখ্যক মানুষকে পড়ার সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ত করা তো দূরের কথা, অক্ষরজ্ঞানই তো আমরা দিতে পারিনি। এক বিশালসংখ্যক মানুষকে এখনো দারিদ্র্য-চক্র থেকে তুলে আনতে পারিনি। এসবের ফলে মুক্তির মূলমন্ত্রটি সবার কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। একটি পতাকা পেয়ে আমরা সবাই গর্বিত—আমরা যে স্বাধীন এ কথা ওই পতাকাটি আমাদের জানিয়ে দেয়। কিন্তু মুক্তি যে প্রয়োজন—মনের মুক্তির, বুদ্ধির মুক্তির, বিবেকের মুক্তির, যা ছাড়া স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদটি পাওয়া হয় না—তা বুঝতে আমরা ক্রমাগত অপারগ হচ্ছি। অসংখ্য শহীদের রক্তঝরা এই মার্চে কিছু বাঙালি তরুণ পাকিস্তানি পতাকা হাতে মাঠে গিয়ে ওই দেশের ক্রিকেট দলের জন্য চিৎকার করেছে, ওরা হেরে গেলে অশ্রুপাত করেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। খেলাধুলায় একটা বিদেশি দলকে সমর্থন করাই যায়, কিন্তু এই সমর্থন কত দূর নেওয়া যায়? এই মার্চে একেবারে পাকিস্তানের পতাকা হাতেই বিশ্বস্ততা দেখাতে হবে? খেলাধুলা তো সংস্কৃতিরই একটি অংশ। সেই সংস্কৃতি যেখানে সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের গর্বের আর বিজয়ের গল্পে, সেখানে এ কোন ছবি আমরা দেখছি? এই তরুণদের ঘৃণা জানাচ্ছে অন্য তরুণেরা, কিন্তু কেন তারা এ ধরনের ঘটনাকে স্বাভাবিক মনে করছে, কেন মার্চের ইতিহাস তাদের ভেতর কোনো অহংকার জাগাচ্ছে না, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? ভেবে দেখলে আমরা অভিযোগের একটা আঙুল নিজেদের দিকেই তুলতাম। এই ৪৩ বছরে চিরমুক্তির আর বিবেক জাগানোর কাজটা কি আমরা করেছি অভিনিবেশ নিয়ে? নাকি একাত্তরকে আমরা ক্রমাগত দূরে ঠেলে দিচ্ছি জাগতিক চিন্তার প্রাবল্যে? রাজনৈতিক হানাহানি সব দেশেই অল্পবিস্তর থাকে, কিন্তু এ দেশে তা আমাদের ইতিহাস ধরে টান দেয়।
একটি দল সবটাই দখলে নিতে চাইলে আরেকটি দল আরও এক ধাপ এগিয়ে একাত্তরের ইতিহাসটাকেই নিজেদের মতো করে লিখে নিতে চায়, যেখানে বঙ্গবন্ধু নেই, তাজউদ্দীন নেই, দেশের মুক্তিকামী কেউ নেই, আছেন তাদের কিছু কুশীলব। এই মনগড়া ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধীরাও ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে যায়। আর ইতিহাস যা ভোলায়, ইতিহাসের অহংকার যা ভোলায়, তা হচ্ছে ভ্রষ্টাচার। দুর্নীতি হচ্ছে অনেক ভ্রষ্টাচারের একটি মাত্র। বাংলাদেশের সর্বত্র এখন ভ্রষ্টাচারের জয়। তবে না, সব হারিয়ে যায়নি, কারণ একাত্তর কখনো হারানোর বস্তু নয়। একাত্তর এমনি এক অস্তিত্ব, যা প্রাণের মতো জেগে থাকে। তাকে কিছুদিন চাপা দেওয়া যায়, আড়াল করা যায়, হয়তো ভুলে থাকা যায়, কিন্তু একটুখানি ফিরে গেলে একাত্তর আবার হাত বাড়িয়ে টেনে নেয়, মানুষকে জাগাতে থাকে। এই জাগরণ দেখছি কয়েক বছর ধরে। আজ যে সমবেত কণ্ঠে কয়েক লাখ মানুষ জাতীয় সংগীত গাইবে, তা এই জাগরণের একটা লক্ষণ মাত্র। আসল জাগরণটা হচ্ছে মানুষের চিন্তার। তার প্রকাশ ঘটতে কিছুটা সময় লাগবে হয়তো, কিন্তু তা বাংলাদেশকে দূরের বন্দরে ঠিকই পৌঁছে দেবে। একাত্তরে সবাই এক হয়েছিল বলে আমরা অসাধ্য সাধন করেছিলাম। আজও যখন একটা জায়গায় সবাই দাঁড়াব, হূদয়ে দুলবে লাল-সবুজ পতাকা, বাজবে ‘আমার সোনার বাংলা’, তখন কোনো বাধাই আর আমাদের আটকাতে পারবে না। ৫০তম স্বাধীনতাবার্ষিকী যেদিন আমরা উদ্যাপন করব, সেদিন হয়তো দেখব, বন্দরটা খুব কাছেই। কারণ, সবাই একটা জাহাজে উঠে একই উদ্দেশে যাত্রা করছে।
দুই শুরুটা করতে হবে শিক্ষা দিয়ে। সেই শিক্ষা, যা জীবনঘনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমনস্ক এবং ভবিষ্যৎমুখী। তারপর শুরু করতে হবে মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা। একটি শিক্ষিত এবং আত্মপ্রত্যয়ী জাতি মূল্যবোধের চর্চা যত নিষ্ঠা নিয়ে করতে পারে, শিক্ষাবঞ্চিত জাতি তা পারে না। তারপর বদলাতে হবে কুসংস্কার, বেরিয়ে আসতে হবে লোভের সংস্কৃতি থেকে এবং ভাবতে হবে, দেশটা আমাদের অনেক দিয়েছে, এখন দেশটাকে দেওয়ার সময় এসেছে। এবং এই দেওয়াটা নিঃস্বার্থ হলে দেশও দেবে দুই হাত উজাড় করে, যেমন মাটি দেয় কৃষকদের। আর ফিরতে হবে একাত্তরে, শহীদদের স্বপ্নের কাছে। ওই স্বপ্ন যেদিন সবার স্বপ্নে রূপ নেবে, সেদিন মুক্তি আসবে বাংলাদেশের।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.