বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতেই কি কাঁদবে? by ফরহাদ মজহার

বিচারকরা সমাজের বাইরের কেউ নন, সমাজের ঊর্ধ্বেও নন। সমাজের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণ সমাজের আর দশজনের মতো তাদেরও স্পর্শ করে। এই সীমাবদ্ধতা জেনেও কাকে ‘বিচার’ বলা যায় আর কাকে ‘বিচার’ বলা যায় না সে ব্যাপারে বিচারশাস্ত্রের আইনি ও ব্যবহারিক দিক থেকে কিছু ‘মানদণ্ড’ ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে, যাকে আজকাল ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড’ বলা হয়। ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা কথাটার তাৎপর্য বোঝা দরকার। এই অর্থেই বিচারের মানদণ্ড ঐতিহাসিক যে কাকে ‘বিচার’ বলা হবে আর কাকে বিচার বলা হবে না- সেটা কেউ ওয়াশিংটনে, জেনেভায় বা ইংল্যান্ডে বসে নির্ধারণ করে দেয়নি। বিচারের এই মানদণ্ড যুগে যুগে দেশে দেশে মানবেতিহাসকে লড়ে অর্জন করতে হয়েছে। এই মানদণ্ড অর্জনের জন্য বিচারের প্রত্যাশী মানুষকে বহু রক্তপাত ও বহু জুলুম সহ্য করতে হয়েছে, অকাতরে বহু প্রাণের বিসর্জনও ঘটেছে। এই লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস নাগরিক ও মানবিক অধিকার অর্জনের ইতিহাস বলেও পরিচিত। আর অন্যান্য অধিকারের মতো ‘বিচার’ পাওয়ার নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ওপরই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। আর ইউরোপে সেটা কায়েম হয়েছে জনগণের বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
এই ঐতিহাসিক মানদণ্ডকে ‘আন্তর্জাতিক’ বললে কিছু জটিলতা তৈরি হয়, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড’ কথাটা সঙ্গত কারণেই পর্যালোচনার দাবি রাখে। ঔপনিবেশিক কালপর্বে আন্তর্জাতিকতার মানদণ্ড মানে ঔপনিবেশিক মানদণ্ড। সেদিক থেকে সাম্রাজ্যবাদী যুগে তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র থাকার কথা। সেটা আছেও। মানবাধিকার লংঘনের অজুহাতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো দুর্বল দেশের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পিছপা হয় না, সেটা আমরা দেখেছি। প্রতিটি রাষ্ট্রই সার্বভৌম এবং কোনো রাষ্ট্রেরই অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের অধিকার নেই- এই নীতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কার্যকারিতা অনেক আগেই হারিয়েছে। ফলে দুর্বল দেশের ওপর সবল দেশের আধিপত্য বিস্তার এখন কোনো অন্যায় বলে গৃহীত হয় না। শুধু এই অভিযোগ তোলাই যথেষ্ট, সেই দেশ কোনো না কোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড লংঘন করেছে। সেটা মানবাধিকার হতে পারে, হতে পারে পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা রাসায়নিক অস্ত্র রাখা, বানানো বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে গৃহীত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। এ ধরনের কোনো না কোনো মানদণ্ড লংঘন করলে কোনো স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সরকারকে সরাসরি বাইরে থেকে পরিচালিত সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে বদলানোর কথা (ৎবমরসব পযধহমব) আজকাল অনায়াসেই বলা হয়। ফলে ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড’ কথাটার প্রতি সন্দেহ থাকা খারাপ কিছু না।
সে কারণে আন্তর্জাতিক ও ঐতিহাসিক এ দুটো কথার পার্থক্য সম্পর্কে সজাগ থাকা জরুরি। একটি দেশের জনগোষ্ঠীকে অনেক সময় তথাকথিত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিরুদ্ধে অবশ্যই দাঁড়াতে হতে পারে, কিন্তু মানুষের ইতিহাস যেসব নীতি, আদর্শ ও মানদণ্ড লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন ও প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাকে অস্বীকার করার সুযোগ খুবই কম। যেমন, ব্যক্তির অধিকার। এ যুগে দাস ব্যবস্থা কায়েম করা বা কোনো মানুষের সঙ্গে দাসের মতো আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঠিক তেমনি কারও নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করাও মেনে নেয়া যায় না। একজন ব্যক্তি ভয়াবহ খুনি হতে পারে, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করেছে বলে কেউ অভিযোগ আনতে পারে। হয়তো আসলেই সে করেছে। কিন্তু সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে তার অপরাধ প্রমাণ না করা পর্যন্ত তাকে কোনো বিচার ব্যবস্থাই শাস্তি দিতে পারে না, এটা ব্যক্তির অধিকার। কোনো বিচার ব্যবস্থা যদি ব্যক্তির এ অধিকার অস্বীকার করে, কিংবা এমন একটা আদালত গঠন করে যেখানে তার বিধিবিধান ও কাঠামোর মধ্যেই এ অধিকার লংঘনের সমূহ বিপদ নিহিত রয়েছে, তখন তাকে আদৌ বিচার বলা যাবে কিনা, বিচারশাস্ত্র এ অভিযোগ তুলবেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মহলে যে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে তার গোড়া এখানে। কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে এ গোড়ার মুশকিলের সমাধান হবে না।
বর্তমান সমাজে চরম ব্যক্তিতান্ত্রিকতা বা মানুষের স্বার্থপরতার বিপদ আমরা হরদমই দেখছি। তার হাজারও সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু তার সমাধান হিসেবে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করার চিন্তা অবাস্তব। ব্যক্তির অধিকার হরণের কথা আমরা ভাবতে পারি না। অন্যদিকে ব্যক্তির অধিকারই ইতিহাসের চরম সত্য নয়। ব্যক্তিই যদি একমাত্র হয়, তবে সমাজ বলে তো কিছুই থাকে না। সমাজের সত্য কী তাহলে- আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি এ প্রশ্ন একটি মৌলিক প্রশ্ন। সমাজ ও রাষ্ট্রের দিক থেকে যে কারণে ব্যক্তির অধিকারের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া রেওয়াজ, যাতে কোনো ব্যক্তি নিজের অধিকার চর্চা করতে গিয়ে অন্যের বা সমাজের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে না পারে। ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, আইনের কিংবা রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব^ এতে মিটেছে বলা যাবে না। কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে এর চেয়ে ভালো সমাধান নেই।
এখান থেকেই যারা আরও বিকশিত সমাজের কথা ভাবেন, তাদের সমালোচনা শুরু হয়। ব্যক্তিবাদী, ব্যক্তিতান্ত্রিক ও স্বার্থপর সমাজই মানুষের বিকাশের শেষ অবস্থা, আর তার অধিকারের হেফাজত করাই রাষ্ট্রের কাজ- এটাও ঠিক হতে পারে না। যারা মানুষের ইতিহাসের এই কাল পর্ব অতিক্রম করে যাওয়ার ঐতিহাসিক কর্তব্যবোধ করেন, তাদের ভাবতে হয় কিভাবে ভিন্ন ধরনের সমাজ ও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাষ্ট্র গড়া যায়, যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টির কিংবা নিজের ও সমাজের স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো সম্ভব। যাতে সমাজের স্বার্থ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির স্বার্থ আর ব্যক্তির স্বার্থ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সমাজের স্বার্থ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তার জন্য অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। একটা দার্শনিক দাবি তো আছেই যে, একমাত্র রাষ্ট্র শুকিয়ে মরলে বা রাষ্ট্রের বিলয় হলেই কেবল এ সমন্বয় সম্ভব। ব্যক্তিতান্ত্রিকতা ও স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে ব্যক্তি নয়, সমষ্টি বা সমাজের সবার স্বার্থই একমাত্র সত্য- এ চিন্তার ওপর ভিত্তি করে বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের ব্যক্তির আবির্ভাবের শক্তি এত প্রচণ্ড যে, ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ ঘটে যাওয়ার পরও সেই চেষ্টা রোধ করা যায়নি। মানবেতিহাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ব্যক্তি আর সমাজের সম্পর্ক সম্বন্ধে মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। ব্যক্তির অধিকার, রাষ্ট্র, বিচার, গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা ও চর্চারও বিকাশ ঘটেছে অনেক। মূল কথা হচ্ছে, ব্যক্তি ও ব্যক্তির অধিকার এমনই ঐতিহাসিক সত্য যে তাকে যান্ত্রিকভাবে বা রাষ্ট্রের বল প্রয়োগের অধীনে রেখে আটকে রাখা অসম্ভব।
ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজের প্রতি প্রতিক্রিয়াবশত অনেকে কমিউনিজম বলতে বুঝতেন ‘আদিম সাম্যবাদী’ সমাজে ফিরে যাওয়া, যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। মানুষের ইতিহাস যে সামাজিকতার ধারণা নিয়ে বিকশিত হয়ে চলেছে সেটা অতীতের রোমান্টিক কল্পনার ‘আদিম সাম্যবাদী’ সমাজে ফিরে যাওয়া নয়, বরং বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যৎ সমাজের সম্ভাব্য অভিমুখ বা গন্তব্যের নিশানা কিভাবে ফুটে উঠছে তা শনাক্ত ও বিকশিত করার কাজ। ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বার্থপর সমাজকে মার্কস ও লেনিনের অনুসারীরা সাধারণত ‘বুর্জোয়া’ সমাজ বলে থাকেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক পরিভাষা। মার্কস বা লেনিন মোটেও মনে করতেন না ব্যক্তিতান্ত্রিক চরিত্র বা স্বার্থপরতা মানুষের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, যা স্রেফ নীতি-নৈতিকতা বা ধর্ম শিক্ষা দিয়ে দূর করা সম্ভব। মানুষের এ স্বভাবের উৎপত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে ব্যক্তি জীবন চরিতার্থ হওয়ার চেতনাবোধ ও উপলব্ধির সঙ্গে জড়িত। যতদিন জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ব্যক্তিগত সম্পর্কের বৈষয়িক স্বার্থের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে, ততদিন ব্যক্তিতন্ত্র ও স্বার্থপরতার বিনাশ ঘটবে না। এ সমস্যার সমাধান অতএব ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিচারের সঙ্গে জড়িত। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বার্থপরতার খাসিলতটা একটা সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহণ করে। কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির সম্পর্কটাই পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক হয়ে হাজির হয়। একে ‘বদলে দাও, বদলে যাও’ মার্কা স্লোগান দিয়ে বদলানো যায় না। এ চেষ্টা একটা হাস্যকর কর্পোরেট তামাশায় পরিণত হয়। আসলে কথা হচ্ছে, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি ব্যক্তিতান্ত্রিকতা ও স্বার্থপরতাকে মানুষের সার্বজনীন স্বভাব করে তোলে, তাহলে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎখাত ও বিলয় ছাড়া তার মোচন অসম্ভব। এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে নাগরিক ও মানবিক অধিকার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। কারণ এ অধিকার রাষ্ট্রের এখতিয়ার বা সীমাকে প্রশ্ন করে, রাষ্ট্র যখন ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ন করে তখন রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিচার ব্যবস্থা যখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যক্তির নাগরিক ও মানবিক অধিকার অস্বীকার করে, তখন সে ব্যবস্থা নিজেকে বিচার ব্যবস্থা বলে দাবি করতে পারে না। এ অধিকার ক্ষুণ্ন করা একান্তই বাংলাদেশের আদালতের এখতিয়ার- এ যুক্তি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কখনই গ্রহণযোগ্য হয় না। দেশীয় আইনে ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ন করে যে আদালত গঠন করা হয়, সেই আদালত আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
দুই
একাত্তর সালে যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে তাদের বিচার চেয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। সে বিচার নিশ্চিত করার প্রথম শর্ত হচ্ছে সঠিক আইন, সঠিক বিচার পদ্ধতি ও ন্যায়নিষ্ঠ আদালত প্রতিষ্ঠা। সেটা আদৌ হয়েছে কিনা সেই গোড়ার প্রশ্ন উহ্য রেখে আমরা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের স্কাইপ কেলেংকারি, কিংবা সম্প্রতি রায় আগাম ফাঁস হওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আন্তর্জাতিক আদালতের ভাবমূর্তি এতে ভয়ানক ক্ষুণ্ন হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এ দেশের মানুষের ইনসাফের আকাক্সক্ষাও মারাত্মকভাবে অস্বীকৃত হয়েছে।
আরেকটি বিরাট সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক। নাগরিকদের মধ্যে যারা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চাইছেন, তারা তাদের উদ্বিগ্নতা নানাভাবে প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আদালতের বিচার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অনেকে উদ্বিগ্ন। তারা সেটা প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছেন, করছেনও অনেকেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজের ন্যায়নিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হলে তার দায়ভার আদালতকেই নিতে হবে। সম্প্রতি আদালত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহকে আদালত অবমাননার দায়ে আদালতে তলব করেছে। একটি টেলিভিশন টকশোতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কিছু বক্তব্য দিয়েছেন যা আদালত আমলে নিয়ে তাকে তলব করেছে। আমলে নেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ১১(৪) ধারার অধীনে। একইভাবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে আইনজীবী খোন্দকার মাহবুব হোসেন যে বক্তব্য দিয়েছেন তার কারণে তার বিরুদ্ধেও আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চেয়েছেন বিচার সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ যেন মানুষের না থাকে। তিনি চাননি ‘বিচারের বাণী নীরবে নির্ভৃতে কাঁদুক’। তিনি টকশোতে বলেছেন, ‘আজকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আমরা চিরকাল জেনে এনেছি, এটা আমি বিশ্বাসও করেছি, আজকে সে বলছে, সে নাকি ছিলই না, সেটা সত্য, যাই হোক, সে ৪টা সাক্ষীই করেছে, একটা তো বললাম আমাদের সালমান, আরেকজন হলেন একজন সিটিং জজসাহেব, এই হাইকোর্টের বর্তমান জজসাহেবকে সে সাক্ষী মেনেছে এবং উনি বলেছেন উনি সাক্ষী দিতে চান, উনি নাকি দরখাস্ত দিয়েছিলেন, আমাদের মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের কাছে সাক্ষী দেয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন, তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি এবং একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত দিয়েছেন, উনি শুনেছেন। এই যে জিনিসটা এর ফলে কী হবে? সন্দেহটা কিন্তু মানুষের মনে থেকেই যাবে। আইনে বলে এ দশজন আসামি খালাস পেয়ে যাক কিন্তু একজন নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়।
‘সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি আমি, এ লোক দাবি করেছে সে ছিল না, সে হাসনাইন নামের এক জজসাহেবকে সাক্ষী মেনেছে, সেই জজসাহেবকে কেন সাক্ষী দেননি, এটাকে যদি না দেয়া হয়, তাহলে কি বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে না?... এ বিচারক কেন সাক্ষী দেবে না?’
বাংলাদেশে একটা প্রবাদ আছে মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি হলে সেটা সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্রামগঞ্জে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতার পর দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে তার অবদান অসামান্য। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি দেশের গণমানুষের অসীম শ্রদ্ধার পাত্র, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্য অধিকারের অগ্রদূত হিসেবে পরিগণিত। তাছাড়া ১৯৭২ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক এবং ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
এ কথা বলছি তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলে আইনের ঊর্ধ্বে বলার জন্য নয়। এটাই বলার জন্য যে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যারা করেছে, তাদের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে তার চেয়ে আন্তরিক কেউ হতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাকে আদালত অবমাননার জন্য তলব করা আদালতকে বিতর্কিত করা ছাড়া আর কী হতে পারে?
এ লেখায় আজ আমি খুবই ছোট একটি প্রশ্ন তুলে শেষ করব। সেটা হল একই দেশে দুটি আইনি ব্যবস্থা থাকতে পারে কিনা? আইসিটি বাংলাদেশের প্রচলিত আইন বিচার ব্যবস্থা থেকে পৃথক। আইসিটি অ্যাক্ট (International Crimes Tribunal Act, 1973) ১৯৭৩ সালে জারির পর ২০০৩ সাল অবধি চারবার সংশোধিত হয়েছে। আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার ত্র“টি নিয়ে অনেকে অনেক কথা দেশে-বিদেশে বলেছেন। এখানে তার পুনরাবৃত্তি করব না। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের যে প্রশ্ন তুলেছি, সেই আলোকে আপাতত একটিমাত্র প্রশ্ন তুলব।
প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এবং প্রচলিত ক্রিমিনাল পেনাল কোড (ঈৎচঈ) আইসিটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে গণ্য নয়। সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি বিধিবিধানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে বিচার প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে আইসিটি অ্যাক্ট অতএব তার থেকে আলাদা। প্রথমেই তাহলে প্রশ্ন ওঠে, একটি দেশে বিচারের দুটো ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া থাকতে পারে কিনা।
কোনটা সাক্ষ্য প্রমাণ বলে গণ্য হবে কোনটা নয়, তা কি আইসিটির ক্ষেত্রে একরকম আর বাংলাদেশের অন্য আদালতে অন্যরকম হবে? শোনা কথা বা উড়ো কথা সাক্ষ্য নয়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা নানা কাহিনী থাকতে পারে। আদালতের কাজ হচ্ছে বিচারের মধ্য দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। সে কাজ করতে গিয়ে কোনো অপরাধী যদি প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় তাও ভালো, কিন্তু বিনা প্রমাণে কেউ যেন শাস্তি না পায়, এটাই হচ্ছে বিচারের দিক থেকে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের মূল কথা। এ যুক্তিতেই তাহলে নিউজ পেপার কাটিং ইত্যাদির প্রমাণ মূল্য নেই। এভাবে সাক্ষ্য আইন সাজানোর পেছনে মূল অনুমান হল, কোনো ঘটনা বর্ণনা করতে, জানাতে বা জানতে এসবের মূল্য থাকতে পারে, কিন্তু এগুলো অপরাধের প্রমাণ নয়। তাই এ বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থায় ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত’ কথাটার অর্থ সাক্ষ্য আইনের পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে, আক্ষরিক অর্থে নয়।
প্রচলিত ফৌজদারি বিধানে বিচার হচ্ছে সুনির্দিষ্ট ধারা অবলম্বন করে বিচার, যেখানে ‘অপরাধ’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তা আইনের দ্বারা সংজ্ঞায়িত। যে কারণে আমরা বলি, অমুক ধারায় সাজা হয়েছে। সেই ধারায় অপরাধ ‘সন্দেহাতীতভাবে’ প্রমাণিত হলে সাজা কী হবে, সেটাও প্রচলিত ফৌজদারি বিধানে আগেই উল্লেখিত থাকে। অর্থাৎ অমুক ধারায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যে সাজা হয়েছে তা আইনি প্রক্রিয়া মেনেই হয়েছে।
এই ধারা ও সাজা আগাম নির্ধারণ রাখার অর্থ হচ্ছে, বিচার দুই পক্ষের উকিল ও বিচারপতিদের কেবল সুনির্দিষ্ট অভিযোগের মধ্যে মনোযোগী থাকতে বাধ্য করা। বিচারক যেন তার নিজের মর্জি মাফিক কিছু না করেন, সেটা আগাম নির্দিষ্ট করে দেয়া সুবিচারের ধারণার সঙ্গে যুক্ত।
এখন তর্কের খাতিরে ধরা যাক, একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে এ আইন তাদের জন্য। তাহলে আদালত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আদালত অবমাননার জন্য তলব যখন করল, তখন সেই ক্ষেত্রে তিনি আদৌ আদালত অবমাননা করেছেন কি-না তার সাক্ষ্য প্রমাণ কোন আইনের অধীনে হবে? একজন মুক্তিযোদ্ধা মানবতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার সুষ্ঠুভাবে না হওয়ায় উদ্বিগ্ন। আদালত এ উদ্বিগ্নতার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন বলে মনে হচ্ছে না।
মনে রাখা দরকার, রাজপথ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছিল সরকারের সঙ্গে আঁতাতের পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে আদালত লঘু দণ্ড দিয়েছেন। এ ধরনের অবমাননাকর ও রাজনৈতিক অভিযোগ আদালতের বিরুদ্ধে তোলা হলেও এ ব্যাপারে আদালতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। রাজনৈতিক বিতর্ককে আদালতের আঙ্গিনায় নিয়ে গিয়ে আদালত নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এটা অনভিপ্রেত ছিল। তেমনি নাগরিকদের প্রতি অসম আচরণ কিংবা মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে আতংক তৈরি ও হয়রানি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা মনে করি, ব্যক্তি বা আদালত কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নাগরিক অধিকার ও মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার এখতিয়ার কারোই থাকতে পারে না। তাছাড়া দেশে আদালত অবমাননার যে আইন বিদ্যমান ছিল, সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তা বাতিল করেছে। এখন আর বাংলাদেশে আদালত অবমাননার কোনো আইন বা বিচারিক ভিত্তি না থাকাটা নাগরিকদের জন্য খুবই ভীতিকর।
যেহেতু আইসিটি নিজেই একটি সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা, তাহলে আইন ও ন্যায়বিচারের দিক থেকে এতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। তার মীমাংসা নেই। প্রচলিত আইনে আদালত অবমাননা আইন বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আইসিটি কোন আইনে আদালত অবমাননার বিচার করবে? যদি আইন বহালও থাকত, তাহলেও বা আইসিটি কোন আইনে বিচার করত?
বিচার যদি আমাদের পাপের বোঝা না কমিয়ে আরও বাড়িয়ে দেয়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্য একটি দেশের জনগণের জন্য আর কী হতে পারে?

No comments

Powered by Blogger.