শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা কি স্বপ্নই থেকে যাবে? by মোঃ সিদ্দিকুর রহমান

শিশুর জন্মের পর পরই শুরু হয় তার ক্ষুধা নিবারণ, আদর-সোহাগ পাওয়ার অধিকার আদায়ে সংগ্রাম। এ সংগ্রামের প্রাথমিক ভাষা হল কান্না। ধীরে ধীরে শিশু বড় হতে শুরু করে। তার মুখে বোল ফুটতে শুরু করে। তার প্রতিবাদের ভাষাও পরিবর্তিত হয়। আমরা অভিভাবকরা তাদের ভাষা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে শিশুর স্বাভাবিক আচরণ পাল্টে যায়। জিনিসপত্র ভাংচুর বা ছুড়ে ফেলার মতো নেতিবাচক আচরণ দিয়ে তার প্রতিবাদ প্রকাশ করে। এর মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পেতে সে হয়ে ওঠে পরিবার তথা সমাজের যন্ত্রণা। শুধু শিশু নয়, জগতের সব প্রাণীই তার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রাথমিক শিক্ষকরাও তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। শিক্ষকতা জীবনের প্রারম্ভে পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের সময়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগ্রাম করে ১২০ টাকা ও ১৩০ টাকার বেতন স্কেল আদায় করতে দেখেছি। তারপর স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম সরকারি মর্যাদা দেন। ৭৫ পরবর্তী সময়ে সে মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার চক্রান্ত শুরু হয়। অবশেষে ১৯৮০ সালে ঢাকা মহানগরীর প্রাথমিক শিক্ষকদের ভাগ্যে নেমে আসে অমানিশা। ঢাকা মহানগরী ন্যস্ত করা হয় তৎকালীন ঢাকা পৌরসভার হাতে। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে দেশব্যাপী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মঘট শুরু হয়। ২০ দিন ধর্মঘটের পর বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার তাগিদে ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার আগেই তৎকালীন সরকার সারাদেশের শিক্ষকদের গ্রাম সরকারের হাতে ন্যস্ত করে। ১৯৮১ সালের জানুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় ধর্মঘট চলে। প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে ক্ষমতাসীনরা ছাড়া সব রাজনৈতিক দল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সঙ্গে শুধু বিবৃতির মাধ্যমে নয়, বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে একই মঞ্চে অবস্থান করে প্রাথমিক শিক্ষকদের মহাবিক্ষোভের সঙ্গে একাÍতা ঘোষণা করেন। সব বিরোধী দল সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষার জন্য ১৯৮১ সালের ১০ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল ঘোষণা করে। সে সময়ও কিছু শিক্ষক শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের মধ্যে ঢাকা শহরের মোসলেহ উদ্দিন হাওলাদার, এবিএম চাঁন মিয়া ও আঃ আউয়াল তালুকদারের ভূমিকা ন্যক্কারজনক। সেসময় তেজগাঁও থানার শিক্ষকনেত্রী শিল্প এলাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুফিয়া আক্তারের নেতৃত্বে একটি মিছিল করে তেজগাঁও থানার বিজিপ্রেস প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করতে গিয়েছিলাম। দেশব্যাপী হরতালের ব্যাপক প্রস্তুতি দেখে সরকার বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সঙ্গে যৌথ চুক্তি করলে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শেষ হয়। তখন সারাদেশে থানা শিক্ষা অফিসার ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার পদ ছিল না। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দেখাশোনার জন্য সারাদেশে সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার পদ সৃষ্টি করা হল। পরে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণী ও থানা শিক্ষা অফিসারদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হয়। মূলত ১৯৮১ সালের আন্দোলনের ফসল হল সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার পদের জš§ এবং থানা শিক্ষা অফিসারদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি।
২০০৬ সালে শুরু হয় পদমর্যাদাসহ বেতন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। সে আন্দোলনেও আঃ আউয়াল তালুকদাররা প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘটের বিরোধিতা করেন। ফলে শাসকগোষ্ঠী সুযোগ পেয়ে সামান্য কিছু শিক্ষককে প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে তুলতে দেয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শুরু হয় ব্র্যাকবিরোধী আন্দোলন। সে আন্দোলন প্রাথমিক শিক্ষকরা তাদের সরকারি মর্যাদা অক্ষুণœ রাখেন। এ বছর (২০১৩) সরকারি প্রতিশ্র“তি মোতাবেক সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল আপগ্রেড ও প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদার সংগ্রামে সরকারের শেষ সময়ে কিছু পাওয়ার আগেই আবারও সেই বিশেষ মহলটি দৌড়ঝাঁপ, লম্ফ-ঝম্ফ দিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সময়ক্ষেপণ বা প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার। শিক্ষকদের এ আন্দোলনকে নস্যাৎ করা গেলেও পরে ভোটের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যাবে না। প্রাথমিক শিক্ষকরা সমাজে মর্যাদার আসন নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার বাসনা নিয়ে চিন্তিত। বাস্তবতার টানাপোড়েন কিংবা অসুস্থতা ও বার্ধক্যের বেখেয়ালিপনায় আপাত অবাস্তব এক স্বপ্নের ঘোরে একদিন ডুব দিলাম। স্বপ্নে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতাদের সঙ্গে আমি এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎপ্রার্থী। কিছুক্ষণ পর যিনি উপস্থিত হলেন তিনি আর কেউ নন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে আবেগ আপ্লুুত হয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের বললেন, জাতির জনক সর্বপ্রথম ১৯৭৩ সালে আপনাদের সরকারি মর্যাদা দিয়েছেন। সরকারি মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার জন্য আপনারা ১৯৮১ সালে আন্দোলন করেছেন। ২০০৬ সালে বেতন বৈষম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে আজও বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। প্রাথমিক শিক্ষকরা এ দেশের সুনাগরিক তথা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক তৈরির প্রধান স্থপতি। তাই প্রাথমিক শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণীর থাকবে। তিনি কিছুতেই এ ব্যাপারে একমত হতে পারলেন না। তিনি বললেন, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষকরা থাকবেন গেজেটেড, সেখানে আপনারা শুধু প্রধান শিক্ষকদের গেজেটেড মর্যাদা দেয়ার কথা বলছেন। যাক আমি আপনাদের বেতন স্কেল আপগ্রেডসহ প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা বাস্তবায়ন করছি। এ দাবি বাস্তবায়নে সরকারের শীর্ষ মহলে যারা সময়ক্ষেপণ করে আন্দোলন করতে বাধ্য করেছেন, সবার বিরুদ্ধে আমি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আপনাদের দীর্ঘসময় মর্যাদা না দেয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে আবারও দুঃখ প্রকাশ করছি। আমার ও আমার সরকারের জন্য দোয়া করবেন।
স্বপ্নের রেশ কাটলেও বক্তব্যটি নিছক কাল্পনিক মনে করতে চাই না। হিসাব কষতে গিয়ে মনে হল, দীর্ঘদিন রাজপথে আন্দোলন করে যিনি চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন তার পক্ষে প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের মাহাÍত্ময বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রত্যাশা ও দোয়া যেন স্বপ্নে পর্যবসিত না হয়, এ কামনাই করছি।
মোঃ সিদ্দিকুর রহমান : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ও প্রাথমিক শিক্ষাবিষয়ক গবেষক

No comments

Powered by Blogger.