জিএম সিরাজীকে দুদকের পুরস্কার! by মাইনুল এইচ সিরাজী

৯ সেপ্টেম্বর যুগান্তরের বাতায়ন পাতায় দেশের বোকাদের জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি শিরোনামে শাহনেওয়াজ বিপ্লবের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। হলমার্ক কেলেংকারি উদঘাটনের পেছনে সোনালী ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তার কীর্তি তুলে ধরেছেন লেখক। কিন্তু সেই তিন কর্মকর্তার প্রধান জিএম সিরাজীকে ৩৭টি মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে দুদক। এ বিষয়ে আলোকপাত করার জন্যই আমার এই লেখার অবতারণা।
সোনালী ব্যাংকের জিএম আ ন ম মাসরুরুল হুদা সিরাজীকে নিয়ে গর্ব করেছি। তার পরিবারের সদস্য বলে শুধু নয়, দেশের একজন নাগরিক হিসেবেও গর্ব হয়েছে। ভেবেছি, তার মতো কিছু সৎ মানুষ আছে বলেই শত প্রতিকূলতার মাঝেও দেশটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ভেঙেচুরে যায়নি।
হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনায় সোনালী ব্যাংক এবং হলমার্ক গ্র“প যখন সারাদেশে নিন্দিত হচ্ছে, তখন জিএম সিরাজীসহ সোনালী ব্যাংকেরই দুয়েকজন কর্মকর্তা হয়েছেন নন্দিত। কারণ তারা নিজের জীবন এবং ক্যারিয়ার বাজি রেখে এই লুটপাট ঠেকাতে চেয়েছেন এবং তাদের কারণে উদঘাটিত হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাংক কেলেংকারির ঘটনা। গণমাধ্যম, ব্লগ, ফেসবুকে দারুণ প্রশংসিত হয়েছেন তারা। জিএম সিরাজীকে জাতীয় বীর হিসেবে পুরস্কৃত করার দাবিও উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। হ্যাঁ, অবশেষে তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন ৩৭টি মামলায় তাকে আসামি করেছে। সবকটি মামলাই জামিন-অযোগ্য। ফেসবুকে একজন মন্তব্য করেছেন, ভেবেছি দুদক তাকে সংবর্ধনা দেবে। এখন দেখছি উল্টো মামলা দিল। এমন হলে তো মানুষ সৎ কাজের সাহস হারিয়ে ফেলবে। কী এমন কীর্তি গড়েছেন সিরাজী, যে তাকে নিয়ে এত আলোচনা হবে? চলুন তাহলে একটু পেছনে যাই। তার আগে পরিবার থেকে তিনি যে সততাটুকু পেয়েছেন, সে কাহিনী একটু বলে নিই।
আমার আব্বা আনোয়ার উল্লাহ সিরাজী এলাকায় বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। না, তার কোনো বিত্তবৈভব ছিল না। বরং অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু দারিদ্র্য তাকে মহান করেছে। দারিদ্র্য কাউকে মহান করতে পারে- আব্বাকে না দেখলে কবির এই কথায় আমি কখনও বিশ্বাস করতাম না। অবশ্য দারিদ্র্যকে তিনি বরণ করে নিয়েছেন সন্তানদের মানুষ করার জন্য। এই ব্যতিক্রমী ভূমিকার জন্যই তিনি খ্যাতি পেয়েছেন।
নোয়াখালীর চরে তার কয়েক একর জমি ছিল। জমি নিয়ে ঝামেলাও ছিল। এসব ঝামেলা মেটানোর জন্য প্রায়ই মাইজদী দৌড়াতে হতো তাকে, ছেলেমেয়েদের দিকে নজর দিতে পারতেন না। শেষে জমিটমি রেখে খালি হাতে চলে এলেন বাড়ি। সংসার চালানো আর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে গিয়ে তিনি পড়ে গেলেন মহাসমুদ্রে। হাতে টাকা-পয়সা নেই। ভিটেমাটিটুকু ছাড়া আর কোনো জায়গা-সম্পত্তিও নেই। কী করুণভাবেই না কেটেছে আমাদের দিনকাল! পরে একটা চাকরি পেয়েছেন সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। কিন্তু তাতে কী আর চলে? আমাদের নিয়ে চালিয়ে গেছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে এক অসম যুদ্ধ। নিজে খাবি খেয়েছেন। কিন্তু আগলে তুলে রাখার চেষ্টা করেছেন সন্তানদের। আনোয়ার উল্লাহ সিরাজীর সন্তানরা আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠা পেশাগত, আর্থিক নয়। কারণ এদেশে সততার সঙ্গে চাকরি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠা পাওয়া কঠিন। আমাদের তাই এখওে সেরকমভাবে না হলেও মাঝে মাঝে দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হয়।
আনোয়ার উল্লাহ সিরাজীর চতুর্থ সন্তান আ ন ম মাসরুরুল হুদা সিরাজী সোনালী ব্যাংকের জিএম। ১ জানুয়ারি ২০১২ সালে প্রধান কার্যালয়ের আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বিভাগের (আইটিএফডি) মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে যোগ দিয়েই ডিসেম্বরের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন থেকে তিনটি শাখার অনিয়মের কিছু তথ্য পান তিনি। এর মধ্যে স্থানীয় শাখার (লোকাল অফিস) অনিয়মের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা, রূপসী বাংলা শাখায় ৩৫০ কোটি টাকা এবং গুলশান শাখায় প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। এই তিন শাখা পরিদর্শনের জন্য অনুমতি চাওয়া হয় এমডির কাছে। এমডি হুমায়ুন কবীরের কাছে আইটিএফডির জিএম সিরাজী নিজেই নোটটি নিয়ে যান। হুমায়ুন কবীর আইটিএফডিকে নিরীক্ষা চালানোর অনুমোদন দিলেও এর সঙ্গে একটি মৌখিক নির্দেশ দেন। নির্দেশটি হল, আগে স্থানীয় শাখা ও গুলশান শাখায় নিরীক্ষা করতে হবে। এই দুই শাখার নিরীক্ষা শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিয়ে তবেই যেতে হবে রূপসী বাংলা শাখায়। সেভাবেই কাজ চলে। কিন্তু রূপসী বাংলা শাখা নিরীক্ষার সময় এলে বাধা হয়ে দাঁড়ান ডিএমডি মাইনুল হক। হলমার্ক গ্র“পকে রূপসী বাংলা শাখা থেকে লুটপাটের সুযোগ করে দেয়ার জন্য সময়ক্ষেপণের কৌশল নেন তিনি। পরিদর্শন দলের সদস্যদের বিভিন্ন সময় ডেকে এনে অন্য কাজ দেন। এই ফাঁকে বাড়তে থাকে রূপসী বাংলা শাখার অনিয়ম।
ডিএমডি মাইনুল হকের ছুটিতে যাওয়ার সুযোগে আইটিএফডি আর নিরীক্ষা সেল থেকে রূপসী বাংলা শাখা পরিদর্শনের জন্য আবার অনুমোদন চাওয়া হয় এমডির। এমডি অনুমোদন দেন। ঠিক হয় ৪ এপ্রিল থেকে শুরু হবে পরিদর্শনের কাজ। ১ এপ্রিল এই সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ছুটি শেষে ২ এপ্রিল ডিএমডি কাজে যোগ দিলে শুরু হয় নতুন এক সংকট। ওই দিনই আইটিএফডির জিএম মাসরুরুল হুদা সিরাজীকে বদলি করা হয় একই সঙ্গে কুমিল্লা ও সিলেটে। পরদিনই ছাড়পত্র দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এ ঘটনাগুলো যখন ঘটছিল, জিএম সিরাজী আমাদের অনেক আশংকার কথা বলেছেন। বলেছেন, তার জীবন আজ হুমকির মুখে। এসব শুনে আমরা আতংকিত হয়ে পড়ি। বিশেষ করে হুমকি বিষয়টা আমাদের কাছে নতুন। আমাদের পরিবারের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। কারও সঙ্গে কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্ব নেই। তাই আমাদের জন্য চাপটা ছিল বেশি। আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং বলি, কেন আপনি স্রোতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গেলেন? তখন উল্টো তিনি আমাদের বুঝিয়েছেন। বলেছেন, তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। এর বেশি কিছু করেননি। তিনি আমাদের বিশ্বাস করতে বলেছেন- সততার জয় একদিন হবেই এবং আমাদের আব্বার জীবন থেকে শিক্ষা নিতে বলেছেন।
আমরা তখন কত কঠিনভাবে বুঝেছি, মাসরুরুল হুদা সিরাজী যদি এই ভূমিকাটা পালন না করতেন, সততার সঙ্গে নিজের কাজটা যদি না করতেন তাহলে কত ক্ষতি হয়ে যেত আমাদের। আমাদের পরিবারটা আক্ষরিক অর্থেই ডুবে যেত একেবারে। কিন্তু শেষ রক্ষা তো হয়নি। সততার জয় এভাবে হবে- আমাদের বোকা পরিবারটা তা ভাবেনি। দুর্নীতি দমন কমিশন প্রকারান্তরে নীতিকে দমন করে আমাদের পরিবারটাকে ডুবিয়েই দিল। আমরা আজ হতাশ ও শোকাকুল। এর আগে কখনও এতটা ভেঙে পড়িনি আমরা। পরিবারের কারও মৃত্যুতেও নয়, এমনকি আরও কোনো বড় বিপর্যয়েও নয়। আমাদের পারিবারিক সম্মানের কবর রচনা করেছে দুদক। এখন প্রতি মুহূর্তে আমাদের মূল্যবোধের মৃত্যু ঘটছে। আমরা অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে আবিষ্কার করছি- আমাদের আÍবিশ্বাসও মরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সততার প্রতি সম্মানবোধ ফিকে হয়ে আসছে। সবকিছু ঝাপসা লাগছে আজ। আমাদের করা গর্বগুলো উল্টো ছোবল মারছে আমাদের। কিন্তু এই ভেঙে পড়া তো শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির। এটা একটা আদর্শের ভেঙে পড়া, একটা বিশ্বাসের ভেঙে পড়া।
এ দেশে নীতি দেখাতে গেলে কী পরিণতি হয়- চোখ মেলে অসহায়ের মতো দেখছি আমরা। না, আর নীতি-নৈতিকতাকে উৎসাহিত করব না। দুর্নীতির গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়াই বরং নিরাপদ। জিএম সিরাজীকে নিয়ে এতদিন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি বলে ক্ষমা চাচ্ছি। ও হ্যাঁ, এই দেশ আমার দেশ নয়। আমাকে ক্ষমা করবেন।
মাইনুল এইচ সিরাজী : জিএম সিরাজীর ছোট ভাই

No comments

Powered by Blogger.