ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে দুদক by এমএইচ খান মঞ্জু

দুর্নীতি দমন ব্যুরো দিয়ে কার্যকরভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ তথা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না বিধায় যুগের প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক গঠন করা হয়। কিন্তু সরকারের নানামুখী হস্তক্ষেপ ও হিসাব-নিকাশের জাঁতাকলে পড়ে দুদক আরেকটি নখদন্তহীন শ্বেতহস্তী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে দুদককে নিজের মতো করে ব্যবহার করায় তা এখন আর স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নেই। দুর্নীতি ও দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকার সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বদলে নিজেদের মনগড়া ব্যবস্থা চালু করে নিজেরা দুর্নীতির দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার নানা নির্লজ্জ কসরত চালিয়ে আসছে। দুদক যে ‘নখদন্তহীন বাঘ’ সে সম্পর্কে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কিছু মূল্যবান পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, আমি যোগদানের পর তিন মাস পর্যবেক্ষণ করি, দুদকের মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ কী। তখন দেখতে পাই, একজন ব্যক্তির মামলা ছাড়া আর কোনো মামলার রায় দুদকের পক্ষে আসেনি। কারও শাস্তি হয়নি। আমাদের আইনি প্রক্রিয়ায় অর্থের বিনিময় থাকলে বিচার ঝুলে যায়। আইনের এ প্রক্রিয়া যতদিন থাকবে, ততদিন দুদক দন্তহীন বাঘই থাকবে। দুদক চেয়ারম্যানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বলতে হয়, দুদক আসলে কাগুজে বাঘ। কারণ আমরা দেখেছি পদ্মা দুর্নীতি, হলমার্ক, ডেসটিনির মতো প্রতারণার ঘটনায় দুদকের কঠোর হুশিয়ারির সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে আÍগোপনে চলে গেছেন। দুদকের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের হইচইয়ের কারণে জামিন পাওয়া অপরাধীদের আবার ধরার জন্য র‌্যাব ও পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের অনেক আশা ছিল। দেশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ মানুষ মনে করেছিল, নির্মূল না হোক, অন্তত কমে আসবে দুর্নীতি। কিন্তু তা যে হয়নি সেটা প্রতি বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান জানিয়ে দেয়। তাই মানুষ একটা শক্তিশালী ও স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের উপস্থিতি চায় দেশে। কিন্তু দুদকের কাছে মানুষের বড় আকাক্সক্ষার জায়গা যেটা, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ, সেখানে তারা হতাশার কারণ হচ্ছে।
পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় সংস্থাটি প্রধান সন্দেহভাজন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে একবেলা কথা বলেই তাকে ‘নির্দোষ’ সনদ দিয়েছিল। সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে পাওয়া প্রায় ৭০ লাখ টাকার বিষয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। অথচ পরের ইতিহাস সবাই জানেন। দুদকের সেসব বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত যে মোটেই সঠিক নয়, তা দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট। বর্তমান সরকারের আমলে দুদক সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতাগুলোর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো।
পদ্মা সেতু দুর্নীতি
এ সরকারের আমলে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা ছিল পদ্মা সেতু দুর্নীতি। এই প্রকল্পে দুর্নীতির সন্দেহ করে বিশ্বব্যাংকের আশংকার পর পদ্মা সেতু দেশে-বিদেশে আলোচনায় উঠে আসে। আর আন্তর্জাতিভাবে দুদক আলোচনায় আসে, যখন দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যবেক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে পদ্মা সেতু দুর্নীতির তদন্তে দুদকের কার্যক্রম যথাযথ হয়নি বলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়। অভিযোগ আছে, বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের সুপারিশ অনুযায়ী দুদক কাজ করেনি। বিশেষজ্ঞ কমিটি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করলেও তা আমলে নেয়নি দুদক।
মন্ত্রী সুরঞ্জিতের এপিএসের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা
রেলের নিয়োগ-বাণিজ্যের ৭৪ লাখ টাকা মন্ত্রীর বাড়িতে নেয়া হচ্ছিল বলে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িচালক আজম খান দাবি করেছিলেন। তাকে আজও খুঁজে পায়নি দুদক। এ ঘটনার তদন্তে প্রথম দিকে দুদকের গা ছাড়া ভূমিকা তখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। এমনকি রেলমন্ত্রী ও তার এপিএসকে বাঁচানোর চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল দুদকের বিরুদ্ধে।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি
এ সরকারের আমলে একটি আলোচিত বিষয় ছিল সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্কসহ পাঁচটি কোম্পানির প্রায় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা। এ ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তের পর ফান্ডের এক হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে গত বছরের ৪ অক্টোবর হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকের ২৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন এখনও জমা দিতে পারেনি দুদক।
ডেসটিনি গ্রুপের মানি লন্ডারিং
বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনির দুটি প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ও ট্রি-প্লান্টেশন লিমিটেডের তিন হাজার ২৮৫ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে গত বছরের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় দুটি মামলা করে দুদক। এরপর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি দুদকের তদন্ত কমিটি।
বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি
বিসমিল্লাহ গ্রুপের প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। এ ঘটনায় পাঁচ ব্যাংকের ৬০ জনের বেশি কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। গত ২৬ ফেব্র“য়ারি অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে এ ঘটনায় গঠিত অনুসন্ধান কমিটি। বিষয়টির এখনও কোনো সুরাহা হয়নি।
আইনি জটিলতায় রানা প্লাজা ট্রাজেডির অনুসন্ধান
সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আবদুল খালেক ও মা মরজিনা বেগমের অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদকের অনুসন্ধান আইনি জটিলতায় থেমে আছে। সোহেল রানা ও তার বাবা জেলে থাকায় সম্পদ বিবরণী চেয়ে নোটিশ করতে পারেনি দুদক।
জনগণ দুদককে নখদন্তযুক্ত হিংস কিংবা নখদন্তহীন কাগুজে বাঘ- এ দুইয়ের কোনোটির রূপেই দেখতে চায় না। জনগণ চায়, দুদক একটি মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমনে সুষ্ঠু ভূমিকা পালন করুক।
দুর্নীতি দমনে দুদককে কার্যকর করতে হলে এর আইনি সংস্কার খুবই জরুরি। আইনত এটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে কাজের কাজ কিছুই হবে না- শুধুই বিরোধী মতের মানুষকে দমনে এটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহত হবে। দুদককে শক্তিশালী করতে হলে এর আইনকে যুগোপযোগী করতে হবে। একে স্বাধীন করতে হবে। সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে বা সরকারের ইশারায় চললে বা বিরোধী দল বা মতকে দমনে এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করলে দুদক কোনো দিনই স্বাধীন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে না। এটা জনগণের কাক্সিক্ষতও হবে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যারা নিয়োগ পাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই এই বিষয়ের লোক নন। দুর্নীতি তদন্তের উচ্চতর কোনো অভিজ্ঞতা তাদের নেই, নেই দুর্নীতিবিষয়ক কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা দুর্নীতি সংক্রান্ত অপকর্ম খতিয়ে দেখার যথাযথ যোগ্যতা। কেন জানি দুদক চেয়ারম্যান নিয়োগ হচ্ছে ওই পদের জন্য উপযুক্ত বিশেষ কোনো যোগ্যতা ছাড়াই।
দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারকে সত্যিকারের সদিচ্ছার প্রমাণ রাখতে হবে। দুদক যেন আবার কোনো অনির্বাচিত সরকারের সুযোগে অতি নখদন্তযুক্ত অথবা নির্বাচিত সরকারের আজ্ঞাবহ নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়। এজন্য দুদককে যথার্থই একটি স্বাধীন ও দুর্নীতি দমনে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা জরুরি। জনগণ আশা করে, যাদের জন্য দেশ ও জাতিকে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়, দেশের সম্পদ ধ্বংস হয়, দেশের সুনাম নষ্ট হয়- তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য দুদক কঠোর উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কাগজে কলমে নয়, বাস্তবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠবে দুদক।
এমএইচ খান মঞ্জু : সাবেক সংসদ সদস্য, গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল

No comments

Powered by Blogger.