আমার ই-মেইল আইডি হ্যাকড হওয়ার পর... by মোকাম্মেল হোসেন

যুগান্তর পাঠকের কাছে প্রবীর বিকাশ সরকার নামটা অপরিচিত নয়। জাপান প্রবাসী প্রবীর বিকাশ সরকার যুগান্তর সাময়িকীতে জাপানে রবীন্দ্রনাথ কতটা সমাদৃত- এ নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখা লিখে থাকেন। ৩১ জুলাই বিকালে কমিউটার ট্রেনে চড়ে ময়মনসিংহে যাচ্ছি, এমন সময় প্রবীরদার ফোন-
: মোকাম্মেল, তুমি ঠিক আছো তো!
ট্রেনের পরিবেশ অতি চমৎকার। টিকিট পাওয়া নিয়েও কোনো সমস্যা হয়নি। তাহলে ঠিক-বেঠিক থাকার প্রশ্ন আসছে কেন? ওনার কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম-
: হ্যাঁ, ঠিক আছি তো!
- রোজা রাখছ?
: জি।
- তুমি এখন কোথায়?
ট্রেন তখন জয়দেবপুরের আগের স্টেশন ধীরাশ্রম অতিক্রম করছিল। আমি জায়গাটার নাম বলতেই উনি বললেন-
: মোকাম্মেল, তুমি কী জান- তোমার ই-মেইল অ্যাড্রেস হ্যাকড হইছে?
- না তো!
: আমি তোমার ব্যক্তিগত ই-মেইল অ্যাড্রেস- অন্যচিত্র-জিমেইল.কম থেইক্যা একটা মেইল পাইছি। তাতে ভয়াবহ সব কথাবার্তা লেখা! এই ই-মেইলের সঙ্গে তোমার ছবিও সংযুক্ত করা হইছে!
-বলেন কী!
: তোমার অফিসের ই-মেইল অ্যাড্রেস বল- আমি সেই অ্যাড্রেসে এইটা ফরোয়ার্ড কইরা দিতেছি...
আজকাল চলার পথে অনেকেই সঙ্গে ল্যাপটপ রাখে। ল্যাপটপ সঙ্গে থাকলে হাটে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে ইন্টারনেট দুনিয়া বগলে নিয়ে ঘোরা যায়। তাছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুবিধা সংবলিত মোবাইল ফোন সঙ্গে বহন করাটা এখন অনেকের কাছেই পান্তাভাত। আমার সঙ্গে ল্যাপটপ নেই। ইন্টারনেটের সুবিধা সংবলিত মোবাইল ফোন তো পরের ব্যাপার, পারলে শুধু কথা ও এসএমএস আদান-প্রদানকারী হিসেবে সেবা দেয়া আমার এ সাধারণ মোবাইল ফোনসেটটাও আমি বর্জন করার পক্ষে। এ যন্ত্র আমার জীবনে শান্তিহরণকারী একটি বস্তুরূপে আবির্ভূত হয়েছে। এর যন্ত্রণা থেকে আÍরক্ষার উপায় হিসেবে একবার আমি সিদ্ধান্ত নিলাম- দিনে ৩টার বেশি ফোনকল রিসিভ করব না। আর নিতান্ত নিরুপায় না হলে কাউকে সাতদিনেও একটা ফোন করব না। এ নিয়ম চালু করার একদিন পরে দিবসের প্রথম ফোনকল রিসিভ করতেই আমার গ্রামের একজন বলে উঠলেন-
: দাদামিয়া- বড়লোক অইয়া গেছুইন নাকি?
- কেন?
: ফোন করি- কোনো সাড়াশব্দ দেইন না!
দ্বিতীয় ফোনকলটি ছিল আমার এক বন্ধুর। সে বলল-
: কিরে, পাঙ্খা গজাইছে নাকি?
- না তো!
: তাইলে ফোন ধরস না কী জন্য?
দিনের তৃতীয় ফোনটি ছিল লবণ বেগমের। সে রেগেমেগে জানতে চাইল-
: কী হইছে তোমার?
- কিছু হয় নাই তো!
: ফোন ধর না কেন! বিষয় কী?
- কোনো বিষয় নাই। আমি সিদ্ধান্ত নিছি- এখন থেইক্যা অ্যাকরডিং টু সিরিয়াল- দিনে ৩টার বেশি ফোনকল রিসিভ করব না।
: আজব! কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীরাও তো এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না! তুমি কি তাদের চাইতেও মোকাব্বর হইয়া গেছ নাকি?
- মোকাব্বর বল, আর আকাব্বর বল- প্রকৃতপক্ষে প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীরা পরাধীন জীবনযাপন করেন। আমি তাদের মতো পরাধীন হইয়া জীবন কাটাইতে চাই না!
: এতই যদি স্বাধীন থাকার শখ- তাইলে বিবাহ করছ কী জন্য? কল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করবা। মনে থাকব?
- জি, মনে থাকব।
ট্রেন থেকে নামার আগে সহকর্মী তরিক রহমানের ফোন পেলাম-
: মোকাম্মেল ভাই, আপনে কোথায়?
- আমি তো গোয়িং টু মমিসিং।
: আপনের ই-মেইল হ্যাকারের কবলে পড়ছে!
- জানি।
: হ্যাকড হওয়া আপনের সেই ই-মেইল অ্যাড্রেস থেইক্যা আর্জেন্ট শিরোনামে কিছুক্ষণ আগে আমার কাছে একটা মেইল আসছে। আমার ধারণা- এই মেইল আপনের পরিচিত অর্থাৎ যাদের সঙ্গে আপনের ই-মেইলে যোগাযোগ আছে, তাদের সবার কাছেই পাঠানো হবে।
- হায় আল্লাহ, এখন উপায়!
: অসুবিধা নাই। আপনে পাসওয়ার্ড চেইঞ্জ কইরা ই-মেইল অ্যাড্রেসটা রিকভার করেন। তারপর প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে দুই লাইন লেখার পর স্যরি বইল্যা সবার কাছে একটা মেইল সেন্ড কইরা দেন।
বাসায় যাওয়ার পর কথিত সেই ই-মেইলে চোখ রাখার পর আমার চোখ দুটো মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেল। ইংরেজিতে লেখা ই-মেইলটির বাংলা করলে যা দাঁড়ায়, সংক্ষেপে তা হল এরকম-
অতি জরুরি। আমি মোকাম্মেল হোসেন। তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে আসার পর বেকায়দা অবস্থার মধ্যে পতিত হইছি। ছিনকাইকারীরা আমার নগদ টাকা-পয়সা তো নিছেই, সেই সঙ্গে পাসপোর্ট, মোবাইল ফোন, ক্রেডিট কার্ডও লইয়া গেছে। এখন আমার খুব বিপদ। দয়া কইরা আমারে কিছু টাকা দিয়া সাহায্য করেন। আমারে সাহায্য করার নিয়ত কইরা আপনে যদি টাকা পাঠাইতে চান- তবে তার সর্বোত্তম মাধ্যম হইল ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন। হে দয়াবান, আগামী তিন অথবা চার কার্যদিবসের মধ্যে আপনে যদি আমার এই আবেদনে সাড়া দেন তবে আমি ফিরতি ই-মেইলে এখানকার ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের কোন শাখায় টাকা পাঠানো যাবে তা আপনাকে জানাইয়া দেব। আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। এই মসিবত থেইক্যা উদ্ধার পাইয়া দেশে ফেরার পর সর্বাগ্রে আমি আপনের ঋণ পরিশোধ করার ব্যবস্থা করব। ইত্যাদি- ইত্যাদি।
হাসব না কাঁদব- বুঝতে পারছি না। ইতিপূর্বে আমি নিজেও অনেকের কাছ থেকে এরকম ই-মেইল পেয়েছি। একবার এক মহিলার একটা ই- মেইল পেলাম। সে নাকি সলোমন দ্বীপের মালিকের মেয়ে। তার বাবা হঠাৎ ইন্তেকাল করায় এখন সে এই দ্বীপটির ‘মালকিন’ হয়েছে। তবে সমস্যা হল, দ্বীপটি ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে তার বাবা ঋণ উত্তোলন করেছিল। এসব তথ্য দেয়ার দ্বীপের মালকিন প্রস্তাব দেয়-
: ব্যাংকের সামান্য পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করে তুমি এই দ্বীপের মালিক হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করতে পার। সেইসঙ্গে তুমি যদি চাও, তবে আমিও তোমার হতে পারি। কেননা, আমি এখনও কুমারী।
আরেকটা ই-মেইল পেলাম। সেখানে বলা হয়েছে-
: তুমি একটা লটারি জিতেছ। এর মূল্যমান হচ্ছে প্রায় দুই কোটি টাকা। পুরস্কারের এ টাকা পেতে হলে তোমাকে যে কুরিয়ার সার্ভিসে টাকা পাঠানো হবে, তার মাশুল হিসেবে যে টাকা চার্জ ধার্য করা হয়েছে, সেটা অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে। তুমি অগ্রিম চার্জ পরিশোধ করতে রাজি আছ কিনা আমাদের জানাও...
আমার বিশ্বাস, আধুনিক যোগাযোগের মাধ্যম ই-মেইল ব্যবহারকারীরা মাঝে মধ্যেই এ রকম ই-মেইল পেয়ে থাকেন। এগুলোকে বলা হয় স্প্যাম মেইল। স্প্যাম মেইলগুলো ইন্টারনেট সেবাদাতাদের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। তাদের বিবেচনায় স্প্যাম হল ভুয়া, অসত্য কথন বা ভাষণ- যা দূষিত; যা থেকে সাধারণ ই-মেইল ব্যবহারকারীর ক্ষতির আশংকা রয়েছে।
পৃথিবীতে ভুয়া বা মিথ্যার কারবার নতুন কিছু নয়। অনেকেই এ কারবারের সঙ্গে যুক্ত। রাস্তা-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে কিংবা স্টিমার-লঞ্চে দেখা যায়- নানা মসিবত বা প্রয়োজনের কথা বলে মানুষ অন্যের কাছে টাকা-পয়সার জন্য হাত পাতছে। একবার রাতেরবেলা মগবাজার থেকে পল্টন যাচ্ছি। কাকরাইল মোড়ে বাস থামার পর বাসে এক মহিলা উঠলেন। মহিলার চোখ দুটি বাদে শরীরের বাদ বাকি সব কাপড় দিয়ে ঢাকা। তিনি সবাইকে সালাম দিয়ে একটা কোরআন শরিফ কেনার জন্য সাহায্যের আবেদন জানাতেই এক ভদ্রলোক সিট থেকে লাফ দিয়ে উঠে বললেন-
: আইজ নয় বছর ধইরা দেখতেছি- তুমি কোরআন শরিফ কেনার জন্য টাকা তুলতেছ! আর কত বছর পার হইলে তুমি একটা কোরআন শরিফ কিনতে সক্ষম হবা- কওছেন আমারে!
ভদ্রলোকের কথা শুনে মহিলা নীরব হয়ে গেলেন এবং কিছুক্ষণ বাদে পরের বাস স্টপেজে চুপচাপ নেমে গেলেন। ইদানীং নতুন একটা স্টাইল শুরু হয়েছে। মুখে কিছু না বলে সবার হাতে একটা করে ছোট্ট কাগজ ধরিয়ে দেয়া হয়। সেই কাগজে একেকজনের একেক রকম দুঃখের ইতিহাস লেখা থাকে। এসব ইতিহাস রচয়িতার মধ্যে কে সৎ আর কে অসৎ, কে আসল আর কে নকল- বোঝা মুশকিল। নিয়তির এমনই খেলা, ধান্ধাবাজির এ কারবারের সঙ্গে আজ আমার নামও যুক্ত করা হয়েছে।
ময়মনসিংহে যাওয়ার একদিন পর লবণ বেগমের ফোন পেলাম। লবণ বেগম উত্তেজিত কণ্ঠে জানতে চাইল-
: তুমি কোথায়?
- মানে? তুমি জান না, আমি কোথায়!
: না, জানি না। আমি তোমার মুখ থেইক্যা শুনবার চাই। বল, তুমি এখন কোথায়?
- আশ্চর্য! আমি এখন মমিসিং আছি- এইটা তুমি জান না?
: তুমি মমিসিংয়ে আছ, না তুরস্কে আছ?
- কী!
: আমার কাছে লোকজন ফোন কইরা জানতে চাইতেছে- তুমি সত্যি সত্যি তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে যাইয়া ধরা খাইছ কিনা! সত্যই তোমারে টাকা-পয়সা দিয়া সাহায্য করন লাগব কিনা! কও, আমার ভাগ্যে এইসবও ছিল! তাসিনের আব্বা, লোকজন তো তোমারে রীতিমতো চিটার বলা শুরু কইরা দিছে!
লেখার এ পর্যায়ে জ্যোতিদার ফোন পেলাম। আমি এক সময় স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদে (বিইউপি) গবেষক হিসেবে কাজ করতাম। জ্যোতিদা হচ্ছেন বিইউপির চেয়ারম্যান প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ স্যারের পিএস। তিনি উপরোক্ত ই-মেইলের প্রসঙ্গ তুলে বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন-
: জনাব, আপনার একটা মেইল পেলাম। এসব কী...
আমি বিষণœ কণ্ঠে তাকে জানালাম-
: দাদা, সব মিথ্যা, বানোয়াট। সম্প্রতি আমি তুরস্কে যাই নাই। বাংলাদেশেই আছি। এইসব হইল দুষ্টলোকের বদমাইশি। ধান্ধাবাজি...
- আপনি তাহলে সবাইকে সাবধান করে দেন!
জ্যোতিদার পরামর্শ মেনে আমি আমার ই-মেইল আইডি ব্যবহার করে পাঠানো মেইল সম্পর্কে সবাইকে সাবধান করছি- প্রকৃতপক্ষে এটি সম্পূর্ণ ভুয়া জিনিস। কেবল প্রতারণা করার উদ্দেশ্যেই এটি আপনাদের কাছে প্রেরিত হয়েছে। এ ঘটনা প্রতিরোধ করার জ্ঞান-বুদ্ধি বা এড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই। অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনার জন্য তাই আমি সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি।
মোকাম্মেল হোসেন :
সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.