মিডিয়াই ভগবান by তসলিমা নাসরিন

কাল সকালে কলকাতা থেকে এক বন্ধুর ফোন এলো। কথাগুলো আমাদের এমন ছিল--
শ- আহ, কী যে ভালো লাগছে আজ! আনন্দবাজারে তোমাকে নিয়ে লিখেছে।
আমি পড়ছি শোনো। ‘সেই আগুন জ্বলে উঠেছে এখন তসলিমা নাসরিনের মধ্যেও। ইন্টারনেট খুললেই গোটা দুনিয়া তাঁর ঘরের ভেতর। সময়টা যেহেতু ফুরিয়ে আসছে, জীবনের সবটুকু রস আগ্রাসী ভাবে পেতে ইচ্ছে করে তাঁর। ফেসবুক-টুইটারে থেকে বন্ধুদের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ রাখছেন। আইপ্যাডেও সমান সিদ্ধহস্ত। আর এ সব নিয়েই তিনি এখন দিব্যি আছেন বাহান্নতে’।

ত-বাহান্নতে?
শ-হ্যাঁ বাহান্নতে।
ত-বাহান্ন লিখেছে?
শ-হ্যাঁ বাহান্ন লিখেছে।
ত-কিন্তু আমি তো বাহান্ন নই।
শ-বাহান্ন নও মানে? বাহান্নই তো লেখা আছে এখানে।
ত-কে লিখেছে?
শ-সংযুক্তা বসু লিখেছে। আনন্দাবাজারের সাংবাদিক।
ত-ও তো আমাকে ফোন করেছিল ক’দিন আগে। বাহান্ন   শব্দটাই তো উচ্চারিত হয়নি। পঞ্চাশ নিয়েই কথা হচ্ছিল। ও কিছু প্রশ্ন করেছিল। আমি ওর প্রশ্ন আর আমার উত্তর  নিয়ে একটা ব্লগও লিখেছি।   সংযুক্তা তো পড়েছে ব্লগটা।
শ-তোমার ওই পঞ্চাশ নামের ব্লগটা তো? আমিও তো পড়েছি। আমি তোমার সব ব্লগ পড়ি।
ত-কিন্তু ভাবছি, সংযুক্তা এই ভুলটা করলো কেন। পঞ্চাশের বদলে বাহান্ন লেখার কারণ কী? সে কি জানে না আমার বয়স? আমাকে তো   জিজ্ঞেস করলো, পঞ্চাশ হওয়ার পর কেমন ফিল করছেন বলুন। বয়স না জানলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতো, আমার যে কোনও বই ওল্টালে তার জ্যাকেটেই পেতে পারতো জন্ম তারিখ, আমার ওয়েবসাইটেও আছে, নেটে সার্চ করলেই বেরিয়ে পড়তো।  আমার বয়স জানা তো বেজায় সহজ।   কিন্তু বানিয়ে বাহান্ন লিখবে কেন! আজকাল সাংবাদিকরা বড় আলসে হয়ে গেছে। সন্ধেবেলায় কোন মদের পার্টিতে যাবে তার হিসেব রাখতেই ব্যস্ত। সিরিয়াসলি সাংবাদিকতার কাজটা করে না। মানে  বাট মুভ করে না। ডেস্কে বসেই দুনিয়ার  খবর লেখে।
শ-শোনো, আমাদের কলকাতায় আমরা এভাবেই বলি।
ত-মানে?
শ-মানে আমরা প্লাস দিয়ে বয়স বলি। ধরো ষাট প্লাস, বাষট্টি প্লাস।
ত-কিন্তু ও তো প্লাস লেখেনি। লিখেছে বাহান্ন। আর প্লাস বললেও তুমি তো পঞ্চাশ প্লাস বলবে আমাকে, বাহান্ন তো নয়।
শ-বাহান্ন তো পঞ্চাশের পরই আসে। বাহান্নই তো।
ত-বাহান্ন কী করে হলো? তুমি তো সেদিন আমার পঞ্চাশ জন্মোৎসব পালন করতে এলে। এর পর তো এক বছরও পার হয়নি। একান্নর উৎসবে  তুমি বলেছো আসতে পারবে না। এখানে বাহান্নটা তুমি পাচ্ছো কোথায়?
শ-পঞ্চাশ হয়েছে। এখন একান্ন হবে। আর একান্ন হলে আমরা একান্ন প্লাস বলি, তার মানে বাহান্ন।
ত-কিন্তু আমার  তো এখনও একান্ন হয়নি! একান্ন না হলে তো একান্ন প্লাস হয় না। আর একান্ন প্লাস যার হয়নি, তার বাহান্ন কী করে হলো?
শ-আমরা কলকাতায় ওভাবেই বলি।
ত-আবারও বলছো ওভাবেই বলো। কীভাবে বলো, যার সবে  পঞ্চাশ হলো, তাকে বাহান্ন বছর বয়স বলো?
শ-তুমি বাহান্ন না হলে আনন্দবাজার লিখবে কেন বাহান্ন?
ত-সেটাই তো বলছি। লেখাটা তো   উচিত হয়নি। তোমার কাছে এখনও কি মনে হচ্ছে আমার বয়স বাহান্ন?
শ-কাগজে তো সেরকমই লিখলো। তোমার বয়স নিশ্চয়ই বাহান্ন।
ত-তাহলে আমার সত্যিকারের জন্মসাল কি ভুল?
শ-সে কী করে জানবো?
ত-তুমি কি তাহলে মনে করছো আনন্দবাজারে সংযুক্তা বসু নামে যে মহিলাটি চাকরি করে, যাকে আমি চিনিনা,  আমার যা বয়স লিখেছে, সেটি ঠিক, আর আমার বয়স যা আমার জন্ম থেকে আমার মা জানে, বাবা জানে, যে জন্মসাল আমার   পাসপোর্টে, বইএর জ্যাকেটে, আমার সার্টিফিকেটে, সমস্ত পরিচিতিতে – সব  ভুল?
শ-কাগজে কি এমনি এমনি লিখবে?
ত-তুমি যে আমার জন্মদিন পালন করতে এলে, সেটা কত বছরের জন্মদিন ছিল?
শ-পঞ্চাশ।
ত-তুমি যে এসেছিলে, একবছর পার হয়ে গেছে?
শ-না।
ত-তাহলে আমার বয়স কত এখন?
শ-বাহান্ন।
ত-আমার বয়স তো পঞ্চাশ হয়েছে। তাহলে নিশ্চয়ই পঞ্চাশ।
শ-কিন্তু আনন্দবাজারে  তো বাহান্ন লিখেছে।
ত-আনন্দবাজারে যেহেতু বাহান্ন লিখেছে,  তোমার হিসেবে না  মিললেও আমার বয়স  বাহান্ন?
শ-তোমার বয়স যদি বাহান্ন না হয়, তাহলে আনন্দবাজার কেন বাহান্ন লিখবে?
ত-সেটাই তো বলছি, ওরা ভুল করেছে।
শ-ভুল করেছে? কাগজ ভুল করেছে?
ত-হ্যাঁ। কেন? তোমার কি মনে হয় আমার বয়সের ব্যাপারে  আমি ভুল করতে পারি,  কিন্তু কাগজ ভুল করতে পারে না।
শ-কাগজ ভুল করবে কেন?
ত-আচ্ছা বাদ দাও, একটা কথা বলোতো, আমি কলকাতা ছাড়ার পর তুমি এবং আমার আরও বন্ধুরা তো একটা অভিযোগই করো যে আমি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করি না। কাউকে ফোন করি না। ইমেইল করি না। অভিযোগ করো না?
শ-হ্যাঁ তা তো করিই।  তুমি তো কখনও কোনও বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করো না।
ত-আর ফেসবুকে, টুইটারে?
শ-কত মেসেজ রেখেছি ফেসবুকে, কোনওদিন কোনও উত্তর দাওনি। তোমার বন্ধুরা এখন কোনও উত্তর আশাও করে না। আমরা সবাই জানি তুমি কোনও মেসেজের উত্তর দেবে না।  কিন্তু তাতে কী! তোমাকে সবাই আমরা ভালোবাসি। তুমি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকো, ইওরোপ আমেরিকায় কদিন পর পরই যাচ্ছো লেকচার দিতে, তোমার মতো ব্যস্ত লেখক ক-জন আছে! তুমি আমাদের ফোন করবে, এসএমএস করবে, ইমেইল করবে, ফেসবুকে আসবে, স্কাইপে আসবে, সত্যি বলছি, কল্পনার বাইরে আমাদের। তুমি মন দিয়ে লেখো, তোমার কাজ করো, সেটাই চাই। যোগাযোগ আমরাই করে নেবো। সাতদিন ফোন না ধরলেও একদিন   তো ধরবে। এ কি আর আজ থেকে? আমরা অভ্যস্ত এই নিয়মে।
ত-তাহলে আনন্দবাজারের এই লেখাটা তোমার ভালো লাগলো কেন?
শ-এতে লেখা ভালো না লাগার কী আছে?তোমাকে নিয়ে কতদিন পর লিখলো।
ত-কাগজে তো লিখেছে, আমি নাকি বন্ধুদের সঙ্গে খুব যোগাযোগ করি।
শ-হ্যাঁ লিখেছে। নিশ্চয়ই যোগাযোগ করো। তা না হলে লিখবে কেন?
ত-তুমি তো একটু আগে বললে, আমি যোগাযোগ করি না কোনও বন্ধুর সঙ্গে।
শ-করো না। কিন্তু হয়তো হয়তো করো।
ত-তুমি তো আমার বাড়িতে অনেকদিন থেকেও গেছো, দেখেছো কারও সঙ্গে কনটাক্ট করতে?
শ-না তা দেখিনি। সাংবাদিকদের  মতো কি ওভাবে দেখতে জানি? সাংবাদিকরা অনেক বড় মানুষ। আমরা তুলনায় অতি  তুচ্ছ, অতি সাধারণ লোক। তুমি সেলিব্রিটি হয়ে আমাদের সঙ্গে মিশছো। কজন সেলিব্রিটি মিশবে এভাবে?
ত-তাহলে মনে করছো তোমাদের সঙ্গে নেটে যোগাযোগ করি, আড্ডা দিই, যেটা তুমি এবং আমি জানি না, কিন্তু কাগজওয়ালারা জানে?
শ-কাগজের লোকেরা অনেককিছু জানে।
ত-তাহলে এটাও, এই কনটাক্টের ব্যাপারটাও. তোমার মনে হচ্ছে ঠিক লিখেছে?
শ-আনন্দবাজার কেন ঠিক লিখবে না?
ত-এরকম হতে পারে না যে ওরা ভুল লিখেছে?
শ-আনন্দবাজার?
ত-হ্যাঁ আনন্দবাজার।
শ-জানি আনন্দবাজারের ওপর তোমার অনেক রাগ আছে.. ।
ত-কেন ভাবছো আমি রেগে বলছি এসব কথা?  আমার কথায় তুমি কোনও যুক্তি পাচ্ছো না?   বন্ধুরা-   চেনা পরিচিতরা সবাই বলে, আমি যোগোযোগ করি না। আমিও জানি আমি যোগাযোগ করি না। সেখানে যে ওভাবে লিখে দিল, আমি বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করি সারাক্ষণ, তাতে তোমার মনে হয়না ওরা  একটা ভুল তথ্য ছাপিয়েছে? নাকি  যেহেতু এটা ছাপার অক্ষরে দেখেছো. তাই তুমি বিশ্বাস করছো, ওরা যা লিখেছে, সেটাই ধ্রুব সত্য, আর আমি যা জানি, তুমি যা জানো, আমি যা দেখছি, তুমি যা দেখেছো, সব মিথ্যে, ভুল?


ফোন রেখে দিয়ে অন্য এক বন্ধুকে ফোন করলাম।
ফোন করতেই ও বললো, সূর্য কি পশ্চিমদিকে উঠলো?
ত-কেন?
প-আমাকে ফোন করলে! তুমি তো ফোন করো না তাই বললাম।
ত-আজকের আনন্দবাজার পড়েছো?
প-হ্যাঁ পড়েছি। তোমার অংশটুকু বেশ লাগলো কিন্তু।
ত-কেন বেশ লাগলো? কী লিখেছে?
প-লিখেছে বেশ আছো।
ত-বয়সের কথা  কী লিখেছে?
প-বয়স বাহান্ন।
ত-কী করে? তুমি তো জানতে আমি পঞ্চাশ। তাই না?
প-পঞ্চাশ নয়। বাহান্ন।
ত-কেন? বাহান্ন কেন?
প-আনন্দবাহার তো  বাহান্নই  লিখেছে।
ত-তুমি তো আমার পঞ্চাশ পালন করতে এসেছিলে, তাই না? আবার একান্ন পালন করতেও আসবে বলেছো, তাহলে বয়স আমার কী করে বাহান্ন হলো?
প-ছাড়ো তো, পঞ্চাশ আর বাহান্ন, একই জিনিস।
ত-কিন্তু একই জিনিস তো নয়! তোমার কি বাহান্ন শব্দটা পড়ে একটুও অবাক লাগেনি?
প-কই না তো!
ত-কেন?
প-কেন অবাক লাগবে। অবাকের কী আছে?
ত-কাগজে   ভুল লিখেছে বলে মনে হয়নি?
প-কাগজে কেন ভুল লিখবে?  আমি তো কোনও কারণ দেখছি না। তোমার বয়স ভুল লেখার পেছনে কাগজের কী স্বার্থ?
ত-তুমি তাহলে মনে করছো, যেহেতু আমার বয়স ভুল লেখার পেছনে ওদের কোনও স্বার্থ নেই, তাহলে যে বয়সটাই লিখেছে, সেটাই ঠিক বয়স?
প-হ্যাঁ। কেন? ঠিক নেই?

এর মধ্যে অন্য এক  বন্ধু  ফোন করলো। কলকাতা থেকেই।
ত-এই, আমার বয়স নাকি আজ আনন্দবাজারে বাহান্ন লিখেছে?
স-হ্যাঁ তাই তো পড়লাম। আমি তো জানতাম পঞ্চাশ।
ত-তারপর?
স-কবে এদিকে বাহান্ন হয়ে বসে আছো, সে খবর তো জানি না।
ত-তোমার হাতের কাছে আমার কোনও বই আছে?
স-ঠিক হাতের কাছে নেই। পাশের ঘরে যেতে হবে। ওখানে আছে।
ত-যাও ওখানে। একটা বই নিয়ে খোলো তো।
স-যাচ্ছি।
ত-বই খোলো। কী লেখা আছে?
স-লেখা তো জন্মসাল ২৫ আগস্ট,  ১৯৬২.
ত-গোনো এখন। কত দাঁড়ায় বয়স?
স-(গোনার পর) দাঁড়ায় তো পঞ্চাশ।
ত-তাহলে কেন বলছো, বাহান্ন হয়ে গেছি।
স-কারণ কাগজ তো ভুল করে না।
ত-কাগজে কখনো কোনও মিসইনফরমেশন পাওনি? ভুল সংবাদ পড়োনি?
স-আমি তো বুঝতে পারছি না ভুল টা কেন করবে ওরা। ইনটেনশ্যানালি করেছে বলতে চাও?
ত-ইচ্ছে করে করেনি। ধরো, ভুল করেছে। হতে পারে না? ভেবেছে আমার বাহান্ন। কোথাও চেক করে দেখেনি ঠিক আছে কি না।  হতে পারে না?
স-ওরা ভুল করেছে? কেন করবে?
ত-যেহেতু তুমি বুঝতে পারছো না ভুল টা কেন করবে ওরা, তাই ওরা কোনও ভুল করেনি!
স-সম্ভবত কাগজের অন্য কোনও হিসেব আছে
ত-হিসেব? যেমন?
স-যে বয়সে পা দিলে তুমি, সেটা হয়তো কাউন্ট করে না, যে বয়সে পা দেবে সেটা কাউণ্ট করে।
ত-মানে ভবিষ্যতের বয়সটা?
স-ধরো তাই।
ত-মানে আমি একান্ন হবো, সেই ভবিষ্যতের বয়সটাই আমার বয়স?
স-হ্যাঁ।
ত-ঠিক আছে, তাহলে তো আমি একান্ন হবো, বাহান্ন আসে কোত্থেকে।
স-একান্নয় আর বাহান্নয় খুব কি আর পার্থক্য আছে?
ত-তাহলে তুমি মনে করছো, ভবিষ্যতের যে বয়সটা আমার হতে যাচ্ছে, সেটা এখনই দিয়ে রাখলে কোনও অসুবিধে নেই!
স-অসুবিধে কেন?
এরপর আমি আর তর্কে যাইনি।
এ কিছুই নয়। মানুষ ছাপার অক্ষরকে  কী রকম বিশ্বাস করে তার একটা বড় অস্বস্তিকর ঘটনার সাক্ষী আমি।    আমি তখন গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। সেসময় বেশ কয়েকজন বন্ধু আর আত্মীয় আমার বাড়িতে এসেছিল।  কেউ কোথাও যাইনি সারাদিন। সবাই সারাদিন বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া, চা,  আডডা,   ছবি   এসবই হয়েছে দিনভর, রাতভর। পরদিন সকালে  পত্রিকা এলো, ওতে লেখা, কাল আমাকে নদীর  ধারে লাল শাড়ি পরে আনমনে  হাঁটতে দেখা গেছে একা একা।  আমি দুদিন যাবৎ ঘরে একটা নীল টী সার্ট আর সাদা একটা শর্টস পরে ছিলাম। সবার চোখের সামনেই। সবাই জানে কাল আমি কোথাও বেরোইনি। শুধু কাল কেন, গত দুমাস আমাকে ঘর থেকে বেরোতে দিচ্ছে না সরকার। দিচ্ছে না বলেই, আমার বেরোনোর অনুমতি নেই বলেই বন্ধুরা আমাকে সঙ্গ দিতে এসেছে।   কিন্তু খবরের কাগজের ওই লেখাটা পরে সবাই এর ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো--
   বাইরে কখন গেছে, জানতেই পারলাম না আমি। এই তুই দেখেছিস?
 আমি দেখিনি।
 তাহলে দেখেছে কে?
 তুমি জানো?
 আমি তো দেখিনি।
 ব কে জিজ্ঞেস করো তো, ব দেখেছে?
 না, আমি তো দেখিনি। দরজা তো আমিই ভেতর থেকে তালা দিয়ে রেখেছি। চাবি আমার ব্যাগে,     আলমারিতে।
 আলমারির চাবি কার কাছে?
 ওটিও আমার কাছে।
  ব কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
 আমি তো রাত দুটোয় শুতে গেলাম।
  না না তাহলে নয়। কাগজে লিখেছে বিকেলে।
 বিকেলে কী করছিলে?
 বিকেলে তো সবাই ছবি দেখছিলাম।
 ওই সময় কী করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গেল, টেরও পাইনি।
 ছবিটা যখন চলছিল। একবার দেখেছিলাম বারান্দায় গেল।
 বারান্দায় নয়, বাথরুমে গিয়েছিল। ও বেরোলে আমি গেলাম।
 বাথরুম থেকেই কি চলে গিয়েছিল?
 বাথরুম থেকে তো ঘরে এসেছিল ছবি দেখতে।
 শাড়িটা কোন ঘরে পরেছে। টেরই পেলাম না।
 লাল শাড়ি আবার কবে কিনলো, ওর কোনও লাল শাড়ি নেই তো। কোনওদিন দেখিনি।
 হয়তো কিনেছে এর মধ্যে।
 কালই তো আলমারি খুলেছিল। শাড়িগুলো দেখলাম সব।
 হয়তো আমরা জানি না লাল  শাড়ির খবর। অন্য কোথাও ছিল হয়তো।
 কোথায় থাকবে শাড়ি।
 আজকাল তো শাড়ি টাড়ি পরে না।
 অথচ দেখ, কাল শাড়ি পরে বেরোলো। কে বললো পরে না। ঠিকই পরে।
 কোথায় শাড়িটা পরলো ভাবছি।
 কোনও ঘরে নিশ্চয়ই পরেছে।
 হয়তো বাথরুমে।
 কিন্তু বাথরুমে তো একবারই গিয়েছিল। বেরোলো যখন, তখন তো শর্টসই ছিল পরনে।
 এর মধ্যেই বেরিয়ে গেছে আমরা কেউ বুঝতেই পারিনি।
 কাউকে বললো না? কী আশ্চর্য!
 আলমারির চাবিটা যে কী করে নিল! দেখ, কাউকে কিছু বললো না। বললে কী হতো?
 লুকিয়ে যাওয়ার কী ছিল, আমাদের কেউ  তো সঙ্গে যেতে পারতাম।

সবাই যখন আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, বিশ্বাস করছে,  কোনও প্রমাণ নেই বাইরে বেরোবার, তারপরও বিশ্বাস করছে, বাড়িতে ছিলাম তার সমস্ত প্রমাণ থাকার পরও করছে,  আমি জিজ্ঞেস করলাম, --তোমাদের কারো কি  একবারও মনে হচ্ছে না কাগজ ভুল লিখেছে? তোমরা সবাই জানো, কাল সারাদিন আমি তোমাদের সঙ্গেই এখানে ছিলাম, রাতে তোমাদের সামনেই ঘুমিয়েছি। তোমাদের কেউ দেখনি আমাকে বাড়ি থেকে  বেরোতে। দেখনি, কারণ আমি বেরোইনি। তাহলে কেন মনে হচ্ছে না কাগজের লোকেরা কিছু ভুল করেছে?
না কারও এরকম মনে হচ্ছে না যে কাগজে ভুল লিখেছে।  কারণ কাগজে ছাপার অক্ষরে লেখা আছে যে আমি কাল নদীর ধারে   আনমনে হেঁটেছি,  সুতরাং এ মিথ্যে হতে পারে না। বাড়িতে এতগুলো মানুষ থাকা সত্ত্বেও, সবার চোখের সামনে রক্তমাংসের আমি ছোট একটা তিনরুমের ফ্ল্যাটে সারাদিন  কাটালেও, আমার বাইরে যাওয়ার কোনও প্রমাণ না থাকলেও  ওদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমি বাইরে গিয়েছি,   নদীর ধারে হেঁটেছি।
কেউ বিশ্বাস করে না    কোনও বড় পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে কিছু লেখা ছাপা হলে সেই লেখা কখনও ভুল হতে পারে। ওরা জলজ্যান্ত আমাকে অস্বীকার করে, ওরা ওদের চোখকে অস্বীকার করে, কিন্তু কাগজের মিথ্যেকে সত্য বলে মানে। আমি যাদের কথা বলছি, তারা সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ। তারা আছে বলেই সম্ভবত মিডিয়া আছে।

যার কেউ নেই তার নাকি ভগবান আছে। এই মিডলক্লাস মিডিওকারদের জন্য মিডিয়াই ভগবান। ভগবান কি কখনও ভুল করতে পারে! ভুল মানুষ করে।

তসলিমা নাসরিনের মুক্তচিন্তা ব্লগ থেকে

No comments

Powered by Blogger.