মহাজোট সরকারের যত ভুল by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পদে পদে ভুল করেছে। দুই বছরের ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন সেনা সমর্থিত জরুরি সরকারের কর্মকাণ্ড থেকে যেমন মহাজোট নেতারা শিক্ষা গ্রহণ করেননি, তেমনি সরকার পরিচালনায় এসে নিজেদের করা ভুল থেকেও তারা শিক্ষা নেননি। সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের ভাষায়, জরুরি সরকারের আমলে তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নকারী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে জেলে আটক ও তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ধীর গতির বিষ প্রয়োগকারী’ ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনদের আইনের আওতায় না এনে বা জিজ্ঞাসাবাদ না করে ছাড় দেয়াকে জনগণ ভালো চোখে দেখেননি। এর পরিবর্তে ওই অসাংবিধানিক সরকারের মূল আর্কিটেক্টদের একজনকে রাষ্ট্রদূত পদে তিনবার এক্সটেনশন দেয়াকে তারা সন্দেহের চোখে দেখেছেন। এ রকম কর্মকাণ্ডের ফলে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের সন্দেহ বেড়েছে। তারা মনে করেছেন, নবম সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের বিশাল বিজয়ের পেছনে হয়তো আওয়ামী লীগের সঙ্গে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন সরকারের অঘোষিত অদৃশ্য বোঝাপড়া ছিল। তা না হলে ওই অন্যায়, নির্যাতন ও বিষ প্রয়োগকারী অবৈধ সরকারের ওপর শাস্তিমূলক অ্যাকশন না নিয়ে আওয়ামী লীগের মতো একটি আক্রমণপ্রিয় দলের গভীর সহনশীল আচরণের রহস্য কী? সরকারের উচিত ছিল ক্ষমতায় আসার পর ওই সরকারকে হালকাভাবে হলেও, বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দিতে পারুক বা না পারুক, তিরস্কার করা এবং জনগণকে এ ধারণা দেয়া যে, ওই অসাংবিধানিক সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সমঝোতা ছিল না। কিন্তু সরকার তা করতে ব্যর্থ হওয়ায় জনমনে সৃষ্ট সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে এবং সরকারের এ ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর বিরক্ত হয়েছে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকার আরেকটি বড় ভুল করে। যোগ্যতার সঙ্গে আপস করে, পরীক্ষিত অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ নেতাদের কোণঠাসা করে অনেক অযোগ্য ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়। তোফায়েল, জলিল, রাজ্জাকদের মতো সুযোগ্য ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতাদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না দিয়ে তাদের দলে কোণঠাসা করে রাখায় মন্ত্রিসভা যেমন শক্তিশালী হয়নি, তেমনি দলীয় সাংগঠনিক তৎপরতাও গতি পায়নি। দলে ও সরকারে বামদের প্রাধান্য দেয়ায় দলের তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া স্বল্প যোগ্য মন্ত্রিসভার মাথার ওপর সাত সাতজন অনির্বাচিত সুশিক্ষিত উপদেষ্টা বসিয়ে কাজ করাবার কৌশল উল্লেযোগ্যসংখ্যক মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা-মন্ত্রী দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ব্যর্থ হয়। এসব উপদেষ্টা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ না হওয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে জনগণের নাড়ির স্পন্দন পড়তে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এ দেশে জনগণের মধ্যে একটি ভারতবিরোধী চেতনা কাজ করে জেনেও একজন উপদেষ্টা ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিনিময়ে ফি চাইলে অসভ্যতা হবে মন্তব্য করে দেশপ্রেমিক নাগরিদের বিক্ষুব্ধ করেন। আরেকজন উপদেষ্টা কমিউনিটি ক্লিনিকে ১৩ হাজার ৩৫০ জন কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে দলের পরীক্ষিত কর্মী ছাড়া কাউকে চাকরি দেয়া হবে না মন্তব্য করে গরিব চাকরিপ্রার্থীদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেন। উপদেষ্টাদের কর্মকাণ্ড দেখে বলা যায়, গণবিচ্ছিন্ন, অনির্বাচিত উপদেষ্টা নিয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের প্রাধান্য দেয়া সরকারের জন্য ছিল বড় ভুল।
গণতান্ত্রিক সরকারের স্বচ্ছতার নীতিকে জলাঞ্জলি দেয়ায় সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর রুষ্ট হন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ডিসিসি নির্বাচন না দিয়ে সরকার আরেকটি ভুল করে। ওই সময় নির্বাচন দিলে সরকার সমর্থিত প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দেরি করতে করতে এখন সরকার এ নির্বাচন করে যেতে পারে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নির্বাচনী প্রতিশ্র“তিতে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিদের আয়-ব্যয়ের হিসাব গ্রহণ ও প্রকাশের ওয়াদা ভঙ্গ করে সরকার নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়ে ভুল করে। এছাড়া প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে জাতীয় সংসদে আলোচনা না করে বা জনগণকে না জানিয়ে চুক্তি করার বিষয়গুলো সাধারণ মানুষ সরকারের অস্বচ্ছতার নমুনা হিসেবেই বিবেচনা করেন। এর সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের অনুরোধ উপেক্ষা করে বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করায় এবং ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ভর্তিবাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে সরকার দুর্নীতি দমনের ওয়াদা থেকে সরে এসে সরকারি কাজকর্মে অস্বচ্ছতাকে প্রশ্রয় দেয়ায় জনগণ বিরক্ত হন। পিলখানার বিজিবি হেডকোয়ার্টারে রেলওয়ের নিয়োগ দুর্নীতির বস্তাভরা টাকা ধরা পড়ার পর ওই দুর্নীতির অভিযোগের তীর রেলমন্ত্রীর দিকে নিক্ষেপিত হয়। ওই ঘটনার প্রধান সাক্ষী মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িচালক আলী আজমের টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে আবারও তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রিত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করায় জনগণ কিছুটা অবাক হয়ে বুকের মধ্যে সে ক্ষোভ পুষে রাখেন।
দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট করে সাধারণ মানুষের টাকা লুটকারী এবং শেয়ারবাজারের ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগারীর পুঁজি আÍসাৎকারীদের ছাড় দিয়ে সরকার ভেবেছিল, সময়ের বিবর্তনে এসব ঘটনা জনগণ ক্রমান্বয়ে ভুলে যাবে। সরকারের এ ভাবনা ছিল বড় রকমের ভুল। সরকারের মনে রাখা উচিত ছিল, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এমন একটা বিষয়, যা সব মানুষকে স্পর্শ করে। একইভাবে শেয়ারবাজারের পরিকল্পিত লুটেরাদের তদন্ত কমিটির মাধ্যমে চিহ্নিত করেও তাদের শাস্তি না দিয়ে এর পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাধাগ্রস্ত করার মলম লাগিয়ে সে বেদনা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলে তা ব্যর্থ হয়। শেয়ারবাজার লুটকারীদের বিচার তো সরকার করেইনি; উপরন্তু অর্থমন্ত্রীর এ বিষয়ে দেয়া আপত্তিকর বক্তব্য ছিল পুঁজি হারানো নিঃস্ব বিনিয়োগারীদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার শামিল। সরকার যদি ভেবে থাকে, পুঁজি হারানো নিঃস্ব মানুষদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলে ব্যালট হাতে পেলে তারা ওই যন্ত্রণার প্রতিশোধ নেবেন না, তাহলে তা হবে বড় রকমের ভুল। সরকার একই রকম ভুল করে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেলবিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি নেতিবাচক আচরণ করে। প্রতিবেশী দেশের নোবেলবিজয়ী প্রফেসরকে অধিক সম্মান দিয়ে স্বদেশী ইউনূসকে অবজ্ঞা করার বিষয়টি সাধারণ মানুষ পছন্দ করেননি। গ্রামীণ ব্যাংককে টুকরো টুকরো করার চেষ্টা করার আগে সরকারের ভাবা উচিত ছিল, ব্যাংকটির যে ৮৪ লাখ ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা রয়েছেন, তারা সবাই ভোটার। ওই বিষয়টি মাথায় না রেখে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বড় রকমের ভুল।
নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে মনোযোগ না দেয়া ছিল সরকারের আরেকটি ভুল। সরকার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে যতটা মনোযোগ দেয়, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দেয় বিরোধীদলীয় সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে। যুগপৎ সংসদে ও সংসদের বাইরে বিরোধী দলকে প্রতিবাদ করতে না দেয়ার নীতি গ্রহণ করে সরকার ভুল করে। একপর্যায়ে রোডমার্চ করতে দিলেও পরে বিরোধী দলকে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করে বাধা প্রদান করে। বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমনে হামলা-মামলা, ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশি নির্যাতনের আশ্রয় নেয়া ছিল সরকারের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত। বিএনপি অফিসে প্রবেশ করে দলীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের পাইকারি হারে গ্রেফতার করা এবং লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাদের কারাগারে আটকে রাখা সাধারণ মানুষ পছন্দ করেননি। সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের মামলাগুলোকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা অভিহিত করে ওইসব মামলা পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের একই চরিত্রসম্পন্ন মামলাগুলো জিইয়ে রেখে তাদের বিরুদ্ধে আরও নতুন মামলা রুজু করার ঘটনাকে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে বিবেচনা করে সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচাতে গিয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ার বিষয়টি কেবল স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণকেই প্রায় অসম্ভব করে তোলেনি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করেছে, যা সরকারের ওপর জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে। ওই সময় উল্লিখিত মন্ত্রীকে দুদক কর্তৃক দ্রুত স্বচ্ছতার সনদপত্র দেয়াকে সাধারণ মানুষ নিন্দা করেছেন। ভালো চোখে দেখেননি বিশ্বজিৎকে চাপাতির আঘাতে হত্যা করার ভিডিও ফুটেজ দেখার পর ওই ঘটনার মামলা ও বিচারের শ্লথগতিকে। লিমনের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে র‌্যাবের গুলি করার ঘটনা এবং পরে ওই অসহায় কিশোরের সঙ্গে সরকারের আচরণ লক্ষ্য করে সাধারণ মানুষ সরকারকে ধিক্কার জানায়। সরকার অনেক দেরি করে গণমানুষের এ সংক্রান্ত ক্ষোভ অনুধাবন করতে পারে এবং সম্প্রতি লিমনের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, গাধার মতো ঘোলা করে পানি খাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল কি? অসহায় কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রয়োজন ছিল কি? দু’-একজন র‌্যাব সদস্য যদি অন্যায় করে থাকে এবং সে জন্য যদি তাদের আইনের আওতায় আনা হতো, তাহলে সরকারের কতটা জনপ্রিয়তা বাড়ত, সে বিষয়টি সময়মতো ভেবে না দেখে সরকার আরেকটি ভুল করে।
ধর্মের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং তা এ দেশের রাজনীতিতে খুবই সক্রিয় জেনেও সরকার শাহবাগের গণজারণ মঞ্চকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে ব্লগারদের পক্ষাবলম্বন করে তাদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করার যে প্রচেষ্টা গ্রহণ করে, শেষ পর্যন্ত তা সামাল দিতে পারেনি। নির্দলীয় এ অরাজনৈতিক আন্দোলনটি সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করলে এ আন্দোলনে ক্রমান্বয়ে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা হ্রাস পেতে থাকে। মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে শুরু করা এ আন্দোলন জনগণের প্রাথমিক সমর্থন পেলেও পরে প্রজš§ চত্বরের নেতৃত্ব সাধারণ ব্লগারদের হস্তচ্যুত হওয়ায়, বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগেই বিচারের রায়কেন্দ্রিক স্লোগান দেয়ায়, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্বকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায়, খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধাকে ‘নব্য রাজাকার’ বলায়, পত্রিকা সম্পাদককে গ্রেফতার করতে সময় বেঁধে দিয়ে বিশেষ পত্রিকা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করার দাবি তোলায় এবং সাধারণ ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের কাছে টানার পরিবর্তে আন্দোলনে জড়িত ব্লগারদের কেউ কেউ আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি কটূক্তি করায় ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হন। সরকার তিন স্তরের নিরাপত্তা, সিসিটিভি ক্যামেরা এবং পোশাকধারী বাহিনীর সমর্থন দিলেও গণজাগরণ মঞ্চ তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। কিছু ব্লগারের ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেম-ওলামাদের সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। কাজেই গণজাগরণ মঞ্চকে সমর্থন দিয়ে ওই মঞ্চ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সরকারি কৌশলও ভুল ছিল বলে প্রমাণিত হয়। সাধারণ মানুষ যে গণজাগরণ মঞ্চকে গ্রহণ করেনি, তা সরকার অনেক দেরিতে বুঝতে পারে। সে জন্য ১৫ জুনের চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং ৬ জুলাইয়ের গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভালো করার জন্য সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও গণজাগরণ মঞ্চকে ব্যবহার করেনি।
অন্যদিকে আলেম-ওলামাদের সংগঠন হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার শাপলা চত্বরে তাদের ৫ মে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে পরে তাদের বিরুদ্ধে গভীর রাতে বাতি নিভিয়ে যে নির্দয় আচরণ করে, তা ছিল আরও বড় ভুল। এ রকম চূড়ান্ত নির্দয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এ ঘটনার রাজনৈতিক পরিণামের কথা বিবেচনা করা উচিত ছিল সরকারের। কিন্তু সরকার সে বিবেচনা তো করেইনি, পরিবর্তে এ ঘটনার পর সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ‘শাপলা চত্বরে ৫ মে দিবাগত রাতে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে কোনো গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি, হেফাজত কর্মীরা গায়ে রঙ মেখে রাস্তায় পড়েছিল এবং পুলিশ টান দেয়ার পর লাশ দৌড় মারল’ এবং সুরঞ্জিতের ‘হেফাজত কর্মীদের সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ বলতে বলতে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া’র মতো উপহাসমূলক বক্তব্য ছিল আলেম-ওলামাদের শরীরে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার শামিল। হেফাজতকে আক্রমণ করে হটিয়ে দেয়ার পর সরকারের অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থককে ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেলেও এর কয়েকদিন পরই তারা বুঝতে পারেন, রাজনৈতিক মুনাফার দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। এ কারণে চার সিটি এবং গাসিক নির্বাচনে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা হেফাজতের সমর্থন লাভে সমর্থ হননি। বিশেষ করে হেফাজতের ভোটব্যাংকের কথা চিন্তা করে গাসিক নির্বাচনের আগে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও হেফাজতের সমর্থন পাননি সরকার সমর্থিত প্রার্থী।
সামনে সরকারের আরেটি বড় ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে। তা হল তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় থেকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন। এমন সিদ্ধান্ত যে দেশের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ গ্রহণ করবেন না, সে বিষয়টি জেনেও সরকার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এ কাজ করলে তা হবে বড় একটি ভুল। এ ভুল করলে সরকারকে চড়া মূল্য দিতে হবে বলে রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সাড়ে চার বছরে সরকারের যে কোনো সাফল্যের দিক নেই, এমন নয়। কিন্তু অসংখ্য ভুলের চাপে সামান্য সাফল্য থাকলেও তা ম্লান হয়ে গেছে। সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে এত ভুল করলে সে ভুলের খেসারত তো দিতেই হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চার সিটি ও গাসিক নির্বাচন থেকে সরকারের ভুলের মাশুল দেয়া শুরু হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.