তত্ত্বাবধায়ক সরকারই কি সমাধান?

রধান বিরোধী দল বিএনপি যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তখন সেই পটভূমিতে এ ইস্যু নিয়ে কলাম লেখার কথা ভাবছিলাম কদিন ধরে। এমন সময় প্রথম আলো আয়োজিত একটি জনমত জরিপের ফলাফলে দেখছি, দেশের ৯০ ভাগ মানুষই তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধ ও সংঘাত বন্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবিধান হতে পারে। কিন্তু এটা যে বিগত দুই দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা-সংঘাতময় বাস্তবতার স্থায়ী সমাধান নয়, সে তো বাংলাদেশের মানুষের না জানার কথা নয়। কারণ, ইতিপূর্বে অন্তত চারবার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন হয়েছে। সরকারগুলোর গঠন ও ধরনে রকমফের থাকলেও এগুলো সবই ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
প্রথমবার অর্থাৎ ১৯৯১ সালের নির্বাচন ছিল স্বৈরাচার পতনের পর প্রথম নির্বাচন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসন শুরু হওয়ার পরে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। এভাবে চারবারের নির্বাচনে প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অদলবদল করে ক্ষমতায় এসেছে বা ক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু কথা হলো, এতে কি আমাদের রাজনীতি থেকে অস্থিরতা, বিরোধ ও সংঘাতের প্রবণতা দূর হয়েছে? সংসদ কি কোনোবার দুই দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে চলেছে? বিরোধী দলের সংসদ বর্জন কি বন্ধ হয়েছিল? বিজয়ী দলের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার তথা ভোগদখল, লুটপাটের প্রবণতা বন্ধ হয়েছিল? সরকারের দায়বদ্ধতা-জবাবদিহি কি চালু হয়েছিল? দলীয়করণ কি অব্যাহত ছিল না? আমরা জানি, এ তালিকা আরও বাড়ানো যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনলে এবার কি পরিস্থিতির গুণগত উন্নতি হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা আছে? আমরা সবাই জানি, উত্তরটা কী হবে। এ-ও আমরা জানি, সমাজ ও জাতির ক্রিটিক্যাল ইস্যুগুলোর কোনো সরল সমাধান নেই। যে সমস্যার আবর্তে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে, তার সমাধান অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়; বরং এটা জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়, মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত প্রত্যাশার জন্ম দেয়। বড় দুই দলের মধ্যে তো বটেই, সম্ভব হলে সর্বদলীয় রাজনৈতিক সংলাপ সব সময় প্রয়োজন, কিন্তু যা শুধু নির্বাচনকালীন সরকারে সীমাবদ্ধ থাকলে দেশ রাজনৈতিকভাবে খুব বেশি লাভবান হবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণ—সমাজের সব সংগঠন-প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বের পরিবর্তে প্রতিনিধিত্বশীল যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আমাদের অপারগতা। এ থেকে শুরু হয় একদিকে ব্যক্তি ও তার পছন্দের গোষ্ঠীর দখলদারি, বাকিদের জন্য কিছু পাওয়ার লক্ষ্যে তোষামোদ ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ; অন্যদিকে তৈরি হয় অপ্রাপ্তি-বঞ্চনা-নির্যাতনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা এবং তা প্রতিবিধানে চাটুকারিতা ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া। অর্থাৎ দুদিক থেকেই নেতা ভিন্ন বাকিদের বাঁচতে হলে তোষামোদ ও দুর্নীতির পথ ধরতে হয়। আসলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি এবং ক্ষমতার ব্যবহার ও প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতাই হলো সুশাসনের মূল ভিত্তি। নির্দলীয় কথাটি বাহুল্য। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবাইকেই ভোট দিতে হয় এবং দিলে কোনো দলের প্রার্থীকেই দিতে হয়। তবে শাসনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার উপজীব্য হলো আইনের শাসন। দলের নয়, দল বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় গিয়ে আইনের শাসন বজায় রাখবে, এটাই কাম্য। আমাদের দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাব হয়নি, কিন্তু সুশাসনের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সুশাসন ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি মাকাল ফল, জনগণকে প্রকৃত সুফল কিছুতেই দিতে পারে না। এ অবস্থায় আমাদের জন্য যে ইস্যুগুলো জরুরি ও জোরালোভাবে তোলা প্রয়োজন সেগুলোর একটি তালিকা করা যাক—
১. প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক গতিশীল ব্যবস্থার বিধান।
২. সংসদের সব কার্যক্রমে সরকারি ও বিরোধী দলের অংশীদারির মাধ্যমে সংসদকে কার্যকর করা।
৩. নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা।
৪. দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা।
৫. স্থানীয় সরকারগুলোকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করে সচল করা।
৬. সর্বস্তরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
৭. গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
এসব ক্ষেত্রে লোক দেখানোর বেশি সত্যিকারের সংস্কার না করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে  ক্ষমতার অদলবদলের খেলা চালিয়ে গেলে এটা গণতন্ত্রকে কেবল তামাশায় পরিণত করবে না, তার অবক্ষয়ও ঘটাবে। আমরা দেখেছি, দীর্ঘদিনের এই অচল ব্যবস্থা চলতে চলতে দুই বড় দলকে ঘিরে দেশে দূষিত দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতার রাজনীতির কায়েমি স্বার্থ তৈরি হচ্ছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই দূষণ-দুর্নীতি পাচার হয়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেদিকে আমাদের ‘জয়যাত্রা’ শিখরের কাছাকাছি পৌঁছেছে। জরিপের ফলাফলে জামায়াত নিষিদ্ধ করা বিষয়ে যেমন তেমনই গণজাগরণ মঞ্চের ব্যাপারেও না ভোট বেশি এসেছে। এ দুটিকে পরস্পরবিরোধী দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হিসেবে ধরে নিয়ে সমাজপ্রগতি এবং জনমানসের অগ্রগতির ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে এটিও একটি জটিল কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। এবং এটিও এ রকম হ্যাঁ/না ভোটের মতো সরল মতামতের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছার বিষয় নয়। বাংলাদেশের সমাজের, বিশেষত বাঙালি মুসলিম সমাজের (বস্তুত প্রায় সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজের) অর্থাৎ ব্যাপকভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এই দেশের পশ্চাৎপদতার একটি বড় কারণ রেনেসাঁস-উত্তর জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার ধারণাগুলোর সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক সমন্বয় সাধনে অনীহা ও ব্যর্থতা। ফলে গণতন্ত্র চাই আমরা কিন্তু অসাম্প্রদায়িক হতে পারি না, ধর্মনিরপেক্ষতাকে মানতে পারি না তবে আধুনিক শিক্ষা চাই কিন্তু বিজ্ঞানের অনেক মৌল বিষয় মানি না বা এ সম্পর্কে নিরুত্তর থাকি, একটি সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের কথা বলি কিন্তু নারীর অধিকার মানতে চাই না, মুখস্থবিদ্যার দুর্বলতা বুঝি কিন্তু জিজ্ঞাসু তারুণ্যের নিন্দা জানাই। এ সমাজে বারবার মুক্তবুদ্ধির উৎসমুখ খোলার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু রক্ষণশীলদের প্রতিক্রিয়া ও প্রবল প্রত্যাঘাতে সেসব ভেস্তে গেছে। যদিও জ্ঞানের স্ফুলিঙ্গ একবার জ্বললে তার রেশ থেকে যায়, এবং তা সময় ও সুযোগে ঠিকই যুগে যুগে মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। আরব-পারস্যের মুতাজিলা থেকে বাংলাদেশের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন পর্যন্ত বিষয়টি এ রকমই। এবার বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি ও ন্যায়ের পক্ষে তারুণ্যের জাগরণ আমরা দেখেছি। তাতে আতিশয্য বা ভুলভ্রান্তি ছিল, কিন্তু সমাজ তাতে নাড়া খেয়েছে এবং বহুকাল পরে শতাব্দীপ্রাচীন জড়তা ও অচলায়তন ভেঙে জেগে ওঠার লক্ষণ ফুটে উঠেছিল। যেমনটা হয়ে থাকে, এর বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী উঠেপড়ে লেগেছিল। তার আলামত আমরা সম্প্রতি দেখছিলাম। আর এখনকার বাস্তবতা অনুযায়ী বড় দুই দল এর পক্ষে-বিপক্ষে গিয়ে তাদের ক্ষমতার রাজনীতির সুবিধা আদায়ের চেষ্টায়ও লিপ্ত ছিল। এখন সমাজের এই পরিবর্তনের প্রয়াসটি নিয়ে জনমত জরিপে রক্ষণশীলতার পক্ষে মতামত বেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেটা এ সমাজের জন্য কাঙ্ক্ষিত পথ কি না, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জরিপ ছাড়াই সবাই জানি যে বৃহত্তর সমাজে এখনো জ্ঞানের সেই আলো প্রবেশ করেনি, যা সব রকম জিজ্ঞাসা কৌতূহল সম্পর্কে সহনশীল হবে। আমরা জানি, ধর্মের নামে ধর্মান্ধতার চর্চা বেড়ে চলেছে, আর তার প্রভাব সমাজে বাড়ছে। এটা সমাজের কেবল দুর্বলতা, গভীর সংকটেরই প্রকাশ ঘটায়। আমরা স্পষ্টতই দেখেছি, হেফাজতে ইসলাম গণজাগরণের চেয়ে বেশি লোক রাজপথে নামাতে পেরেছে। এটিকে সমাজপ্রগতির দৃষ্টিতে সমাজের দুর্বলতা কিংবা বিভ্রান্ত অবস্থার লক্ষণ হিসেবেই দেখা উচিত। পাশাপাশি একে এ দেশের শিক্ষিত সমাজ, গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা হিসেবেও দেখা যায়। এই বিপুলসংখ্যক মানুষ যে অকেজো শিক্ষার মধ্যে পড়ে আছে, সে অবস্থায় শিক্ষিত সমাজ তাদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থেকে আর রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের ক্ষমতার চালের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে দায়িত্বহীনতারই পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। সমাজের সচেতন অংশের দৃষ্টি ফেরানো দরকার তাদের এই অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার প্রতি। এ হলো সমাজের রোগ। রোগগ্রস্ত শরীরের ওপর যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয় অত্যন্ত সাবধানতা ও বিচার-বিবেচনার সঙ্গে, তেমনি একটি রোগগ্রস্ত সমাজের দুর্বল দেহে পরীক্ষা চালাতে সাবধানতা ও সতর্কতা প্রয়োজন। কারণ, এর ফলে যেসব প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যুত্তর আসবে, তা সুস্থ মানসের পরিচয় বহন না করাই স্বাভাবিক। ইংরেজ আমলে বিধবাবিবাহ রদ আইন করার সময় এর বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের ৩৩ হাজার স্বাক্ষরসংবলিত আবেদনের পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে প্রদত্ত আবেদনে এর পক্ষে মাত্র ৯৮৭ জন স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, কারা সঠিক ছিলেন। ইংরেজ সরকারও সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি। এ রকম সিদ্ধান্তের যাথার্থ্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে ইতিহাসে। আমাদের সমাজ যে অবস্থানে আছে, তাতে গণমাধ্যমকে ইতিহাসের গতিপথ, জনগণের কল্যাণ এবং ভবিষ্যতের মঙ্গল ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়। কেননা দারিদ্র্য, কুসংস্কার, অশিক্ষা (ও কুশিক্ষা) মানুষকে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দেয় না, তার ব্যক্তিত্ব দৃঢ় নয় বলে নিরপেক্ষও হয় না। এ রকম বিভ্রান্ত উসকানিতে ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধতা কিংবা ধর্মান্ধ রাষ্ট্র সৃষ্টি করে বাঙালি মুসলমান আত্মঘাতী কাজ আগেও করেছে। আমরা কি ইতিহাস থেকে কিছুতেই শিক্ষা গ্রহণ করব না? শেষে বলব, দর্শনে ও বিজ্ঞানে সত্য জানার পথে একটি প্রহেলিকার মতো বিষয় হলো অ্যাপিয়ারেন্স অ্যান্ড রিয়ালিটি। অর্থাৎ কোনো বস্তু বা বিষয় দেখতে যেমনটা দেখায়, বাস্তবে তা নয়—এমন অনেক কিছুই চতুর্দিকে আছে ও ঘটে। বাস্তব বিষয় থেকে একটা উদাহরণ নেওয়া যাক—আকাশ দেখতে নীল, কিন্তু বিজ্ঞানের সূত্রে আমরা জানি, আদতে আকাশের কোনো রং নেই এবং এ-ও জানি, কেন তা নীল দেখায়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ওসাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.