সবার শান্তি ও কল্যাণহোক

বাংলাদেশ ক্রিশ্চিয়ান সমাজের সবার পক্ষ থেকে দেশবাসীর প্রতি আমাদের আন্তরিক অভিবাদন ও শুভেচ্ছা। বাংলাদেশে ক্রিশ্চিয়ান সমাজ হিসেবে আমরা দেশের আনন্দ ও আশা, দুঃখ ও বেদনার সবকিছুতেই সবার সঙ্গে একাত্ম হয়ে চলেছি। আমরা সর্বদাই আনন্দিত হই, যখন আমাদের প্রিয় দেশ ও দেশবাসীর সম্পর্কে দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্দেশে প্রশংসার কথা শুনে থাকি। ইদানীং ক্রিশ্চিয়ান সর্বোচ্চ ধর্মগুরুরাও আমাদের দেশ ও দেশের সব মানুষের বিষয়ে শুভকথা ব্যক্ত করেছেন এবং শুভ আশীর্বাদ রেখে এসেছেন। আমরাও একই মনোভাব পোষণ করি। দেশের সব মানুষের ব্যাপারে আমাদের শ্রেষ্ঠ গর্ব ও আনন্দ হলো যে, আমাদের দেশের বহু দীন-দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ জীবনের বহুবিধ সংঘাতপূর্ণ বিপর্যয়, ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-কষ্টের মাঝে দৃঢ়চিত্তে ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে মানবীয় জীবনের উন্নত মান বহন ও রক্ষা করে পথ চলেছে ও চলতে সমর্থ; দ্বিতীয়ত, বহু শতাব্দী ধরে এ দেশের মানুষ ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্ম ও অন্যান্য ধর্মীয় কৃষ্টির অনুসারী হয়ে এবং বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে ঐতিহ্যগতভাবে সুদৃঢ় সম্প্রীতি ও শান্তিতে জীবনযাপন করে এসেছে। এর মাঝে দেশের সর্বোচ্চ মান ও মর্যাদা নিহিত হয়ে আছে বহু শতাব্দী ধরে। উপনিবেশীয় যুগ অতিক্রম করে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা লাভে ধর্মীয় গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের ফলে রাষ্ট্রে ধর্মীয় গরিষ্ঠতা ও লঘিষ্ঠতার ভাব প্রবিষ্ট হওয়ায় ধর্মীয়, কৃষ্টিগত ও জাতিগত সম্প্রীতি ও শান্তির বিষয়টি অধিক চ্যালেঞ্জপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা একেক রাষ্ট্র নিজের সামর্থ্য অনুসারে মোকাবিলা করেছে। ১৯৭১-এর স্বাধীনতার চেতনায়, সংগ্রামে ও স্বাধীনতা লাভে আমরা বাংলাদেশে সব ধর্ম, কৃষ্টি ও জাতির মানুষের মাঝে সেই সুপ্রতিষ্ঠিত সম্প্রীতি ও শান্তি সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় আচরণের দিক থেকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করে চলছি। আমাদের জাতিগত আচরণে প্রতিটি ধর্মের মানুষের জন্য নিজ নিজ ধর্ম যথাযথভাবে পালন ও রক্ষা করার কথা সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্তও হয়েছে। এ ধারা চ্যালেঞ্জপূর্ণ, তবে তা লঙ্ঘনীয় বিষয় নয়। প্রতিটি ধর্ম তার যথার্থ ধর্মীয় শিক্ষা ও আচরণ রক্ষা করবে—এই উদ্দেশ্য উত্তম এবং তার জন্য প্রচেষ্টা চালানো সঠিক বিষয়, এবং তা যথার্থভাবে হলে কখনো অন্যের জন্য ক্ষতিকর না হয়ে; বরং অন্তরে মিলন নিয়ে আসে। দেশে দায়িত্বশীল সব রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় ব্যক্তি ও সংগঠন তা মনোযোগসহকারে যেন রক্ষা করে চলে। ইদানীং সার্বিকভাবে ধর্মীয় বিষয়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু ধর্মের অনুসারী, ধর্মীয় স্থান, বস্তু ও স্বাধীনতা ইত্যাদির প্রতি ক্ষতিকারক আচরণ দেখে আমরা চিন্তিত ও ব্যথিত। এসব আমাদের দেশের সর্বব্যাপী সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ জীবনধারার পরিপন্থী। আমরা এসবের অবসান কামনা করি। আমরা আরও মনে করি, নারী-পুরুষের সাম্য, ধর্মবিশ্বাস অনুশীলনের স্বাধীনতা, অন্যের ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ বা আঘাত না করা এবং মতপ্রকাশের অধিকার—এগুলো মূল সংবিধানের ভিত্তি। দেশ ও জাতির অগ্রগতির স্বার্থে এগুলো লালন ও পালন করা নিতান্ত প্রয়োজন। আমাদের একান্ত প্রার্থনা, আমরা যেন সবাই রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি অবস্থানে আমাদের ঐতিহ্যগত সম্প্রীতি ও শান্তি রক্ষা করে চলি। আমাদের দেশের বহু দীন-দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের জন্য জীবনের মান সংরক্ষণ ও উন্নয়নের বিষয়টি মনোযোগে রাখা একান্ত প্রয়োজন। দেশের ও বহির্বিশ্বের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাদের দরিদ্র ও পিছিয়ে থাকা ভাইবোনদের উন্নয়নের পক্ষ নিচ্ছেন দেখে আমরা আশ্বস্ত হই। দেশের পোশাকশিল্পে বিদেশিদের ব্যাপক বিনিয়োগ এবং বিশেষভাবে দরিদ্র যুব ভাইবোনদের কর্মসংস্থান ও জীবনের মানোন্নয়নের বিষয়টি দেশের জন্য আশার আলো হয়ে উঠেছিল। তবে বর্তমানে তা বহুমাত্রিক অন্যায্যতা ও গভীর বেদনার কারণ হয়ে উঠেছে, যা সাম্প্রতিক সাভার ট্র্যাজেডিতে মর্মান্তিক আকারে প্রকাশ পেয়েছে, যা দেশবাসীকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। এ মুহূর্তে এর আশু সমাধানে রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিসকল এবং একই সঙ্গে বহির্বিশ্বের ক্রেতাদের পক্ষ থেকে অধিক মনোযোগী হওয়া ও বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে যে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তার মূল কারণ হলো দেশের রাজনৈতিক শক্তিসমূহের নানা আলোচনা ও কর্মসূচির মধ্যে দেশের দীন-দরিদ্র ও সাধারণ জনগণ কেন্দ্রীয় স্থানে নেই। সব রাজনৈতিক শক্তির মূলে ও কেন্দ্রে যদি সাধারণ মানুষের শুভ শক্তিগুলো, তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিবোধ, আর্থিক জীবনে তাদের কষ্ট-বেদনা, যেমন—শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থা, জনমানুষের কল্যাণ ইত্যাদি গণমানুষের ঐকমত্যের বিষয়গুলো প্রধান ও কেন্দ্রীয় ভাবনা হয়ে আসত, তা হলে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেক সংযত হয়ে ফলপ্রসূ ধারায় চলত বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের দেশ কয়েক বছরের মধ্যে স্বাধীনতার ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের লক্ষ্যে পথ চলছে। দেশের মানুষের সর্বাঙ্গীণ ও সর্বজনের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যগত সম্প্রীতি ও শান্তি এবং আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনের মান সংরক্ষণ। এই সম্পদকে আরও অধিক পরিমাণে সমৃদ্ধ করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ মাথা উন্নত করে চলমান থাকতে পারে। আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও: সিএসসি, ঢাকার আর্চবিশপ, সভাপতি, সম্মিলিত চার্চ ফোরাম, বাংলাদেশ (সিবিসিবি, এনসিসিবি, এনসিএফবি)।

No comments

Powered by Blogger.