হেলিকপ্টার

হেলিকপ্টারে ভ্রমণের যে কী সুখ, তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ না হলে উপভোগ করার সৌভাগ্য আমার মতো বিত্তহীনের হতো না। সে এক বিরল সৌভাগ্য! তবে এখনকার অনেক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা যে ধরনের ফড়িংয়ের মতো হেলিকপ্টারে চড়েন, আমি চড়েছি তার চেয়ে অনেক বড় আকারের হেলিকপ্টারে। নেতা হিসেবে নয়, কর্মী হিসেবে। বুঝতে পারছি না, হেলিকপ্টারে চড়ার স্মৃতি এখন কেন হঠাৎ মনে পড়ছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের নিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। এসে নতুন স্বাধীন দেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যোগাযোগেরব্যবস্থা ছিল বির্পযস্ত। নদী ও সড়কপথে যাতায়াতে দীর্ঘ সময় লাগত। প্রত্যন্ত এলাকায় যাতায়াতের জন্য একমাত্র ভরসা ছিল হেলিকপ্টার। রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সরকার বাংলাদেশকে ত্রাণকাজ পরিচালনার জন্য বেশ কয়েকটি ঢাউস আকারের হেলিকপ্টার দিয়েছিল। সেগুলোতে মালামাল পরিবহন করা যেত। যাত্রী গেলে যেতে পারত ২৫-৩০ জন। ষোলোই ডিসেম্বরের পরে পূর্বাণী হোটেলে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে খোলা হয়েছিল মিডিয়া সেল। সেখানে আমরা যারা যুক্ত ছিলাম, মন্ত্রীদের সফরসঙ্গী হয়েছি ডিসেম্বরের শেষ ও জানুয়ারির প্রথম দিকে। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন স্নেহশীল পারিবারিক মানুষ। কখনো সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনও সঙ্গে থাকতেন, তাঁর মেয়েদের কেউ, এমনকি বন্ধুবান্ধবের ছেলেমেয়েদের কেউ বা তাঁর সঙ্গে যেতেন। এর মধ্যে পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু এলেন। তিনি জেলায় জেলায় যেতেন হেলিকপ্টার বা সি-প্লেনে। সাড়ে তিনটি বছর তাঁদের সঙ্গে হেলিকপ্টার ও ক্ষুদ্রাকৃতি সি-প্লেনে ওড়ার সৌভাগ্য হয়েছে।  এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় জার্নি বাই হেলিকপ্টারের রোমাঞ্চকর অনুভূতি আলাদা। তখন নিজের মধ্যে কাজ করে একধরনের অহংকার। হেলিকপ্টার থেকে দেখা যায়, নিচে মানুষগুলো মাঠেঘাটে কাজ করছে ঘাম ঝরিয়ে। জেলেরা মাছ ধরছে নদী ও খালবিলে। ছেলেমেয়েরা মাঠে কোলাহল করে খেলছে। গ্রামের মেয়েরা নদীতে পানি আনতে যাচ্ছে কলসি কাঁখে। কেউ নিজের খেতের উৎপাদিত পণ্য মাথায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের হাটে। তাদের মাথার ওপর দিয়ে আমি যাচ্ছি উড়ে। সে কি কম আনন্দ ও আহ্লাদের কথা!
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং খুব বড় নেতারাই হেলিকপ্টারে চড়েন, সাধারণ হতভাগ্যরা নয়। সব নেতার হেলিকপ্টারে যাতায়াতে সৌভাগ্য হয় না। বিশ্বের ইতিহাস সৃষ্টিকারী তিন নেতা হলেন মহাত্মা গান্ধী, ভি. আই. লেনিন এবং মাও ঝেদোঙ। তাঁরা যুগান্তকারী গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কোটি কোটি অনুসারীকে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় তাঁরা কেউই হেলিকপ্টারে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সুযোগ পাননি। গান্ধীজি মাটির ওপর দিয়ে মানুষের সঙ্গে চলতেই পছন্দ করতেন। হেলিকপ্টারে চড়া তো দূরের কথা, মাটি থেকে এক ফুট উপরে ওড়ার প্রয়োজন তাঁর হয়নি। ধারে-কাছে হলে যেতেন হেঁটে। দূরে হলে যেকোনো ধরনের গাড়িতে, লঞ্চ, স্টিমার বা ট্রেনে। রেলগাড়িতে যেতেন তৃতীয় শ্রেণীতে। বিশাল সব গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন মওলানা ভাসানী। হেলিকপ্টারের প্রয়োজন হয়নি। পায়ে হেঁটেছেন। নৌকায় যাতায়াতের সুযোগ পেলে খুব খুশি হতেন। ট্রেনের প্রথম শ্রেণীতে খুব কমই যাতায়াত করেছেন। ইসলামি বিপ্লবের আইকন আয়াতুল্লাহ খোমেনিও হেলিকপ্টারে ঘুরে ইরানিদের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাননি। মাটিতে বসেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। রেজা শাহ পাহলবির মতো পরাক্রান্ত শাসককে তাঁর রানিসহ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেন। শাহকে বিতাড়িত করার পরই তিনি নিজে ফিরে আসেন স্বদেশে ফরাসি বিপ্লবীদের দেশ থেকে। ফরাসি বিপ্লবের দেশেই আবিষ্কৃত হয় হেলিকপ্টার প্রথম মহাযুদ্ধের পর। উদ্ভাবকদের সবাই ছিলেন নাসারা, কেউ বা ইহুদি, কেউ নাস্তিক। আমাদের দেশে এখন ট্যাক্সি-মাইক্রোবাসের মতো হেলিকপ্টারও ভাড়ায় পাওয়া যায়। তাই অনেকে বিয়েও করতে যান হেলিকপ্টারে চড়ে। বিপ্লব করতেও যান হেলিকপ্টারে। তবে হেলিকপ্টারের ভাড়াটা খুব বেশি। তাই মনে করি, অত ভাড়া দিয়ে আমাদের মতো মুসলমানদের নাসারাদের তৈরি হেলিকপ্টারে না চড়াই ভালো।

No comments

Powered by Blogger.