চ্যালেঞ্জিং সময়ে হামিদের হাতে রাষ্ট্রের হাল by ইসমাইল হোসেন

সাতবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবার হাল ধরছেন পুরো রাষ্ট্রের। সোমবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেট। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও দেশ চালাতে দুই দফা স্পিকারের দায়িত্বে থাকা হাওরের এই সন্তানকে অনেক কণ্ঠকাকীর্ণ ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে।
নিয়মানুযায়ী, আগামী ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও রোববার নির্ধারিত দিনে আব্দুল হামিদ ছাড়া আর কারো মনোনয়নপত্র জমা না পড়ায় সোমবার সকালে নির্বাচন কমিশন তাকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে।

সোমবার মনোনয়নপত্র বাছাই ও ২৪ এপ্রিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময়ের আগেই আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ আব্দুল হামিদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

রোববার আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির মনোনয়নের পর থেকেই নিশ্চিত ছিল আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকছে না হামিদের। একাধিক প্রার্থী থাকলে ২৯ এপ্রিল ৩৪৯ জন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিতে পারতেন, যাদের মধ্যে ২৭২ জনই আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদে এসেছেন।

দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান গত ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার গত ৯ এপ্রিল এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন।

নির্বাচন কমিশন আব্দুল হামিদকে নতুন রাষ্ট্রপতি ঘোষণার পর এখন তা গেজেট আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা নেবে ইসি সচিবালয়। এরপর বুধবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিকে শপথ বাক্য পাঠন করাবেন প্রধান বিচারপতি।

মো. জিল্লুর রহমানের অসুস্থতায় রাষ্ট্রপতির অস্থায়ী দায়িত্ব পালন করছিলেন আব্দুল হামিদ।

ইসির ঘোষণার পর পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন তা নিয়ে তৈরি হওয়া সব জল্পনা-কল্পনার সফল পরিসমাপ্তি ঘটলেও দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে আব্দুল হামিদকে। কারণ তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রবর্তণ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে এখন মাঠ গরম।

মহাজোট সরকারের চার বছরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে মাঠে নামলেও উল্টো নেতাকর্মীদের গ্রেফতার নিয়ে এখন শঙ্কিত। শীর্ষ নেতারা কারাবন্দী হওয়ায় একাত্তরের বিরোধী শক্তি জামায়াত তাদের অন্যতম রাজনৈতিক মিত্র বিএনপির ঘাড়ে বন্দুক রেখে নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই ভার থেকে রেহাই পাননি বিএনপির শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। হরতাল-আন্দোলনে মাঠ গরমে থাকা বিএনপির তত্ত্বাধায়কের দাবি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হবে আব্দুল হামিদের কাছে, তাও প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। যদিও বিএনপির আশা আব্দুল হামিদ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

এদিকে মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার শুরুর পর বিরোধী জোটের শরিক দল জামায়াত ও তাদের অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবির একের পর এক নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলে আসছেন- সরকারের মেয়াদে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শেষ হবে। এরইমধ্যে রায় হয়েছে তিনটি। এগুলোর মধ্যে একটি আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির পথে। রায় হওয়ার অপেক্ষায় আরও দু’টি, হবে যে কোন দিন।  

এ অবস্থায় মরিয়া হয়ে উঠছে জামায়াত-শিবির। তারা আরো নাশকতা চালাতে পারে বলেও আভাস মিলছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে। সেক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চূড়ান্ত রায় হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা চাওয়ার প্রশ্নেও গুরুত্বপূর্ণ হবেন আব্দুল হামিদ। 

বিএনপি-জামায়াতের ১৮ দলীয় জোটের বাইরে এখন ১৩ দফা নিয়ে মাঠে হেফাজতে ইসলাম। দেশের বর্তমান কাঠামো ব্যবস্থাবিরোধী ১৩ দফা নিয়ে যদিও বার বার নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে হেফাজত, কিন্তু বিএনপি তাদের সমর্থন দিয়ে কতটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে তা নিয়ে নানা সমালোচনার জন্ম হয়েছে। হেফাজতের নারীনীতির বিরোধিতা করেছে তাদের সংসদ সদস্যরাই।

পাশাপাশি আগামী ৫ মে ঢাকা অবরোধের যে ঘোষণা আছে হেফাজতের, তার মধ্যে অনেক পানি গড়িয়ে যাবে বুড়িগঙ্গায়। কারণ এরইমধ্যে সুন্নতে ওয়াল জামাতও আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে হেফাজত ও জামায়াতের বিরুদ্ধে। নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবিও তুলেছে তারা।

চট্টগ্রামের সমাবেশে সুন্নতে ওয়াল ঠিকই দেখিয়েছে তাদের শক্তি-সামর্থ। ২৫ মে রাজধানীতে মহাসমাবেশেরও ডাক দিয়েছে তারা। এছাড়া তরিকত ফেডারেশনও মাঠে আছে নানা দাবিতে।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিয়ে মাঠে থাকা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দাবি আছে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের। এরই একটি আবেদন গেছে রাষ্ট্রপতির কাছে, সেই আবেদন নিয়েও আব্দুল হামিদকে ভাবতে হবে।

১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বর্তমানে ৬৯ বছর বয়সী আবদুল হামিদ। ১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে আবদুল হামিদের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬১ সালে কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে। এক পর্যায়ে তাকে কারাগারেও যেতে হয়।

গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ সাব ডিভিশনে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব নেন আবদুল হামিদ।

১৯৬৬-৬৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ১৯৬৯ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৮ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। এরপর দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে চলতি বছর আব্দুল হামিদ স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ, ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন।

সপ্তম সংসদে ১৯৯৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০০১ এর ১০ জুলাই পর্যন্ত ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালনের পর ২০০১ এর ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত স্পিকার হিসাবে সংসদ পরিচালনা করেন আবদুল হামিদ। আর নবম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো স্পিকার হন তিনি।

জিল্লুর রহমানের অসুস্থতার কারণে গত ১১ মার্চ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান আবদুল হামিদ। সংসদ ভবনে স্পিকারের জন্য বরাদ্দ বাসভবন থেকে বঙ্গভবনে অফিসিয়াল কাজে আসা-যাওয়া করলেও এবার নিয়ম তাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে স্থায়ীভাবে।

জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে সরকারের বাকি সাত মাসের মেয়াদের মধ্যে হেফাজত আর সুন্নতে ওয়ালের দাবি বাস্তবায়ন নিয়ে রাষ্ট্রের অধিপতি আব্দুল হামিদকে বঙ্গভবনে থেকে বেশ বন্ধুর ও কণ্ঠকাকীর্ণ পথই পাড়ি দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.