ধর্মীয় নেতাদের ডাকে নানা মতের লাখো মানুষের চেনাজানা

রাজধানীমুখী এই অভিযাত্রার ডাক দিয়েছিল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী; হেফাজতে ইসলাম। দেশের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে শিক্ষাবিস্তারে নিয়োজিত প্রায় ১৮ হাজার মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই হেফাজতের মূল জনবল বলা চলে।
তবে ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচারের প্রতিবাদসহ ১৩ দফা দাবিতে শনিবারের এই ঢাকা চলোতে দেখা গেলো সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ।

সারা দেশ থেকে ঢাকামুখী ট্রেন-বাস-লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া এবং পথে পথে সরকার সমর্থকদের হামলার কারণে আগ্রহীদের খুব সামান্যই পৌঁছতে পেরেছিলেন রাজধানীর মতিঝিলের সমাবেশে।

হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী বললেন, হুজুরের নির্দেশ ছিলো হামলার মুখেও সহিংস হওয়া যাবে না। জনাব জুনায়েদ, আরটিএনএন-কে জানালেন, এই নির্দেশমতো লংমার্চকারীরা যেখানেই বাধা পেয়েছে সেখানেই প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে। ‘হুজুর’ আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ওই নির্দেশ সবাইকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের সমাবেশেও পালন করতে দেখা গেলো।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল চত্বর ঘিরে দিকে দিকে পাঁচ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই সমাবেশে ছিলেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী জসিম উদ্দীন, গাযী আনোয়ার, মাহবুব আলম তারেক, জাহাঙ্গীর আলম, আরেফিন শাকিল, শামছুজ্জামান নাঈম, আল আমিন ও হাসান মাহমুদ। চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে নিজস্ব প্রতিনিধিদের পাশাপাশি ছিলেন ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি রোমান কবির।

দুপুরের আগেই রাজধানীর প্রেসক্লাব, পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, বঙ্গভবনের সামনে থেকে দিলকুশা হয়ে ইত্তেফাক মোড়, টিকাটুলি, ফকিরাপুল, বিজয়নগর থেকে কাকরাইল পর্যন্ত এলাকার সব রাস্তা, ফুটপাত ও অলিগলি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।

অসংখ্য ছোটো দলে বিন্যস্ত হয়ে নিজেরা আলাপ-আলোচনায় রত হন আগতরা। অনেকে স্লোগান দিচ্ছিলেন। তবে ব্যানার-ফেস্টুন দেখা গেছে একেবারেই কম। নেতাদের নির্দেশ ছিলো ব্যানার ফেস্টুন না আনার জন্য। দুপুরের সাথে সাথে রোদ বাড়তে থাকে, অনেকে নানা দালানবাড়ি ও অল্পবিস্তর গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেন।

পুরান ঢাকার স্থানীয় অনেকে বঙ্গভবন ও দিলকুশা এলাকায় ড্রামে করে পানি নিয়ে আসেন সমাবেশস্থলে। মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও নবাবপুরের রাস্তায় ও গলির মুখে স্থানীয়দের অপেক্ষা করতে দেখা যায় পানির বোতল, কলা, শরবত ও বিস্কুটের ছোটো প্যাকেট নিয়ে। অনেক ব্যবসায়ী গোষ্ঠি পিকআপ ভ্যানে করে নিজেরাই পানি, জুস, বিস্কুট সরবরাহ করেছে। নিউজপ্রিন্ট কাগজের বড়বড় থানও বিলি করতে দেখা যায়, যেগুলোতে মাথা ঢেকে রোদ থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করছেন আগতরা।

ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ড্যাবের ১৩টি দলে ১৩টি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে দুই শতাধিক চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেন আগতদের।

নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এই মুসাফিরদের সঙ্গে এসে হাত মিলিয়েছেন। ইসলাম ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে শাহবাগকারী ব্লগারদের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ও ঘৃণা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমাদের সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা গড় ধারণা অনুসারে ভেবেছিলেন আজ তাদের খবর সংগ্রহের জন্য লম্বা ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই কাটাতে হবে দিনটি- তারা দেখেছেন অন্যরকম ব্যাপার ঘটেছে।

ধর্মীয় গোষ্ঠীটির এই লংমার্চে দেশের নানা প্রান্ত থেকে যেমন এসেছেন নানা পেশাজীবী মানুষ, তেমনি ঢাকাবাসীদের অনেকেও যোগ দিয়েছেন। শ্রমজীবী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণদেরও দেখা গেছে নবী মুহাম্মদের (সা.) প্রতি নিজেদের আনুগত্যের কথা জানিয়ে স্লোগান দিতে। ধর্মীয় ঘৃণা প্রচারে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার অভিযোগ তুলে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়েছেন অশীতিপর বৃদ্ধরাও। ব্যবসায়ী, বেসরকারি ও সরকারি চাকরিজীবী, অবরসাপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের পাশাপাশি নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদেরও দেখা যায় আন্দোলনের বিষয়-আশয় নিয়ে আলাপ করতে।

পুলিশের অনেক শীর্ষ কর্তা ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে যেচে গিয়ে আলাপ করেন। সমাবেশে কোনো কষ্ট হচ্ছে কিনা খোঁজ নেন। সরকারি চাপে অচল পরিবহনব্যবস্থার মধ্যে পায়ে হেঁটে আসা ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর নেন অনেক পুলিশ কর্তা। উর্দি ছাড়া সাধারণ পোশাকে মঞ্চের কাছে এসে আল্লামা শফীর কাছে দোয়া চান অনেক পুলিশ কর্মকর্তা।

ধর্মীয় বিশ্বাস ও নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি আর মূল্যবোধের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরে সরকারপন্থি তরুণদের কুরুচিপূর্ণ আক্রমণে ক্ষুদ্ধ সাধারণ মানুষ অভিনন্দন জানান ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা এই ধর্ম-অবমাননা করার জন্য আওয়ামী লীগকে ভোট দেননি।

সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি ও প্যান্ট-শার্টের একাকার অবস্থায় একে আর ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমাবেশ বলে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তবে আগত সাধারণ মানুষদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা একে একটি সরকারবিরোধী আন্দোলন সাব্যস্ত করে এসেছেন। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ও ছাত্রদলের অনেক চেনামুখসহ সাধারণ কর্মী-সমর্থকদেরও দেখা যায় সমাবেশে।

হেফাজতের ১৩ দফা দাবির প্রতি পূর্ণাঙ্গভাবে স্পষ্ট ভাষায় সমর্থন না জানালেও তাদের ভাষায় ‘সরকারের ভূমিকা’র বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোষ্ঠীটির এই কর্মসূচিতে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। সমাবেশে উপস্থিত এই দলদুটির নেতাকর্মীরা জানান, ইসলাম ও রাসুলের (সা.) অবমাননার বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদে তারা এসেছেন নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকেই- দলীয় সিদ্ধান্তে নয়।

এমনকি ইসলামের নানা ব্যাপারে রাজনৈতিক তাত্ত্বিক মাওলানা মওদুদীর ব্যাখ্যার বিষয়ে নিজেদের অমতের কথা যখন জানাচ্ছিলেন বিক্ষোভকারী ধর্মীয় শিক্ষার্থীরা, তখন জামায়াতের অনেককেও দেখা গেছে সমাবেশে।

সমাবেশে নারীদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। এর আগে আল্লামা শফী বলেছিলেন, ‘মা-বোনরা যেন ঘরে বসে’ তাদের জন্য দোয়া করেন। তবে সমাবেশ অঞ্চলের নানা এলাকায় সকাল থেকে বিকেলতক কমপক্ষে ১৪ দম্পতি এসেছিলেন বাসায় প্রস্তুত খাবার নিয়ে। সমাবেশে আগতরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানান।

সমাবেশ অঞ্চল ঘিরে কাঁটাতারের ব্যারিকেড বসিয়ে দায়িত্বে ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। তবে তাদের কোনো তৎপরতা চালাতে হয়নি পুরো সময়ে। হেফাজতের স্বেচ্ছাসেবকরা কড়া নজর রেখেছেন যাতে ব্যারিকেডের বাইরে গিয়ে কেউ জমায়েত না হয়। তারপরও দুপুরের দিকে জাতীয় প্রেসক্লাব ছাড়িয়ে ঢাকা ব্যাংক ফোয়ারা’র কাছে জমায়েত হয় প্রায় শ’তিনেক বিক্ষোভকারী। সচিবালয়ের দিক থেকে পুলিশ এসে তাদের ঘিরে ফেলে। পরে হেফাজতের স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের বুঝিয়ে নিয়ে আসেন।

হেফাজতের প্রধান আল্লামা শাহ আহমদ শফী দুপুর ৩টার দিকে মঞ্চে আসেন। সবাই জানেন, প্রবীণ এই ইসলামি চিন্তক নিজে কোনো বক্তৃতা করবেন না। তবুও জনাব শফী’র মঞ্চে আসার ঘোষণার পরই তাকে একনজর দেখার জন্য নানা দিক থেকে লোকেরা মঞ্চের দিকে যেতে চেষ্টা করেন। তবে জায়গা না থাকায় স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের বসিয়ে দেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ভাইস সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বের একটি এবং জাতীয় পার্টির কাজী জাফরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মঞ্চে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন বিকেল তিনটার একটু পরে। তারা আল্লাম শফীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

সমাবেশে বক্তৃতা করেন ওলীপুরী পীরসাহেব মাওলানা নুরুল ইসলাম, খেলাফতে মজলিসের আমীর মাওলান ইসহাক, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আবদুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সিনিয়র নায়েব আমীর আবদুর রব ইউসুফী, ইসলামী ঐক্যজোটের আমির আবদুল লতিফ নেজামী, সিনিয়র নায়েবে আমির আবুল হাসনাত আমিনী, জমিয়তে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মো. ইদ্রিস, হেফাজতে ইসলামের চার সিনিয়র নায়েবে আমির হাবিবুর রহমান, সাজেদুর রহমান, মাওলানা তৈয়ব ও মাওলানা সুলতান যওক, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর মাওলানা আহাদুল্লাহ আশরাফ,
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মইনুদ্দীন রুহী, এবং হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমির সাবেক মন্ত্রী মুফতি ওয়াক্কাস।

সমাবেশের ১৩ দফা ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান ইসলামি ঐক্যজোটের মহাসচিব ও হেফাজতের নায়েবে আমির মুফতি ফয়েজল্লাহ। পরে বর্ষীয়াণ আল্লাম শফীর পক্ষে সংক্ষিপ্ত লিখিত বক্তৃতা পড়ে শোনান তার ছেলে আনাস মাদানী। সবশেষে হেফাজতের মহাসচিব জনাব জুনায়েদ সোমবার হরতালের ঘোষণা দেন। লংমার্চকারীদের ওপর পথে পথে হামলার প্রতিবাদে এই হরতাল, জানান হেফাজত নেতা।

সমাবেশ শেষে রাজধানীর বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা গন্তব্যে ফেরার পথে শাহবাগে তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকা গণজাগরণ মঞ্চের নেতাকর্মীরা। হামলাকারীদের হাতে এসময় ধারালো অস্ত্র, লাঠি ও পিস্তল দেখা যায়। এসময় অনেকে রমনা উদ্যান হয়ে গন্তব্যমুখী হলে তাদের ওপরও হামলা করা হয়। পুলিশ রাবার বুলেট ছোঁড়ে। এসময় দুজনকে আটক করে পুলিশ। এছাড়া ঢাকার কাছে অন্যান্য অঞ্চল থেকেও হামলার খবর আসছে।

এদিকে, চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে গত দুদিনের অবস্থান শেষে হেফাজতে ইসলামের গণঅবস্থান শেষ হয় রাতে। লংমার্চে আসতে বাধা দেয়ায় হেফাজতকর্মীরা গতকাল রাত থেকে চট্টগ্রামের ওয়াসার মোড় ও কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। ঢাকার সমাবেশের মতোই ওই দুই শহরে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ লক্ষ্যণীয় ছিল বলে জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা।

No comments

Powered by Blogger.