টেটাযুদ্ধ টিকে আছে মোড়লদের স্বার্থে- আর্থিক লাভ হয় মোড়ল ও পুলিশের by মোস্তফা কামাল সরকার

নরসিংদীর চরদিঘলদী গ্রাম এখন পুরুষশূন্য। সাম্প্রতিক টেঁটাযুদ্ধের পর পুলিশী অভিযানের ভয়ে পুরুষরা বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এই সুযোগে এক শ্রেণীর মোড়ল হাতিয়ে নেবে লাখ লাখ টাকা।
মোড়লের সৃষ্ট টেঁটাযুদ্ধে সাধারণ মানুষ হতাহত হওয়া ছাড়াও সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য। গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না মোড়লের। উপরন্তু সিন্ধুক ভরে উঠবে কাঁচা টাকায়। এটি কোনো সিনেমা-নাটকের গল্প নয়। দেশ যখন ডিজিটাল হবার পথে এগুচ্ছে তার উল্টা পিঠেই রয়েছে মধ্যযুগীয় এই অন্ধকার চিত্র। রাজধানী থেকে মাত্র ষাট কিলোমিটার দূরে সরকারের ডিজিটাল বাংলা গড়ার আহ্বান শুধুই নীরবে কাঁদে।
এলাকাটি নরসিংদী সদর থানাধীন হলেও একটু বিচ্ছিন্ন। সদরের সঙ্গে এখনও আধুনিক যোগাযোগ তেমন গড়ে ওঠেনি। নৌকায় করে নদী পার হয়ে যেতে হয় এই এলাকায়। 'চরাঞ্চল' হিসাবে পরিচিত বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে এখনও মোড়লদের প্রভাব। মোড়লে মোড়লে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই চরাঞ্চলে প্রায়ই মধ্যযুগীয় 'টেঁটাযুদ্ধ' সংঘটিত হয়। জমি সংক্রানত্ম বিরোধকে কেন্দ্র করে গত শনিবার সদর উপজেলার দুর্গম চর এলাকা চরদিঘলদী গ্রামে ঘটেছে এই টেঁটাযুদ্ধ। পূর্ব প্রস্তুতিমতে ওই গ্রামের মোছলেম মিয়ার পৰ এবং শওকত আলীর পৰ একটি খোলামাঠে উভয় পৰের ৫ শতাধিক লোক টেঁটাযুদ্ধে অংশ নেয়। এক ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে মোছলেম মিয়ার সমর্থক বাচ্ছু মিয়া (৪০) টেঁটাবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ সময় উভয় পৰের অনত্মত অর্ধশত যোদ্ধা টেঁটাবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। থানা পুলিশ থাকতে কিভাবে এমন মধ্যযুগীয় যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হতে পারে জবাব নেই প্রশাসনের কাছে, না এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে।
ঘটনাস্থল চরদিঘল গ্রাম সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে গোটা গ্রামে পুরম্নষ মানুষ নেই একজনও। খুন হওয়ার কারণে কার বিরম্নদ্ধে মামলা হচ্ছে, কাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে কেউ জানে না। ভয়ে সবাই গ্রামছাড়া হয়ে গেছে। ঝুপড়ি ঘরে ডাকাডাকি করে পাওয়া গেল এক বৃদ্ধাকে। পুলিশ মনে করে প্রথমে কথাই বলতে চান না। অনেক বুঝিয়ে বলার পর তিনি জানালেন, তাঁর তিন পুত্র গত তিন দিন ধরে পলাতক। বৃদ্ধার দাবি তাঁর ছেলেদের একজনও মারামারিতে যায়নি। তবে গ্রামের একজন মাতবর বলেছে, তাঁর ছেলেরাও মামলার আসামি হবে। এ কারণেই ভয়ে গ্রাম ছেড়েছেন তারা। কবে ফিরবে ছেলেরা বৃদ্ধা তা জানাতে পারেননি। প্রক্রিয়াটি চলে এভাবেই। এখন শুরম্ন হবে টাকার খেলা।
পাশের করিমপুর ইউনিয়নের বগারগোত গ্রামের তারা মিয়া এ প্রতিবেদককে জানান, এলাকার আধিপত্য নিয়েই মূলত চর এলাকায় উভয় পৰের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে থাকে। একশ্রেণীর স্থানীয় মোড়ল ইচ্ছে করে সংঘর্ষ ঘটিয়ে ফায়দা লুটে নেয়। সংঘর্ষে যে পৰের লোক মারা যায় সে পৰই বেশি লাভবান হয়। লোক মারা যাবার খবর এলাকায় প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপৰরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর এ সুযোগে যে পৰের লোক মারা যায় সেপৰ প্রতিপৰের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করে। পরে লুটপাটের অংশ ভাগাভাগি করে নেয়। এতে পুলিশ প্রশাসনও লাভবান হয়ে থাকে। উভয় পৰই মামলা দায়ের করতে থানা পুলিশের শরণাপন্ন হয়। গ্রাম্য প্রবাদে আছে 'বেশি গুড় মিষ্টি'। যে পৰ গুড় বেশি দেবে সে পৰেই পুলিশের ভূমিকা থাকবে। মাঝখানে সিন্ধুক ভরে যাবে কিছু মোড়লের। এ প্রথাই চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। গ্রামের স্কুল শিৰক আনিসুর রহমান ৰোভ প্রকাশ করে বলেন, এই যুগেও আমরা অনেক পিছনে পড়ে আছি। সামনত্ম প্রভুদের নিষ্পেষণে পিষ্ট হচ্ছি প্রতিদিন। মুক্তির পথ কি প্রশ্নে বলেন, একমাত্র শিৰাই দিতে পারে মুক্তি। এলাকায় শিৰিত কি নেই প্রশ্নে তিনি বলেন, সামনত্ম প্রভুদের ছেলেমেয়েরাই শিৰিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের সনত্মান যারা শিৰার আলো পায় তারা আর গ্রামমুখী হয় না। রাজধানী নিদেনপৰে জেলা সদরেই তারা বসবাস করেন। স্থানীয় প্রশাসন, প্রভাবশালী মোড়ল গোষ্ঠী এবং সাধারণ নিরীহ মানুষকে এই মধ্যযুগীয় মানসিকতা থেকে বের করে এনে ডিজিটালের স্পর্শে উজ্জীবিত করতে পারলে টেঁটাযুদ্ধের মতো বর্বরোচিত ঘটনা রোধ সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি এলাকায় আইনশৃংখলা পর্যবেৰণ জোরদার করার দাবি জানান।
সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা এই চরাঞ্চলের মানুষ কিছুই জানে না। মধ্যযুগীয় কায়দার টেঁটাযুদ্ধ বন্ধে ডিজিটাল পদ্ধতির কোন কার্যকর ভূমিকা নেই। চরের মানুষ এখন লেখাপড়া করছে। অনেক উচ্চ শিৰিত লোক রাষ্ট্রের গুরম্নত্বপূর্ণ পদে আসীন। অনেক ছাত্রছাত্রী দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠগুলোতে লেখাপড়া করছে। অথচ এই মধ্যযুগীয় কৃষ্টির পরিবর্তন নেই। এক শ্রেণীর মোড়ল কৌশলে ধরে রেখেছে এই কৃষ্টি। বছরে না হোক ২/৩ বছরের মধ্যে একটি যুদ্ধ বাধাতে পারলে অনেক দিনের জন্য নিশ্চিত অর্থ সংস্থান হয়ে যায় তাদের। এভাবেই তারা এলাকায় হয়ে উঠেছেন বিত্তশালী এবং প্রভাশালী। এলাকার আধিপত্য নিয়ে মোড়লদের দ্বন্দ্বেও কারণেই মূলত নরসিংদী জেলার চরাঞ্চলগুলোতে টেঁটাযুদ্ধ হয়ে থাকে। মধ্যযুগীয় কায়দায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এ টেঁটাযুদ্ধ চলে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। এসব লড়াইয়ে অধিকাংশ সময় নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। আবার অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করে। সদর উপজেলার আলোকবালী, করিমপুর, নজরপুর, জিৎরামপুর, রায়পুরা উপজেলার নিলৰ্যা, চরমধুয়া, চর আড়ালিয়া বাঁশগাড়ি, শ্রীনগর মহেষপুর ইউনিয়নে এলাকার আধিপত্য নিয়ে বিরোধ, মামলা পাল্টামামলা চলছে যুগ যুগ ধরে। এ জন্য প্রভাবশালীদের দায়ী করেন নিরীহ এলাকাবাসী। শুধু সদর থানা নয়, রায়পুরা থানার বিশাল চরাঞ্চলেরও একই চিত্র। টেঁটাযুদ্ধ, বলস্নম যুদ্ধ, লাঠি যুদ্ধ এইসব এলাকার নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আধিপত্য বিসত্মার এবং সাধারণ মানুষকে আইনের বেড়াজালে বন্দী করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের লৰ্যেই এধরনের যুদ্ধ সংগঠিত করা হয়।
বিষয়টি সম্পর্কে পুলিশ সুপার ড. আক্কাস আলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বর্তমান যুগে এমন ঘটনা খুবই দুঃখজনক। আমরা এ সম্পর্কে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধানত্ম নিয়েছি। খুব শীঘ্রই সদর ও রায়পুরা থানার চর এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, রাজনীতিবিদ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে বৈঠক করা হবে। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরম্নদ্ধে কাঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার কথাও তাদের বলা হবে। যাতে আর টেঁটাযুদ্ধ না হয় সেজন্য প্রয়োজনে ইন্ধনদাতাদেরও গ্রেফতার করা হবে। সদর থানার ওসি নজরম্নল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, চর এলাকার জনগণকে সচেতন করা এবং পুলিশ নজরদারি জোরদার করা হলেই টেঁটাযুদ্ধসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। শীঘ্রই এ ব্যপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.