আরেকটি সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দেশ!- আইডিবির কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ প্রস্তাব, অথচ ২৭ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ দীর্ঘদিন অব্যবহৃত by ফিরোজ মান্না

সিমিউই-৫ নামে আরেকটি সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে এ বছরের জুনেই যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) কাছ থেকে উচ্চ সুদে বিরাট অঙ্কের টাকা ঋণ প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ সাবমেরিন কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)।
দেশে যে ব্যান্ডউইথ রয়েছে- সেই ব্যান্ডউইথ থেকে ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ১৭ গিগাবাইট। বাকি ২৭ দশমিক ৬ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত রয়েছে। মূল্যবান এই সম্পদ ফেলে রাখায় দেশের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। সিমিউই-৪ কেবল স্থাপনের সময়ও আইডিবির কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা সুদে আনা হয়েছিল। সেই টাকা এখনও পরিশোধ করতে পারেনি বিএসসিসিএল। আবার নতুন করে টাকা এনে সিমিউই-৫ কেবলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বছরের জুনের মধ্যে সিমিউই-৪ কেবলের আপগ্রেডেশন কাজ শেষ হয়ে গেলে ১১৬ দশমিক ৬ গিগাবাইট দেশে আসবে।
এদিকে ইন্টারন্যাশন্যাল টেরেসট্রিয়াল কেবলের (আইটিসি) ৬টি লাইসেন্স দিয়েছে বিটিআরসি। আইটিসি লাইসেন্স নিয়ে অপারেটররা ‘আনলিমিটেড’ ব্যান্ডউইথ আনতে পারবে। প্রতিটি লাইসেন্স ‘হোল্ডার’ ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আনবে। কিন্তু তাদের এই ব্যান্ডউইথ কোথায় কাজে লাগাবে তার ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিএসসিসিএলের এমডি মোঃ মনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত যে পরিমাণ ব্যান্ডউইথ প্রয়োজন পরিমাণ ব্যান্ডউইথ রেখে বাকিটা বিক্রি করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। বিক্রি করতে পারলে এখান থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্র উপার্জন হবে। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এখনও এই কাজটি করা যাচ্ছে না। তাছাড়া বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। এখানে বিএসসিসিএল একা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে দেশে বিকল্প পথে ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ আনার জন্য সিমিউই-৫ নামে নতুন কনসোর্টিয়ামের সদস্যপদ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সিমিইউ-৪ এর (সাউথ এশিয়া-মিডলইস্ট-ওয়েস্টার্ন ইউরোপ) কেবলের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে। এর মালিক হচ্ছে ১৬টি দেশ। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিসর, ইতালি, তিউনিশিয়া, আলজিরিয়া ও ফ্রান্স। সিমিউই-৫ নতুন কনসোটিয়ামটি গঠিত হবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ নিয়ে।
সূত্র জানিয়েছে, বিটিআরসির কাছ থেকে আইটিসি লাইসেন্স পেয়েছে- নভকম লিমিটেড, ফাইবার এ্যাটহোম, সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড, বিডি লিঙ্ক কমিউনিকেশন লিমিটেড, ম্যাংগো টেলিসার্ভিস লিমিটেড এ্যাসইস-এএইচএল জেবি নামের প্রতিষ্ঠান। তারা ‘ওভারহেড’ কেবলের মাধ্যমে ভারত থেকে আনলিমিটেড ব্যান্ডউইথ দেশে আনতে পারবে। লাইসেন্সপ্রাপ্তরা লাইসেন্স নিয়ে এখন চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন। কারণ তাদের ব্যান্ডউইথ কিভাবে ব্যবহার হবে সেই বাজার নেই। দেশের বাইরে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশে উচ্চ দামে ব্যান্ডউইথ বিক্রির বাজার রয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে বাইরের বাজারও ধরতে পারছে না তারা। বিএসসিসিএল বলছে, দেশে মাত্র একটি সাবমেরিন কেবল রয়েছে। কোন কারণে কেবলটিতে সমস্যা দেখা দিলে বিকল্প হিসেবে আইটিসি কাজে লাগবে। তখন আর বিদেশী কোন বিকল্প কেবল বেশি টাকা দিয়ে ভাড়া নিতে হবে না।
বিএসসিসিএল জানিয়েছে, কনসোর্টিয়াম ২০ হাজার কিলোমিটার সিমিউই-৪ কেবলের ‘আপগ্রেডেশন’ বা উন্নয়ন কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। গোটা কেবলটির উন্নয়নে জন্য বেশি সময় লেগে গেছে। আগামী জুন নাগাদ পুরো কেবলর আপগ্রেড হবে। কেবল আপগ্রেড হওয়ার পর বাংলাদেশ বাড়তি ১৬০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ পাবে। এর আগে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ৪৪ দশমিক ৬ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ দেশে আসত। বাড়তি ১৬০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ পেতে ৫০ কোটি টাকা কনসোর্টিয়ামকে বিএসসিসিএল পরিশোধ করেছে। আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত ব্যান্ডউইথ প্রয়োজন হতে পারে ৩৭ দশমিক ০৭৫ গিগাবাইট পার সেকেন্ড (জিবিপিএস)।
টেলিকম বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ এত বেশি থাকার পরও কেন ব্যান্ডউইথের দাম কমানো হচ্ছে না। মূল্যবান সম্পদ দেশে ফেলে রেখে টাকার অপচয় করা হচ্ছে। অন্যদিকে গ্রাহকদের কাছ থেকে উচ্চ মূল্য নেয়া হচ্ছে। এটা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে মনে করেন তারা। ব্যান্ডউইথের দাম প্রতি এমবিপিএস ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় নামিয়ে আনার দাবি করেছেন। বর্তমানে প্রতি এমবিপিএস (পার সেকেন্ড মেগাবাইট) সাড়ে ৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে আসতে আরও অনেক বেশি দাম পড়ে যায়। আইএসপি লাইসেন্সপ্রাপ্তরা (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডর) গ্রাহকের কাছ থেকে অনেক বেশি টাকা নিচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ব্রডব্যান্ড লাইন ব্যবহার করা কঠিন হয় যায়। মোবাইল ইন্টারনেট বা ওয়্যারলেস ইন্টারনেটের খরচ আরও বেশি। দেশকে সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল করতে হলে ব্যান্ডউইথের দাম কমাতে হবে। তা না হলে গ্রামের মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
সরকার বলছে, ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ স্বল্প মূল্যে গোটা দেশে পৌঁছে দিতে আরও দুটি সাবমেরিন কেবল দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুটি সাবমেরিন কেবল দেশের সঙ্গে যুক্ত হলে ‘কানেকটিভিটি’ বহু গুণ বাড়বে। বিদেশীরাও এ দেশে কলসেন্টারসহ ইন্টারনেটকেন্দ্রিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করবে। তখন প্রতিযোগিতামূলকভাবে কে কত কম দামে ইন্টারনেট সংযোগ দিতে পারে সেই চেষ্টাই থাকবে। প্রতিযোগিতা হলে স্বাভাবিকভাবেই ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম কমবে।

No comments

Powered by Blogger.