এসো সোনালি মানুষ_ জানোয়াররূপী পুরুষ রোখ, অঙ্গীকার- নারী দিবস উপলক্ষে পুরুষ সমাবেশ

 মেয়েটির নাম রম্নপালি। বাড়ি শেরপুর। বয়স সতেরো কি আঠারো। গায়ের রং দুধে-আলতা। গরন-মুখায়বও বেশ দৃষ্টিকাড়া, যা নামের সার্থকতাই বহন করে। স্বভাবেও আছে দুরনত্মপনা।
প্রজাপতির মতোই উড়ে বেড়াত গ্রামের এক প্রানত্ম থেকে অন্য প্রানত্ম, মুক্ত বিহঙ্গের মতো। হাসত খেলত, আর দেখত রঙ্গিন স্বপ্ন। তাঁর এই উচ্ছ্বলতা সবার দৃষ্টি কাড়ত, ছিলও সে গ্রামের সবার প্রিয়। এরই মধ্যে তাঁর প্রতি কুদৃষ্টি পড়ে একই গ্রামের বখাটে আনিসের। নিজের কু-মনোবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য বিয়ের প্রসত্মাব পাঠায় রম্নপালিদের বাসায়। কিন্তু রম্নপালির অভিভাবকরা ছেলে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকায় এ প্রসত্মাব প্রত্যাখ্যান করে। আনিসের উৎপাত থেকে মেয়েকে রৰার জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেয় তাঁর পরিবার। এতে আনিস ৰিপ্ত হয়ে বিয়ের ২০ দিনের মধ্যে এ্যাসিড ছুঁড়ে মারে রম্নপালির শরীরে। ঝলসে যায় তার শরীর, গলা ও মুখের কিছু অংশ। এ্যাসিডের ফলে শুধু যে তার শরীর ঝলসে যায় তা নয়, ঝলসে যায় তার স্বপ্ন, থেমে যায় তার পৃথিবী। পুরম্নষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে ঘৃণ্য প্রকাশ এই এ্যাসিড সন্ত্রাস, যা কেবল একটি মানুষের জীবনকেই থামিয়ে দেয় না, সভ্যতার দীপ্র দুপুরে নামিয়ে আনে মধ্যযুগীয় অন্ধকার। আজ সোমবার আনত্মর্জাতিক নারী দিবস উপলৰে রম্নপালির মতো এ্যাসিড সহিংসতার স্বীকার এমনই নারীদের সামনে রেখে এ্যাসিড সহিংসতার বিরম্নদ্ধেই পুরম্নষরা অঙ্গীকার সমাবেশ করল রবিবার ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে। আর এ সমাবেশের আয়োজন করেছিল এ্যাসিড সারভাইভার ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠানে পুরম্নষদের অঙ্গীকার ছাড়াও ছিল এ্যাসিড সহিংসতাবিরোধী গান ও নাচ। আনত্মর্জাতিক নারী দিবসের এক শ' বছর পূর্ণ হলো এ বছর। এ সময়ে সারা বিশ্বে যখন নারী জাগরণের উত্তরণ চলছে, তখন আমাদের দেশে প্রতি মুহূর্তে নারীরা বিভিন্ন সহিংসতার স্বীকার হচ্ছে। প্রতিদিন অগণিত নারী ও শিশু এই বর্বর্রোচিত আক্রমণের শিকার হয়ে হারাচ্ছে তাদের স্বাভাবিক জীবন। এই নৃশংস নির্যাতনের ফলে সমাজ হারাচ্ছে সুস্থতা এবং বাধাগ্রসত্ম হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন। পরিবার থেকে, সমাজ থেকে এই জঘন্য অপরাধকে উপড়ে ফেলতে, এই বর্বর অপরাধের বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এবং নারী ও শিশুর অধিকার আদায়ে পুরম্নষরা এদিন অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো এ সমাবেশে। এই সমাবেশের শুরম্নতেই স্বাগত বক্তৃতা দেন আয়োজক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান। সংহতি প্রকাশ করে আরও বক্তৃতা করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর এমপি, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, কণ্ঠশিল্পী শুভ্রদেব প্রমুখ। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। মনিরা রহমান বলেন, এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতি বছর ৫৭.৫ শতাংশ নারী যৌন হয়রানি ও এ্যাসিড সহিংসতার স্বীকার হচ্ছে। এ হিসাব কাগজে কলমের, তবে বাসত্মবে এ সহিংসতার চিত্র আরও ভয়াবহ। তাই পুরম্নষদের এই অঙ্গীকার সমাবেশ বলতে চাই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পুরম্নষদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, এ্যাসিডের মতো জঘন্য সন্ত্রাস চলছে এ দেশে। তরম্নণ সমাজকেই সচেষ্ট হতে হবে এবং তাঁদের প্রতিই আহ্বান জানাই এ্যাসিড প্রতিরোধে। জুয়েল আইচ বলেন, দায়িত্ববান পুরম্নষরা এ্যাসিড নিৰেপ করে এটা আমি বিশ্বাস করি না। যারা করে তারা পুরম্নষ নয়, কাপুরম্নষ। জানোয়ার থেকেও অধম, হীন। পৃথিবীতে হিংস্র জানোয়ারের মুক্ত আলো বাতাসে ঘুরে বেড়ানোর অধিকার আছে, কিন্তু জারোয়ার রূপী পুরম্নষগুলোর সে অধিকারও নেই। আমার প্রতিজ্ঞা এই সন্ত্রাসীদের অবশ্যই রম্নখব। ঘোষণাপত্রে রামেন্দু মজুমদার পাঠ করেন, একজন সচেতন পুরম্নষই পারে অপর পুরম্নষকে সচেতন করতে। একজন সচেতন পুরম্নষই পারে এ্যাসিড সহিংসতাসহ সকল ধরনের নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরম্নদ্ধে নীরব না থেকে উচ্চকণ্ঠে 'না' বলতে। মনে রাখতে হবে নির্যাতনমুক্ত জীবন, স্বাধীন মতামত প্রকাশ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে সিদ্ধানত্ম গ্রহণের অধিকার নারীর মানবাধিকার। বেলুন উড়িয়ে পুরম্নষদের এই অঙ্গীকার সমাবেশের উদ্বোধন করেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। সংহতি প্রকাশ করে দেয়া বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে পরিবেশিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে এ্যাসিড সারভাইভারদের সঙ্গীত দল পঞ্চমসর পরিবেশন করে_ এসো সোনালি মানুষ... এবং ছিড়িতে না পারি দড়া দড়ি... গান দু'টি। কোজআপ তারকা বিউটি গেয়ে শোনান- সোনার ময়না পাখি... এবং মিলন হবে কত দিনে...গান দু'টি। তারপর সন্ধ্যায় ও আলোর পথযাত্রী... গানটির সঙ্গে রবীন্দ্র সরোবরে উপস্থিত হাজারো নারী-পুরম্নষ মোমবাতি প্রজ্বলন করে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ জানায়। সন্ধ্যার পর সাংস্কৃতিক পর্বে আরও গান গেয়ে শোনান সঙ্গীতশিল্পী রাশেদউদ্দিন আহমেদ তপু ও তাঁর দল, নূর-এ-স আলম রম্নমী, কাজী মুহিত শাহরিয়ার জয়, দিলশাদ নাহার কণা, শাফকাত আহমেদ দীপ্ত প্রমুখ। উলেস্নখ্য, ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের একটি সুই কারখানায় নারী শ্রমিকদের জ্বলনত্ম বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় নারী দিবসের মূল চেতনার। এর প্রেৰিতে ১৮৬০ সালে নারীরা নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনের স্বীকৃতি লাভ করে। তারপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সাম্যবাদী নারীদের আনত্মর্জাতিক সম্মেলনে ৮ মার্চকে আনত্মর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে ঘোষণা দেন জার্মানের কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনের নেত্রী কারা জেৎকিম। অবশেষে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকেই স্বীকৃতি দেয় আনত্মর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে। আজ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশও এই দিনটির এক শ' বছর পূর্তি পালন করবে এবং একই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সচেতন হবে পুরম্নষরা।

No comments

Powered by Blogger.