জঙ্গীদের স্বঘোষিত সমর্থক নেতা! by মমতাজ লতিফ

অবশেষে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একটি সত্য মুখ ফস্কে বের হয়ে এল! বলা চলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে, বিশেষত: শেখ হাসিনার সঙ্গে যেন বিনা কারণে, বিনা উস্কানিতে পায়ে পা লাগিয়ে একটি নতুন ঝগড়া বাধাতে চাইছেন তিনি! অকারণে সংসদ বর্জনরত এই নেত্রী যিনি দেশের বহু গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে নীরব থেকেছেন, যথাসময়ে যথাযথ পদপে গ্রহণ না করে নিষ্ক্রিয় থেকেছেন।
আকস্মিকভাবে এ সময় যেদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জাতীয় স্বার্থে প্রধান প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে চুক্তি করতে যাত্রা করছেন, সেদিনই অহেতুক বিতর্কমূলক কতগুলো প্রশ্ন তুললেন কেন? তবে এ প্রশ্নকর্তার গোপন এবং অপ্রকাশিত ইচ্ছা-আকাঙ্াকে মূর্ত করেছে, তা বলাই বাহুল্য। পাঠকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন জাতীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দাবি আদায়ে যাচ্ছেন, তখন দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা পরোভাবে জাতির স্বার্থকে জোরদার করতে ইতিবাচক বক্তব্যের বদলে বিতর্কিত বক্তব্য দিলেন কেন?
ফ তবে কি তিনি গ্রেনেড নয়, এবার শেখ হাসিনা নামের রাজনৈতিক ব্যক্তির পথেই কাঁটা বিছাতে চান?
ফ কেন? রাজনৈতিক ব্যক্তির সফলতা নস্যাতের ইচ্ছা তার কাছে কি জাতির স্বার্থের চাইতেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
ফ বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও শেখ হাসিনার প্রাপ্য উপহার কি বন্দুকের গুলি? বোমা? কারাগার? গ্রেনেড? নাকি কাঁটা?
ফ তাঁর এই জাতির উদ্দেশে বক্তব্যকে কেউ কেউ শেখ হাসিনার ষ্ক্র৯৬ সালের সরকারের শেষ দিকে তদানীন্তন বিডিআর প্রধানের নির্দেশে বিএসএফ-এর বেশ কম্বজন ভারতীয় সীমান্ত রীকে অতর্কিত আক্রমণ করে খুন করা এবং সংবাদপত্রে তাদের মৃতদেহ লাঠিতে ঝুলিয়ে আনার দৃশ্য উপস্থাপনের সাথে তুলনা করেছে। ঐ তথ্য ও ছবি এমনভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল যা অবশ্যই ঐ অপকর্মের পরিকল্পক ও বাস্তবায়নকারীদের ইচ্ছাকে সফল করতে পেরেছিল ভারত_ সরকার প্রতিশোধ গ্রহণ করেনি কিন্তু স্বজাতির কাছে অপমাণিতবোধ করে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন।
ফ একজন রাজনৈতিক নেতা যদি গণতন্ত্র ও শান্তি শৃক্মখলাকামী হন, তাহলে তিনি কি কখনও স্বদেশে প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতবাদী জঙ্গীদের কৌশলে সমর্থন দিতে পারেন?
ফ কেন খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে একটি দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গীদের জঙ্গী তৎপরতাকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে সমর্থন দিলেন? তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে জোট সরকারের প্রশ্রয়ে সংঘটিত ১০ ট্রাক উলফাদের জন্য আনা অস্ত্র খালাস করা, বগুড়ায় লাধিক গুলি পাওয়া, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় উলফা ও ইসলামী জঙ্গীদের যে সম্পৃক্ততার তথ্য জানা যাচ্ছে, সেসব অপঘটনায় তাঁর সমর্থন থাকা আর প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গীদের সমর্থন করা একই কথার দুই রূপ বলে জনগণ যদি বিবেচনা করে তাহলে তা কি অন্যায় হবে?
ফ উপরন্তু খালেদার মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি তুলনা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নীরব খালেদার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে উদঘাটন করতে সহায়তা করেনি কি? সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, খালেদার কাছে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ষ্ক্র৭০-এ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা সূচিত, পরে দেশের যুদ্ধাপরাধী দল ব্যতীত অন্য সব দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক দল, এদের অনুসারীদের দ্বারা এবং দলমত নির্বিশেষে জনগণের অংশগ্রহণে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গীদের লড়াই! তিনি আরও বলেছেন, এই ধরনের অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গী আন্দোলনকে সমর্থন করা তাঁর দলের নীতি! সত্যিই তো, তিনি ও তাঁর পুত্র, জামায়াত নেতাদের সঙ্গে একযোগে জে.এম.বির জন্মদান, প্রসার, বাংলাভাই বা শায়খ রহমান শুধু নয়, দেশী-বিদেশী শতাধিক জঙ্গী দলের জন্মদানে সমর্থন দেননি কি? এসব জঙ্গী তৎপরতা যা বাংলাদেশকে ২০০১ থেকে শুরু করে ছয়-সাত বছর জঙ্গীবাদের 'ব্রিডিং গ্রাউন্ডম্ব হিসেবে তৈরি করে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা, নিরপে নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, শান্তি ও শৃক্মখলা এবং জঙ্গীবিরোধী গণতন্ত্রমুখী দলের নেতা-নেত্রীদের আঘাত করা, খুন ও নির্যাতনের মাধ্যমে এদের অস্তিত্ব বিলোপ করার প্রক্রিয়া চালিয়েছিল_ সেসব জঙ্গী অব্যাহত মদদ লাভ করেছিল তাঁর, তাঁর পুত্র এবং জামায়াত-বিএনপিম্বর মন্ত্রী, সাংসদ,-নেতাদের কাছ থেকে_ এ তথ্যকে তিনি জঙ্গীদের প্রতি সমর্থনদানের মাধ্যমে জোরদার করলেন কি?
ফ এই বক্তব্য অনেকটাই বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনীদের মতোই_ নিজ মুখে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার কাজটিও করলেন কি তিনি?
ফ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এ দেশে বাস করে ধনাঢ্য হয়ে ওঠা, বিপুল অস্ত্র ক্রয়ের অর্থ লাভের পেছনে কোন দেশের গোয়েন্দা বা কর্তৃপ অর্থ যোগান দেয়, তা অনেকবার সংবাদ সূত্রে জানা গেছে। আর এ কথা তো দিবালোকের মতো সত্য যে, অনুপ চেটিয়া বা রাজখোয়া বা অন্যরা জাহাজভর্তি অস্ত্র ক্রয়ের এবং নিজেরা বিলাসী জীবনযাপন করতে পারেন বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভের কারণেই! খালেদা জিয়ার বক্তব্য অনুসারে জিয়াউর রহমান ঐ অনুপ চেটিয়া, রাজখোয়া ও পরেশ বড়য়াদের মতোই বিচ্ছিন্নতাবাদী মুক্তি আন্দোলনের নেতা ছিলেন। নৈতিকতার বলে বলীয়ান মুক্তিযোদ্ধা নন। জিয়াউর রহমান ও অনুপ চেটিয়া গংয়ের নেপথ্যের অর্থ-পরামর্শদাতা গোষ্ঠীটি কি একই গোষ্ঠী? তাঁর বক্তব্য তো তাই ইঙ্গিত করে না কি?
ফ খালেদার বক্তব্য অনুসারে জিয়াউর রহমান 'গণসেনাপতিম্ব, স্বাধীনতার ঘোষক বা ঘোষণা পাঠকারী নয়, নয় মুক্তিযোদ্ধা! জিয়াউর রহমান ষ্ক্র৭১-এর ২৫ মার্চে পাকিস্তানীদের জন্য আনীত সোয়াত জাহাজ ভর্তি অস্ত্র খালাস করতে রওনা হয়েছিলেন। পরে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বাঙালী সেনা হত্যার খবর শুনে বের হয়ে আসা বাঙালী তরুণ সেনারা বার বার যখন বাঙালী সঙ্গীদের প্রাণ রার্থে সেনানিবাসে যেতে চায়, তখনও সংখ্যাধিক থাকা সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান তাদের বাধা দেন এবং পরে মেজর রফিকের দ্বারা নির্দেশিত বিডিআর সেনারা সেনানিবাস আক্রমণের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হলে জিয়াউর রহমান পুরো বাঙালী সেনা দলটিকে শহর থেকে বহু দূরে কালুর ঘাট ব্রিজ হয়ে কক্সবাজারের দিকে সরে যেতে নির্দেশ দিলে অসহায় বাঙালী সেনারা মেজর রফিকের নির্দেশিত সেনানিবাস আক্রমণ করে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়ার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়! তাহলে জিয়াউর রহমান ষ্ক্র৭১-এ যাদের নির্দেশে, প েকাজ করেছিল, ভারতের তথাকথিত 'মুক্তিম্ব আন্দোলনের নেতারাও কি একই নির্দেশ দাতাদের প,ে সমর্থনে কাজ করছে? খালেদা তো বলেই দিয়েছেন, তিনি ও তাঁর দল এ ধরনের 'মুক্তিম্ব আন্দোলনকে সমর্থন করেন!
ফ যে রাজনৈতিক নেতা বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গীদের সমর্থন দেন, তাঁর শাসনকালে সেইসব জঙ্গী, দেশকে বিচ্ছিন্ন, বিভেদ-বন্দী করতে যেসব হামলা করে, যেমন সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ছায়ানটের পহেলা বৈশাখে বোমা হামলা, সিনেমা হলে, মেলায়, গির্জায় বোমা হামলা, আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, জনপ্রিয় রাজনীতিক আহসানউল্লা মাস্টার, শাহ কিবরিয়া হত্যা, অসংখ্য সাংবাদিক হত্যা, সংখ্যালঘু হিন্দু-আহমদীয়া নির্যাতন-ধর্ষণ ইত্যাদি কোন অপরাধের বিচার সঙ্গত কারণেই অসম্ভব হয়েছিল কি? উক্ত অপরাধগুলো তো এদেশের জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী ধর্মের নামে জঙ্গী খুনীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল! অপরাধের বিচার থেকে রা করে তাদেরকে এক ধরনের 'ইনডেমনিটিম্ব কি এই নেত্রী প্রদান করেননি? নাকি তিনি জঙ্গী বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে পার্থক্য বোঝেন না?
ফ সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয়, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী খুনী জঙ্গীদের সমর্থন করেন কিন্তু তাদের গ্রেফতার যে বড়ই অপছন্দ করেন, তা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন এ কথা বলে যে_ ভারতের গোয়েন্দারা বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে তাদের ধরে নিয়ে গেছে! অন্যদিকে উলফা নেতা রাজখোয়া বলেছে, বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে বেইমানি করেছে, তাদেরকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে! রাজখোয়ারা যাদের রাজত্বে রাজার হালে এ দেশে বাস করেছে, তারা অর্থাৎ সেই নেতারা তো মোটেই বেইমানি করেনি? কি পেয়ে, কেন তারা বেইমানি করেনি, তা জনগণ জানে না। তবে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জনগণ, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনীতিকরা কারও কাছ থেকে কোন কিছুর বিনিময়ে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের শান্তি, প্রগতি, গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে বিসর্জন দিতে পারে না এতে সন্দেহ নেই। খালেদা জিয়া এ সত্য না বুঝলেও জঙ্গীরা, সে উলফা বা রোহিঙ্গা বা হিজবুত তাহরীর, হরকাতুল জিহাদ, এমনকি যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতও বোঝে! সেজন্য তাদের সব আক্রমণের শিকার কখনই বিএনপি বা খালেদা-তারেক হয় না, হয় আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী দল ও ব্যক্তি!
জঙ্গীরা সম্ভবত বিশ্বে এই প্রথম 'স্বঘোষিতম্ব উচ্চ মাপের সমর্থক-নেতা লাভ করেছে!
লেখক : শিাবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.