আরপিও সংস্কার প্রস্তাব-নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চায় নির্বাচন কমিশন by কাজী হাফিজ

শুধু সরকারি কর্মকর্তা নন, বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাও যদি ভোটের সময় নির্বাচন কমিশনের দেওয়া দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেন, তাহলে তাঁদের পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
বিদ্যমান আইনে এ রকম শাস্তির বিধান শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ ছাড়া সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর নতুন সংসদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণও ইসি নিজের হাতে রাখতে চায়। সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন ভোটের সময় তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার পক্ষে। এ বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংস্কারের প্রস্তাব এখন প্রায় চূড়ান্ত। এতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলবিষয়ক নতুন একটি বিধানও সংযুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। এ প্রস্তাব আইনে পরিণত হলে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল তাদের কেন্দ্র, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অফিসগুলো ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, সে ক্ষেত্রে তার নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে।
আরপিওর ৮৬ ধারায় সরকারি পদমর্যাদার অপব্যবহারের শাস্তি অংশে নতুন কয়েকটি উপধারা যোগ করার প্রস্তাব দিচ্ছে ইসি। এতে বলা হয়েছে, যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কর্তৃপক্ষ হিসেবে চেয়ারম্যান, ডিরেক্টর জেনারেল, ইন্সপেক্টর জেনারেল, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সেক্রেটারি, জেনারেল ম্যানেজার বা অন্য যেকোনো পদবির কর্মকর্তা এর আওতায় আসবেন। কর্তৃপক্ষ বলতে সরকারি অধিদপ্তর, সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান, নিবন্ধিত কোনো কম্পানি, ফার্ম, সমিতি ও সংগঠন বোঝাবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা, 'আরপিওর অনুচ্ছেদ-৫-এর বিধান আবশ্যিকভাবে পালনীয় করার জন্যই এ বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।' আরপিওর ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কমিশন যেকোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কোনো দায়িত্ব পালন বা সহায়তা করার নির্দেশ দিতে পারবেন। কিন্তু দায়িত্ব না পালন করলে এর শাস্তি কী হবে তা নির্ধারিত ছিল না।'
এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমাজের বিত্তশালী লোকদের অংশগ্রহণ সুগম করতে আরো বেশি চাঁদা বা অনুদান প্রদানের সুযোগ দিতে আগ্রহী ইসি। বিদ্যমান আইনে রাজনৈতিক দলকে কোনো ব্যক্তি পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত এবং কোনো প্রতিষ্ঠান ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা বা অনুদান দিতে পারে। ইসি ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটি ১০ লাখ এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিচ্ছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রার্থী চূড়ান্ত করার জন্য বেশি সময় দিতেও ইসি আগ্রহী। বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলো একই আসনে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময় একজনকে চূড়ান্ত করতে পারে। বর্তমান কমিশন এ সুযোগ প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখছে। এর ফলে প্রার্থী চূড়ান্ত করার জন্য দলগুলো প্রায় এক সপ্তাহ বেশি সময় পাবে। সাধারণত মনোনয়নপত্র বাছাই থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়ের ব্যবধান এক সপ্তাহ রাখা হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, এ বিধান দলের বিদ্রোহী প্রার্থী দমনে সহায়ক হবে এবং অযোগ্যতার কারণে দলের একজনের মনোনয়ন বাতিল হলে অন্য প্রার্থী বহাল থাকবেন।
কমিশন সূত্রে জানা যায়, ইসি প্রথমে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহের বিধান বাতিলের পক্ষে থাকলেও সেখান থেকে এখন সরে এসেছে। আরপিও সংশোধনীতে এ বিধান পরিবর্তনের কোনো প্রস্তাব রাখা হচ্ছে না। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এ অবস্থান দলের বিদ্রোহী প্রার্থী দমনে কিছুটা সহায়ক হবে বলেই নির্বাচন কর্মকর্তাদের ধারণা।
ইসির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী অপরাধের ক্ষেত্রে অর্থদণ্ডের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে ইসি ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ও এক লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব রাখছে। বিদ্যমান আইনে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হলেও অর্থদণ্ডের পরিমাণ নির্ধারিত নেই।
ইসির আরো প্রস্তাব, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরবর্তী এক মাস মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার বা সংশ্লিষ্ট জেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকায় তাদের অধস্তন কোনো কর্মকর্তাকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া বদলি করা যাবে না। প্রস্তাবটি ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন আগের ইসিরও ছিল। বিদ্যমান আইনে এই সময়সীমা ১৫ দিন রয়েছে।
আরপিও সংস্কার প্রস্তাবে ইসি প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকার বদলে ২৫ লাখ টাকা করার এবং ইসি নিজে না আয়োজন করলে নির্বাচনী এলাকায় একটির বেশি জনসভা না করার বিধানও রাখতে চাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে পুনর্বহালের প্রস্তাব রাখা হচ্ছে না। এতে নাম বদলের কারণে বিডিআরের বদলে 'বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ' নামটি প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ইসি প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিদ্যমান শর্তগুলোও পরিবর্তনের কোনো প্রস্তাব দিচ্ছে না। তবে কোনো প্রার্থী যদি তাঁর মনোনয়নপত্রে ও হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে নির্বাচিত হন, তাহলে ইসি তাঁর আসন শূন্য ঘোষণার এখতিয়ার রাখতে আগ্রহী।
ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন আগের ইসি নির্বাচনী আইন সংস্কারে যেসব প্রস্তাব রেখে যায়, তার কয়েকটি বর্তমান ইসির প্রস্তাবেও বহাল রয়েছে। আগের ইসির প্রস্তাব ছিল, সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর অথবা অন্তর্বর্তীকালীন/তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর সে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কমিশনের পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। বর্তমান ইসি এর বদলে সব মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে নিজের নিয়ন্ত্রণ লাভে আগ্রহী।
নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'আরপিও সংস্কার প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত। কমিশন সভায় অনুমোদনের পর কয়েক দিনের মধ্যেই এ প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

No comments

Powered by Blogger.