নির্মল সেন দধীচির উত্তরসূরি by সালেহ চৌধুরী

শ্রী নির্মল সেন- আমাদের নির্মলদা চলে গেলেন। মঙ্গলবার, ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তাঁর এই চলে যাওয়া কোনো চমকে ওঠার মতো খবর নয়। দিনকয় কিংবা কয়েক বছর আগেই এমনটি ঘটতে পারত। দীর্ঘদিন ধরেই তো তিনি ছিলেন গুরুতর অসুস্থ। খবরটা তবু আমাকে চমকে দিয়েছে।
এক অব্যক্ত ব্যথায় ছেয়ে গেছে মন। বুঝছি, স্বাভাবিক হলেই সব কিছু সহজ ও সহনযোগ্য হয় না। তাঁর এ অন্তিম বিদায় তেমনি এক ঘটনা।
১৯৬৮ থেকে ১৯৯৭- প্রায় তিন দশক আমরা ছিলাম কাছাকাছি- দৈনিক পাকিস্তান থেকে দৈনিক বাংলা- পাশাপাশি কাজ করেছি। কখনো তিনি পালাপতি (শিফট ইনচার্জ) আমি কনিষ্ঠ সহসম্পাদক, আর কখনো দুজনেই জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক। ফলে সুযোগ হয়েছে সাংবাদিক শ্রী নির্মল সেনকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার। রাজনীতি তো কখনো সাংবাদিকের মনোযোগের বাইরে থাকতে পারে না। তাঁর রাজনীতিও তাই অবলোকন করেছি। নির্মলদা তাঁর বিদ্যালয়জীবন থেকেই ছিলেন রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। একটি বিশেষ ধারার অন্যতম নেতা। আমার কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে 'একমাত্র নেতা'। কেন, তা অচিরেই স্পষ্ট হবে।
আমরা, সাংবাদিকরা প্রায়ই বলে থাকি, সাংবাদিকতা পেশা হলেও তাতে জড়িয়ে আছে একটু ভিন্নতা। কল্যাণকামী নিবেদিত শ্রম যার সারকথা। বলি, কিন্তু কজন তা মেনে চলি? নির্মলদা কিন্তু এই স্বাতন্ত্র্যে নিষ্ঠ থেকেই সাংবাদিকতা করে গেছেন।
এক সময় রাজনীতি ছিল সেবা আর সংগ্রামের দ্যোতক। আজ তা পেশায় পরিণত হয়েছে। একটা লক্ষ্য বা আদর্শের পথে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই ছিল রাজনীতিকের ধর্ম। এতে ব্যক্তিগতভাবে কিছু চাওয়া আর পাওয়ার তোয়াক্কা থাকত না। আমি কী পেলাম- এমন প্রশ্ন ছিল অবান্তর। নির্মলদা রাজনীতির এ ধারাই অনুসরণ করে গেছেন। সত্যি বলতে গেলে, আমি অন্তত মনে করি, আমাদের রাজনীতিতে তিনিই ছিলেন এ ধারার শেষ প্রতিনিধি। সব মিলিয়ে খর্বদেহের এ মানুষটিকে কল্পনা করতে গিয়ে আজ দেখছি চোখের সামনে যিনি দাঁড়িয়ে, তাঁর উচ্চতা আমাদের সবার মাথা ছাড়িয়ে অনেক অনেক ওপরে বিরাজ করছে।
বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় বিয়াল্লিশের 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তখন থেকেই মাঝেমধ্যে স্বল্প এবং দীর্ঘ বন্দি জীবনযাপন। জেল-জুলুম তাঁকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সব শেষে জেল খেটেছেন এরশাদ আমলে। একটি কিশোর কিংবা এমন এক দলের নেতা, যাঁকে ঠাট্টা করে বলতাম- নির্মলদা তাঁর পুরো দল নিয়ে রাস্তায় নামলেও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হবে না, কেন তাঁকে নিয়ে গণবিরোধী ক্ষমতাধরদের এই মাথাব্যথা? তার কারণ ছিল। তিনি যে আদর্শের পতাকা বহন করতেন, তা নিয়েই ছিল তাদের শঙ্কা। তাঁকে তাই বারবার জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
সাতচল্লিশের দেশভাগের পর মাসহ তাঁর প্রায় গোটা পরিবারই দেশ ছেড়ে যান। মাটি আর মানুষের সঙ্গে তরুণ নির্মলের বন্ধন তখন এমনই পাকা হয়ে গেছে যে তিনি দেশত্যাগের কথা ভাবতেও পারলেন না। উল্লেখ্য, একাত্তরে বারকয়েক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা গেলেও পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে মা ও ভাইদের সঙ্গে দেখা করার উদ্যোগও নেননি। প্রতিবারই ফিরে এসেছেন এই জনপদে প্রিয় আর দুর্গত মানুষদের পাশে থাকবেন বলে। মুক্তি-উদ্যোগকে সাহায্য করবেন বলে। এই ব্রতী জীবন তাঁকে ঘর বাঁধার অবকাশও দেয়নি।
বাড়ি গোপালগঞ্জে। বিদ্যালয়ের লেখাপড়া বরিশালে। উচ্চতর শিক্ষা আর জাতীয় রাজনীতির টানে ঢাকায় এসে গৃহশিক্ষকতাকে জীবিকার অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর প্রশংসনীয় খ্যাতি। এরই সুবাদে কিছুদিন দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করে ঊনষাট-ষাটের দিকে সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক জেহাদে যোগ দেন। দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দিয়ে অর্জন করেন দক্ষ সাংবাদিকের খ্যাতি। পেশাগত এ জীবন কিন্তু তাঁকে তাঁর আরাধ্য রাজনীতি থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি কখনো। নির্মলদার রাজনীতি ছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণচিন্তায় নিবেদিত। তাঁর সাংবাদিকতায় ছিল তারই প্রভাব। সত্তরের গোর্কির সময়কার লেখাগুলোই প্রথম তা স্পষ্ট করে। স্বাধীনতার পর 'স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই' জাতীয় উচ্চারণ এ ক্ষেত্রে এনে দেয় ব্যাপক পরিচিতি ও মর্যাদা। সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতার লক্ষ্যে তিনি নিজস্ব ভাষারীতিরও প্রবর্তন ঘটান। ছোট ছোট বাক্যে ও সহজ শব্দে বক্তব্য প্রকাশই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। এমন কাটা কাটা বাক্য তিনি ব্যবহার করতেন, যা ব্যাকরণবিদদের কাছে ত্রুটিপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার ভয় অমূলক ছিল না। তিনি কিন্তু তাঁর ধারা বদলাতে রাজি ছিলেন না। আর তাঁর রচনাবলি এতে করেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সাংবাদিক নির্মল সেন সুযোগ পেলেই, আর প্রায়ই তেমন সুযোগ করে নিয়ে পাড়ি জমাতেন দূরবর্তী আর দুর্গম কোনো না কোনো অঞ্চলে। এর পেছনে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেমন কাজ করত, তেমনি ক্রিয়াশীল থাকত গণমানুষের সমস্যার সঙ্গে পরিচিত হয়ে সুরাহার লক্ষ্যে তা কাগজে তুলে ধরা। এমন সব সফর থেকে ফিরে এসেই খবর কিংবা নিবন্ধ আকারে তুলে ধরতেন তা। কখনো কখনো একটি অবহেলিত সড়কের দুরবস্থা কিংবা খেয়া পারাপার নিয়ে বিপত্তি হয়ে উঠত তাঁর লেখার বিষয়। আর এই সাংবাদিকতা পেশার পুরোটা সময়ই তাঁর মনজুড়ে থাকত জাতীয় আর আন্তর্জাতিক রাজনীতি। ছোট সমস্যাও তাঁর কাছে ছোট ছিল না। আদতে ছোট কাজ, ছোট ক্ষতি আর ছোট দুঃখই তো জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এসব সমস্যার সামাধান করে করেই তো এগোতে হবে বৃহত্তর কল্যাণের পথে- এ বিশ্বাস ছিল তাঁর দৃঢ়। এই সাধনার পথ তিনি কখনো ত্যাগ করেননি। শ্রদ্ধায় অবনত শিরে আজ আমাদের তাঁর প্রত্যয়ের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। এমনটা করতেই হবে, সত্যি যদি আমরাও কল্যাণকামী হই।
সব সময়ই গুরুতর ভাবনা আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও নির্মলদা তাঁর মনের গভীরে বিরাজমান রসবোধকে কখনো বিসর্জন দেননি। এ বোধকে আশ্রয় করেই ছিলেন সুসংস্কৃত জীবনের অধিকারী। রাতের পালায় কাজ করে করে সহকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়লে তাঁর কণ্ঠে জেগে উঠত সুরের আলাপন। উদাত্ত কণ্ঠের কীর্তনের অনুরণন সবাইকে জাগিয়ে তুলত। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, তাই বলছি তাঁর গানের গলা আর বোধ ছিল খুবই উন্নত। সাহিত্যেও ছিল ঈর্ষণীয় দখল। সাদামাটা সুখী জীবনের প্রত্যাশী হলে নির্মলদা গান গেয়ে কিংবা সাহিত্যচর্চা করে সহজেই একটা আয়েশি জীবনের পথ করে নিতে পারতেন। তেমন কোনো আকুতিকে প্রশ্রয় দেননি বলেই বেছে নিয়েছিলেন কঠিনের সাধনা। যে সাধনায় পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার সংকল্পই ছিল প্রধান। এই চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্যেরই প্রতীকী প্রকাশ সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরও নিজের দেহটুকুও কল্যাণকামিতায় উৎসর্গ করে যাওয়া। ব্যতিক্রমী মানুষ এই নির্মলদা তাই আমাদের নমস্য। নির্মলদা প্রকৃত অর্থেই দধীচির উত্তরসূরি।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.