চলচ্চিত্র সমালোচনা- না সিনেমা, হ্যাঁ সিনেমা by মতিন রহমান

একটি দৈনিক সংবাদপত্রের গোলটেবিল বৈঠকে কতজনই না ছিলেন। সংবাদপত্রের সম্পাদক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রশিল্পী নেতৃস্থানীয় ১৬ জন জ্ঞানী-গুণী চলচ্চিত্রনির্মাতা, প্রযোজকসহ চলচ্চিত্রবিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন।


তাঁর কথা দিয়েই লেখাটি শুরু হলো, ‘চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা খুবই শোচনীয়। কতটা শোচনীয়, গোলটেবিলে বাগ্যুদ্ধে উঠে এল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা একজন মুমূর্ষু রোগীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। তবে এর পরিণতি কারও জানা নেই। বিজ্ঞ পরিচালকেরা তো বলেই বসেছেন, আমাদের কাছে চলচ্চিত্র মৃত হয়ে গেছে।
তা হলে কি চলচ্চিত্র নামক একটা বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে আমরা টানাটানি করছি? অন্যদিকে ঘন কুয়াশা জড়ানো শ্মশানঘাটে বসে নতুন নির্মাতারা আশায় স্বপ্ন দেখছেন, সংকট একদিন কেটে যাবে। আগামী দিনে সংকট বলে কিছুই থাকবে না।
আমরা যদি চলচ্চিত্রের প্রাক্-ইতিহাস বা প্রত্ন-ইতিহাস পর্যালোচনা করি, একটা বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারব, চলচ্চিত্র কখনো থেমে থাকে না। চলৎ ছবি চিরদিনই চলমান। তবে হ্যাঁ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকসহ রাজনৈতিক সূত্রপাতগত গভীরতলের বেড়াজালের প্রভাবিম্ভিত কারণে চলচ্চিত্রের গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তার অর্থ ফ্রিজ শট নয়। মোশান স্লো এক রূপ, যা আদৌ সুখকর নয় চলচ্চিত্রের জন্য। কারণ, চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, ‘ফিল্ম ইজ এ প্রডাক্ট, অ্যান্ড ইন্টারটেইনমেন্ট ইজ এ বিজনেস।’ [বাস্টেইন ক্লেভ] তথ্যগত উদাহরণ একটাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একটা স্বকীয়তা আজও অর্জন লাভ হয়নি। যার কারণে এর পুষ্টিহীনতা। পুষ্টিহীনতা এক দিনে ধরা পড়ে না। দিনে দিনে আজ তার ক্রমপরিবর্তিত চেহারা। দায় নেবে কে? পরিচালক, প্রযোজক, অর্থলগ্নিকারক, শিল্পী, কুশলী, পরিবেশক, হলমালিক না মধ্যস্বত্বভোগী? এক কথায়, আমরা সবাই। পরস্পরকে দোষী নামে দোষারোপ করে চলচ্চিত্রের মানুষের মধ্যে সংহতি নষ্ট হয়েছে। ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’, এমনই প্রবাদবাক্যের মতো আজকের চলচ্চিত্র পাণ্ডুরোগী। আমরা আগেই বলেছি, চলচ্চিত্র মানে চলৎ ছবি। এর ধর্মই প্রতি সেকেন্ডে অনবরত ছুটে চলা। এটা থেমে থাকার বিষয় নয়। বাঙালি জাতিরও থেমে থাকার ইতিহাস নেই। আছে উন্মাদনার ইতিহাস, বিপ্লবের ইতিহাস, বিজয়ের ইতিহাস। এর মাঝেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। এরও থাকবে বিজয়ের ইতিহাস। যখন ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৫টি ছবি মুক্তি পেল। প্রদর্শকেরা হতাশ হলেন, একমাত্র মারুফের চ্যালেঞ্জ কিছুটা আলোর ঝলকানি দেখাতে পারলেও বিগ স্টার, বিগ বাজেট এমনকি ভারতীয় আমদানি করা ছবিগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ল। চলচ্চিত্র নামক শিল্পকলার এতটা পতন চলচ্চিত্রকর্মীদের এক অনিশ্চিত শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিল।
কিন্তু এবার ঈদ উৎসবে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো চলচ্চিত্রজগতে এক নতুন প্রাণবন্যা বইয়ে দিয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ থেকে প্রেক্ষাগৃহবিমুখ দর্শক এবারের ঈদে সপরিবারে প্রেক্ষাগৃহে গেছেন। এমনকি বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ আবার চালু হয়েছে। টিকিটের জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। বিজয়ের আনন্দধ্বনিতে মুখর এখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণক্ষেত্র বিএফডিসি। আনন্দে সংযুক্ত শিল্পী, কুশলী, অর্থলগ্নিকারক থেকে চলচ্চিত্রশিল্পে দৈনিক ভাতা পাওয়া কর্মীরাও। বিজ্ঞজনেরা কী বলেছেন এই সাফল্যে, উৎসব-পার্বণে এমন সাফল্যের খবর অতি পুরোনো ঘটনা। ঈদ এলে অবসর বেশি থাকে, দর্শক আনন্দ করতে হলে যায়। সব সময় প্রেক্ষাগৃহ দর্শকভর্তি রাখতে ভালো চলচ্চিত্র প্রয়োজন, নতুনত্ব প্রয়োজন। তথাকথিত যাঁরা এ দেশে ভারতীয় ছায়াছবির আমদানিকারক, তাঁরা বলছেন, এই ভালোর ধারা অব্যাহত রাখতে হবে এবং যথেষ্ট পরিমাণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।
আমাদের লেখায় এই পর্যন্ত বর্ণিত তথ্যগুলো ছিল মহানগর ঢাকায় বসবাসকারী সিনেমা দর্শক, প্রদর্শক অথবা সিনেমাসংশ্লিষ্ট ভাবুকজন, সিনেমাচর্চিত বোদ্ধাজনের বক্তব্য।
তবে প্রথম আলোর তাগিদেই আমাদের তথ্য সংগ্রহকারীরা ঘুরে বেড়িয়েছেন মফস্বল শহরগুলোতে। উদ্দেশ্য একটাই, ঈদ উৎসব এবং বাংলাদেশের সিনেমা। যেখানে পাওয়া হিসাবমতে, এক হাজার ২০০ সিনেমা হলের মধ্যে ৬১২টির অস্তিত্ব টিকে আছে; সেখানে এবার ঈদে প্রায় ১৫০টি প্রেক্ষাগৃহে দর্শকেরা নতুন ছবি দেখছে। মুক্তি পাওয়া পাঁচটি ছবির মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে মোস্ট ওয়েলকাম, খোদার পরে মা এবং সে আমার মন কেড়েছে। তিনটি ছবি পছন্দের কারণগুলো দর্শকদের রুচি, চাহিদা, পছন্দের তাপমাত্রায় বিভাজিত। খোদার পরে মা প্রচলিত প্রথাগত গল্প, চিরন্তন বাঙালি সমাজে মায়ের জন্য উচ্চাসন এটা যেন মধ্যবিত্ত আবেগী এক বৃত্ত। এর সঙ্গে যুক্ত নামীদামি তারকা, যদিও নাচ-গানে নতুন কিছুই দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তবে নির্মাণশৈলী, বাংলা চলচ্চিত্রের কিং খানের মুখে জোরালো, রসাল সংলাপে দর্শকেরা বিনোদিত হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক-বয়সী আবেগে তাড়িত ছিল নায়িকার দেহ প্রদর্শন। তবুও ভালো। সেই কয়েদিদের মতো লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে হাত মুঠি করে, রীতিমতো কসরত করে টিকিট সংগ্রহ। এবং টিকিট সংগ্রহে কাউন্টারের ছিদ্র খুপরিপথে টিকিট-মুষ্টিবদ্ধ হাত বের করতে জখম হওয়ার যন্ত্রণা মাটি করে দেয়নি খোদার পরে মা। বাঙালি বাবার চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসে বলেই রিকশা ও বেবিট্যাক্সির সাইনবোর্ডে দেখা যায় ‘মায়ের দান’, ‘মায়ের দোয়া’। সেখানে খোদার পরে মা সার্থক। মোস্ট ওয়েলকাম ছবিটির নামের সঙ্গে গল্পের আঙ্গিকগত বিন্যাস অথবা কাহিনির গতিপথে তেমন সংগতিসূত্র খুঁজে না পেলেও প্রযোজকের ভাষ্য, যা কিছু নান্দনিক যা কিছু মঙ্গলময়, সেটাই মোস্ট ওয়েলকাম। আমরা বাঙালিরা বাংলাদেশটাকে যতটা ভালোবাসি তার চেয়ে বেশি ভালোবাসি বিদেশি পণ্য অথবা বিদেশি শিল্পী-কুশলীর দক্ষপনা(?)। মোস্ট ওয়েলকাম সাফল্যে তেমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, বিদেশি শিল্পী, কুশলী এবং তাঁদের নামের শেষে ক্যাপিটাল লেটারে দেশের নাম, বাংলাদেশের স্বপ্নতাড়িত দর্শকদের জন্য বেশ সিদ্ধার্থ শঙ্করের কাজ করেছে। বিদেশ মানেই শ্রেষ্ঠ কিছু। তবুও বলা যায়, মোস্ট ওয়েলকাম ছবিটি একজন নতুন নির্মাতার জন্য যথেষ্ট পরিপুষ্ট, নাচ, গান, পোশাক, দৃশ্যায়ন, পটভূমি নির্বাচনে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্রাফিকস অ্যানিমেশনযুক্ত দৃশ্যকল্পের ব্যবহার, যা একটি আধুনিক ছবির গুণগত মাত্রায় ফেলা যায়। এ কথা স্বীকার্য, দর্শকদের রুচি, চাহিদা ভিজ্যুয়াল দৃষ্টিগ্রাহ্যতা পেছনের যুগে নেই। মার্কিন পরিচালক জর্জ লুকাস, স্টিভেন্স স্পিলবার্গ, জেমস ক্যামেরন দর্শকদের বৈজ্ঞানিক কল্পনারেখাকে আরও যুক্তিসংগত এবং সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। মোস্ট ওয়েলকাম ছবিতে নায়কের স্ট্যান্ট দৃশ্য দর্শকের দৃষ্টিগ্রাহ্য ছিল বটে।
এ দেশের একজন অভিজ্ঞ পরিচালকের সে আমার মন কেড়েছে ছবিটির নামে আধুনিকীকরণ না থাকলেও টেলিভিশনের পর্দা থেকে বারবার ঘটা করে এসে যাওয়া তিন্নিকে যথাযথভাবে চলচ্চিত্রের পর্দায় উপস্থাপন করেছেন পরিচালক। তিন্নির পোশাক-পরিচ্ছদ আরও আধুনিক আশা করলেও তাঁর স্মাইল এক্সপ্রেশন সাধারণ দর্শককে মুগ্ধ করেছে। চিত্রনাট্যের গতি এবং সংলাপের কারণেই সে আমার মন নয়, দর্শকদের মন কেড়েছে।
এই তিনটি ছবি ছাড়াও ঢাকা শহরে ঈদ উপলক্ষে প্রদর্শিত ছবি স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য হান্টসম্যান, আভেঞ্জারস, ঢাকার কিং, তুমি আসবে বলে, মাই নেম ইজ সুলতান।
ঈদের প্রতিটি ছবি ভালো চলছে, তার পরও প্রবীণ বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ চলচ্চিত্রজনেরা বলেই যাচ্ছেন, চলচ্চিত্রের নীতিমালা নেই, নগ্নতা চলচ্চিত্রকে গ্রাস করে ফেলেছে, মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে, সবচেয়ে বড় সমস্যা এফডিসি ও সরকার, হলে পরিবেশ নেই, সিনেমা পাইরেসি, চলচ্চিত্রে গবেষণা-প্রশিক্ষণের অভাব, নেতৃত্বের অভাব, দর্শকদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে, শিল্পীসংকট, প্রেক্ষাগৃহসংকট, নকলের দৌরাত্ম্য। এতসব সংকট, পরস্পর সংঘাত মানেই—নাই সিনেমা। না সিনেমা।
চলচ্চিত্রের শিকড়মূলেই শুধু কি সংকট? নতুন নির্মাতারা বলেছেন চলচ্চিত্রের এখন ভাঙচুরকাল। সংকটের দুয়ারেই সম্ভাবনা দাঁড়িয়ে আছে।
এবারের ঈদের ছবির ব্যবসা সাফল্য, দর্শকসমাগম এবং শিল্পী-কুশলী সাধারণ কর্মীদের আনন্দ-উল্লাস এটাই প্রমাণ করে, সিনেমা আছে। সিনেমা থাকবে। সৈয়দ শামসুল হকের কথায় বলা যায়:
‘সেই কতকাল থেকে আছো তুমি আমার হূদয়ে—
কেবল হূদয়ে নয়, শরীরেও প্রতিটি বিতানে
তোমার সম্মতি দানে আছো তুমি গন্ধমাখা হয়ে—
এসব নিবিড় কথা কতটুকু মানুষ কি জানে।’
তাই এই সমষ্টিসর্বস্ব শিল্প নিয়ে আর অহেতুক কোলাহল নয়, হিংসা, বৈরিতা নয়, আত্মতৃপ্তির প্রমাদমগ্নতা নয়। আমরা যাঁরা চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবি, ভাবনায় রাখি, ভালোবাসায় বাঁধি, তাঁদের জন্যই বলা; কোনো পপুলার সিনেমা নয়, প্যারালাল সিনেমা নয়, বিকল্প ধারার সিনেমা নয়—সিনেমা, শুধু সিনেমা। কোনো শ্রেণীর জন্য আলাদা উপজাত ভাবনা নয়। সিনেমা আপনার, আমার—সবার জন্য। সিনেমা দর্শকদের জন্য। সব ভারসাম্যহীন ভাবনার ত্যাগ হোক।
বাংলাদেশের সিনেমা এখনো বেঁচে আছে। এবারের ঈদ উৎসবে আবারও তা প্রমাণ হলো। বেঁচে থাকা শতাধিক বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্বপ্রাণে রাখা সব সিনেমাকর্মীর কংক্রিট ভাবনা হোক।
তথ্য সংগ্রহ: স্টামফোর্ড ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের ছাত্রছাত্রী টিম লিডার ফারহান শাহরিয়ার।

No comments

Powered by Blogger.