কম বৃষ্টিতে আমন চাষ নিয়ে বিপদে কৃষক-এখনো ১২ লাখ ১৯ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি by আশরাফুল হক রাজীব

এই বর্ষা মৌসুমে দেশের অনেক স্থানে পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে আমন চাষ ও পাট নিয়ে বিপদে পড়েছেন কৃষক। পানির অভাবে তাঁরা ধানের চারা লাগাতে পারছেন না। আবার কাঁচা পাটও পচাতে পারছেন না। বৃষ্টির অপেক্ষা করতে করতে আমন লাগানোর মৌসুমও প্রায় শেষ হওয়ার পথে।
এখনো ১২ লাখ ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমন রোপণ করতে পারেননি কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরকার ৫২ লাখ ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত ৪০ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়েছে। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমন লাগানোর সময় থাকলেও শেষ সময়ে লাগানো ধানের চারায় ভালো ফলন হবে না। এ জন্য কৃষক তাড়াহুড়ো করে সেচ দিয়ে আমন রোপণের চেষ্টা করছেন। এতে তাঁদের খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশে সব ধরনের ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষক ফসল ফলিয়ে লাভ করতে পারছেন না। ভালো ফলনের ফলে মানুষ কম দামে চাল কিনতে পারলেও যাঁরা ফসল ফলিয়েছেন তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। প্রায় তিন কোটি মানুষ সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত। এই বিপুল জনগোষ্ঠী ধানের উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না। শুধু ধান নয়, পাটসহ বেশির ভাগ ফসলেই কৃষকের এ অবস্থা। অথচ কৃষি খাতে রয়েছে দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৪৮ ভাগ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল লতিফ গত রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমন ফসল বৃষ্টিনির্ভর। সারা দেশে একই মাপের বৃষ্টি হয় না। কোথাও কম, কোথাও বেশি হয়। এই অবস্থায়ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারব। আমন লাগানোর জন্য আরো কিছু দিন সময় আছে। এরই মধ্যে আমন লাগানোর কাজ শেষ হবে।'
জানা গেছে, আমন দেশের মূল ফসল। সবচেয়ে বেশি জমি চাষ করা হয় এ মৌসুমে। ইরি-বোরোর ফলন বেশি হলেও কম জমিতে চাষ হয়। কারণ ইরি-বোরোতে সেচ খরচ রয়েছে। গত ইরি-বোরো মৌসুমে ফলন হয়েছে প্রায় ৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে। অথচ চলতি আমন মৌসুমে ৫২ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ আষাঢ়-শ্রাবণ শেষ হয়ে ভাদ্রের মাঝামাঝিতে পর্যাপ্ত বৃষ্টির দেখা পাচ্ছেন না কৃষক। অন্যান্য বছরের তুলনায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কেমন জানতে চাইলে আবহওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আরজুমান্দ হাবীব কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরই বৃষ্টির পরিমাণ কমছে। তবে বৃষ্টির দিন এখানো শেষ হয়নি। সেপ্টেম্বর মাসজুড়েই বৃষ্টি হবে। সেই বৃষ্টিকে কাজে লাগাতে হবে।
গত শুক্রবার গাজীপুরের কাপাসিয়ার তারাগঞ্জ গ্রামের কৃষক মোক্তার হোসেন বলেন, 'ভাদ্র মাসেও বৃষ্টির পানি পাচ্ছি না। যে পরিমাণ বৃষ্টি হয় তাতে কোনো লাভ হয় না। ধানের চারা রোপণ করার জন্য জমিতে যে পরিমাণ পানি দরকার তা পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু জমিতে সেচ দিয়ে ধানের চারা রোপণ করেছি। প্রতি ঘণ্টায় ১০০ টাকা দরে জমিতে পানি দিয়ে পোষাচ্ছে না। যেখানে পানির জন্য এক টাকাও খরচ করার কথা নয়, সেখানে এত বেশি টাকা খরচ করে আমরা উৎপাদন ব্যয় তুলতে পারব না। গত মৌসুমেও ধান উৎপাদনে যে ব্যয় হয়েছে তার টাকা তুলতে পারিনি। তা ছাড়া এবার পানিও সহজলভ্য না। সাধারণত ইরি-বোরো চাষের সময় সেচের ব্যবস্থা করা হয়। তখন ড্রেনেজ ব্যবস্থা সচল করা হয়। কিন্তু এখন তো ড্রেনেজ ব্যবস্থা সচল নেই। তারপরও শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে ডিজেলের মাধ্যমে সেচ দিয়ে জমিতে আমন রোপণ করলেও দু-একদিন পরেই মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কিছু জমিতে সেচ দিয়ে আমন লাগানো হলেও পানির অভাবে চারাগাছ বিবর্ণ হয়ে গেছে। দু-একদিনের মধ্যে ভারি বৃষ্টি না হলে ফসলের আশা নেই।
একই দিনে নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার পাড়াতলা গ্রামের কৃষক মনু মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুধু আমন ধান নিয়েই বিপদে নেই। পাট পচানো নিয়েও ঝামেলার মধ্যে রয়েছি। খালেবিলে পানি নেই। পাট জাগ দিতে পারছি না। কিছু জমির পাটগাছ শুকিয়ে গেছে।'
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের বেশির ভাগ এলাকায় পাট কাটা শেষ। পাট শুকানো নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে কৃষকের। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গায় পুকুর-খাল-বিলে পানি না থাকায় জমির পাট কাটতে পারছেন না তাঁরা। এ ছাড়া পাটগাছের গোড়ায় পচন রোগও আছে। জাগ দিতে না পেরে সংকটে পড়ছেন কৃষক। পাট পচানোর সংকট থেকে বের হয়ে আসার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় রিবন রেটিং পদ্ধতিটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে সাফল্য এলেও দেশের বেশির ভাগ এলাকায় এখনো রিবন রেটিং পদ্ধতি পৌঁছেনি। এ কারণে পাট কাটা ও পচানো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। এ ছাড়া এবার পাটের বাজারদরও কম। টানা তিন বছর পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ও আয় বেড়েছিল। তখন পাটের ভালো দাম পেয়েছেন কৃষক। পাটের আন্তর্জাতিক বাজার এখন মন্দা। ২০১০-১১ অর্থবছরে পাট রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১১৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত ২০১১-১২ অর্থবছরে তা নেমে দাঁড়ায় ৯৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারে। মূলত কাঁচা পাট রপ্তানি করে রপ্তানি আয়ের বড় একটা অংশ আসে। অথচ কাঁচা পাট রপ্তানি ৩১ শতাংশ কমেছে। সব কিছুর মূল্য দিতে হচ্ছে পাটচাষিদের। মৌসুমের শুরুতে পাটের বাজার কিছুটা চাঙ্গা হলেও এখন আবার পড়তির দিকে। তখন বাজারে প্রতিমণ পাট ছিল ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। এখন তা আরো কমেছে। গত সপ্তাহে ছিল ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। গত বছরও এই পাটের দাম ছিল দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। কৃষক শুধু দামের দিক থেকেই মার খাচ্ছেন না, তাঁদের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। কৃষি শ্রমিকেরও অভাব দেখা দিয়েছে। তাঁদের পারিশ্রমিক বেড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পাট নিয়ে দেশে যে সোনালি দিনের স্বপ্ন রচিত হওয়ার কথা ছিল, সে আশা কখনোই পূরণ হবে না। ২০১০ সালে দেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় পাটের জীবন রহস্য উন্মোচিত হওয়ার পর মানুষ নতুন করে পাট নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের পাটের প্রধান ক্রেতা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বিশেষ করে মিসর, ইরান, সিরিয়া ও লেবানন প্রতিবছর অনেক পাট ও পাটজাত পণ্য আমদানি করে। এবার ওই সব দেশে রাজনৈতিক সংকটে তা সম্ভব হচ্ছে না। আর এ কারণেই দেশে চাষিরা পাটের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।

No comments

Powered by Blogger.