মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার-২০১১-তারা ঝলমল জাঁকালো আয়োজন by আশীষ-উর-রহমান

তারকাদের অবস্থান চিরকালই সুদূর। সাধারণ মানুষ তাঁদের দিকে তাকান প্রীতি ও বিস্ময়ভরা চোখে। কাছে পেলে ব্যাকুল হন সঙ্গ লাভে। আনন্দে হন আত্মহারা অনেকে। তা-ই হয়েছিল গতকাল বৃহস্পতিবার। দেশের সংস্কৃতিজগতের এমনই সব তারকাকে কাছে পেয়েছিলেন তাঁদের অনুরাগীরা।


রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমের জাঁকালো মঞ্চে দ্যুতি ছড়িয়েছেন এই নক্ষত্রবীথি। বিমোহিত হয়েছেন উপস্থিত দর্শকেরা। উপলক্ষটি ছিল চতুর্দশ মেরিল-প্রথম আলো তারকা জরিপের চূড়ান্ত পর্বের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান।
রাতের অন্ধকারে রঙিন আলোর সাজে ফুটে উঠেছিল মঞ্চের মনোহারিত্ব। সেখানে গাওয়া হলো গৌরবময় ভাষার গান, রবীন্দ্রনাথের চিরায়ত সুর ছড়াল সুষমা। বিগত দিনের সিনেমার জনপ্রিয় স্মৃতিমেদুর গানের সঙ্গে ছিল অনুপম নৃত্যের ছন্দ। সরস কথোপকথন, অভিনয় আর পুরস্কার দেওয়া-নেওয়ায় কী অনবদ্যই না ছিল এই আয়োজন!
অবশ্য এটা এখন সবারই জানা যে প্রতিবছর দেশে যত আনন্দঘন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে, মেরিল-প্রথম আলো তারকা জরিপের এই চূড়ান্ত পর্বের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানটি তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হয়ে উঠেছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ, অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, চমকপ্রদ বিষয়ের নির্বাচন, পরিবেশনার নান্দনিকতা, মার্জিত রুচির সমন্বয়ে যথোচিত বর্ণাঢ্য সাজসজ্জা—সর্বোপরি সামগ্রিক অনুষ্ঠানের সুশৃঙ্খল পারিপাট্য এই আয়োজনটিকে অনন্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সন্ধ্যায়। সংক্ষিপ্ত সূচনা পর্ব। প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক মঞ্চে এসে দর্শকদের স্বাগত জানান। স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, শিল্প, সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সবাইকেই আমরা সম্মানিত করতে চাই। গুম, হত্যা, হরতালের মধ্য দিয়ে আমরা এক ধূসর সময় অতিবাহিত করছি। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চাই। আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। শিল্পীরা সেই অগ্রযাত্রায় প্রেরণা জোগান, স্বপ্ন দেখান। তাই তাঁদের সম্মানিত করতেই আমাদের এই কর্মপ্রয়াস।
বাজতে থাকে অনুষ্ঠানের সূচনা সংগীত। স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিদেশে থাকায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। তাঁর ধারণ করা বক্তব্য পর্দায় দেখানো হয়। তিনি দর্শক ও শিল্পী-কলাকুশলী এবং অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত সবাইকে অভিনন্দন জানান।’ ব্যস, এর পরই সেই বহুল প্রতীক্ষিত অনুষ্ঠানের মূল পর্ব।
মঞ্চ অন্ধকার। চুপচাপ। নৈঃশব্দ ভেঙে দেয় হেলিকপ্টারের শব্দ। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মঞ্চের দুই পাশের পর্দা। বাতাসের প্রবল আলোড়ন। যান্ত্রিক পতঙ্গটি মাটিতে নামার পর মেলে যায় তার দরজা। ধীরগতিতে বেরিয়ে আসেন চঞ্চল চৌধুরী। সাহেবি পোশাক। চোখে রোদচশমা। ডানে-বাঁয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে নেন জায়গাটির ওপর। অতঃপর কপ্টার থেকে বেরিয়ে আসেন অনুরূপ কেতাদুরস্ত পোশাকে সজ্জিত নুসরাত ইমরোজ তিশা। নেপথ্যে বাজতে থাকে সংগীত সুরমূর্ছনা।
তারপর অকস্মাৎ পর্দা থেকে মিলিয়ে যায় সেই দৃশ্য। ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে ওঠে মঞ্চ। খঞ্জ ভিক্ষুকেরা যেমন তক্তার সঙ্গে বিয়ারিং লাগানো গাড়িতে চড়ে চলাফেরা করেন, তেমনি গাড়িতে করে তাঁদের দুজনকে মঞ্চে প্রবেশ করতে দেখা যায়। তাঁরা নিজেরাও যেন খানিকটা বিভ্রান্ত। দর্শকদের অভিনন্দন জানিয়ে তিশা জানতে চান চঞ্চলের কাছে, তাঁরা রওনা দিয়েছিলেন হেলিকপ্টারে, কিন্তু তারপর এই হাল কেন?
চঞ্চল জানান, ঢাকার পথে যানজটের যে অবস্থা, তাতে আকাশপথে না এলে সময়মতো পৌঁছানো অসম্ভব। তবে হেলিকপ্টার কেমন করে ঠেলাগাড়ি হয়ে গেল, সেটা তাঁর কাছেও রহস্যময়।
এমন সময় আবার সচল হয়ে ওঠে পর্দা। সেখানে দেখা যায় মোশাররফ করিমকে; চঞ্চলকে সদা চঞ্চল না হয়ে ধীরস্থির হওয়ার উপদেশ দিয়ে জানান, কপ্টারের ঠেলাগাড়িতে রূপান্তরের রহস্য তিনি উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন। কপ্টারে আগমনটি ছিল বিজ্ঞাপন, আর ঠেলাগাড়ি হলো নিদারুণ বাস্তবতা। এরপর দর্শকদের কাছে নিজের পরিচয় তুলে ধরে জানালেন, তিনি হলেন এই অনুষ্ঠানের ‘ডিজিটাল উপস্থাপক’। মাঝে মাঝে এসে দেখা দিয়ে যাবেন।
অনুষ্ঠান এগিয়ে যেতে থাকে। এবার মহান ভাষা আন্দোলনের ছয় দশক পূর্ণ হলো। ভাষাকে মূল ভাবনা করে শিবলী মহম্মদ ও শামীম আরা নীপার নেতৃত্বে নৃত্যাঞ্চল এবং জার্মানি, জাপান ও ইন্দোনেশিয়ার শিল্পীরা পরিবেশন করেন একটি চমৎকার নৃত্যালেখ্য। এতে ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গানটি পরিবেশিত হয় চারটি ভাষায়। এর সঙ্গে ‘কুমড়ো ফুলে ফুলে’ কবিতা, ভাষার গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’—এসব নিয়ে গ্রন্থনা করা হয়েছিল নৃত্যালেখটি। এর সংগীত আয়োজন করেছিলেন ইবরার টিপু। পুরস্কার বিতরণের পালা এরপর শুরু।
এবার আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় বরেণ্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর হাতে সম্মাননা স্মারক, অর্থমানের এক লাখ টাকার চেক ও উত্তরীয় তুলে দেন। সঙ্গে ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও স্কয়ার টয়লেট্রিজের নির্বাহী পরিচালক আশিকুল হক চৌধুরী।
মুস্তাফা মনোয়ার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, প্রথম আলো এই অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাতির সাংস্কৃতিক জীবনকে নতুন বোধ ও প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের এই চেষ্টা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সম্মাননার পর হয় গত চার দশকের জনপ্রিয় সিনেমার গান নিয়ে একটি মনোজ্ঞ পরিবেশনা। ‘সব সখীরে পার করিতে’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘খায়রুন লো’ এবং ‘প্রেমী ও প্রেমী’ গানগুলোর সঙ্গে সমবেত নৃত্য পরিবেশন করেন শাহেদ, নিপুণ, নীরব, সারিকা, ইমন, শখ, শুভ ও মীম। সংগীত আয়োজন করেন আলী আকরাম।
তারকাদের পুরস্কার দেওয়ার পর্ব শুরু হয় এরপর। সমালোচকদের রায়ে সেরা টেলিভিশন চিত্রনাট্যকার, টেলিভিশন নির্দেশক এবং টিভি নাট্যশিল্পী নারী ও পুরুষ বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়।
ব্যতিক্রমী একটি পরিবেশনা ছিল এই পর্যায়ে। পর্দায় দেখানো হয় বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্যরা ‘অসাংবিধানিক’ যে কর্মকাণ্ড করেছেন, তার কিছু টুকরো দৃশ্য। তাঁরা মারপিট করছেন। কারও নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। টেবিল-চেয়ার তছনছ। গালিগালাজের তুবড়ি ছুটছে মুখ দিয়ে। এসব দৃশ্যের সঙ্গে ‘কোলাবেরি ডি’ গানের অনুসরণে ‘আমরা এই কাজ করি না’ গানের সঙ্গে মঞ্চে তুষার খান, শহীদুল আলম সাচ্চু, শিরিন বকুল, শামীমা নাজনীন, সাজু খাদেম, শামীম জামান ও মজনুন মিজানের নৃত্য। উপস্থাপকেরা জানান, এসব দৃশ্যের তুলনায় আমাদের দেশের সাংসদেরা অনেক মার্জিত এবং সুশীল আচরণই করে থাকেন সংসদে।
আসলে মেরিল-প্রথম আলোর এই অনুষ্ঠানটি নিছক বিনোদনের মধ্যেই সীমিত থাকেনি; আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি এতে বিদ্যমান সমাজ-বাস্তবতার নানা অসংগতি, আশা ও আশাভঙ্গের বেদনা কখনো নির্মল হাস্য-রসাত্মকভাবে কখনো তীক্ষ বিদ্রূপে উপস্থাপন করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য এসব অসংগতি দূর হোক। অর্থময় হয়ে উঠুক জীবনযাত্রা।
টেলিভিশনের পর সমালোচকদের রায়ে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার। এ পর্বে ছিল বিশেষ পুরস্কার, সেরা চলচ্চিত্র, পরিচালক, অভিনয়শিল্পী নারী ও পুরুষ।
এবার মঞ্চে এলেন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তারকা ফেরদৌস ও মৌসুমী। ‘এত ভালোবেসো না’ ও ‘আমি তোমার মনের ভেতর’ গান দুটির সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন তাঁরা। তার পরই শুরু হয় তারকা জরিপ পুরস্কারের পালা।
তারকা জরিপে সেরা কণ্ঠশিল্পী নারী ও পুরুষের পর মঞ্চ যেন হয়ে গেল ক্রিকেট মাঠ। আশরাফুল, নাসির, মাশরাফিদের সঙ্গে ঈশানা, স্বর্ণা মাশিয়াত। ব্যাটিং-বোলিংয়ের সঙ্গে ‘পোলা তো নয় যেন আগুনের গোলা’ এবং ‘ও টুনির মা’র মতো গান। বলা বাহুল্য, অনুরূপ নৃত্যও ছিল সঙ্গে। সবটা মিলিয়ে টি-টোয়েন্টি ধাঁচেরই ধুন্ধুমার এক পরিবেশনা। সেই উন্মাতাল আবহ স্তিমিত হয়ে আসতে না আসতেই তারকা জরিপের বাকি পুরস্কার বিতরণী। চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনের সেরা অভিনয়শিল্পী নারী ও পুরুষ বিভাগের পুরস্কার বিতরণী ও শেষ পরিবেশনা।
মিনু হক ও তাঁর দল এবং সজীব ও তাঁর দলের শিল্পীরা ‘আমরা নতুন যৌবনের দূত’ গানের সঙ্গে পরিবেশন করেন সৃজনশীল নৃত্য।
পুরস্কার বিতরণী ও বৈচিত্র্যময় এসব পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চে চঞ্চল ও তিশা এবং পর্দায় মোশাররফ করিম তাঁদের সরস কথোপকথন, অনবদ্য অভিনয়, মেরিল-প্রথম আলোর আগের অনুষ্ঠানের টুকরো দৃশ্য—এসব মিলিয়ে পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ্য করে তুলেছিলেন দর্শকদের কাছে। কয়েক দিন ধরেই সন্ধ্যার পর বৃষ্টি হচ্ছিল। কাল হয়নি। দর্শকেরা ফিরেছিলেন আনন্দস্নাত হয়ে।

No comments

Powered by Blogger.