ধান-পাটের পর আলু-পেঁয়াজ-সবজিরও দাম পাচ্ছেন না চাষি, উৎপাদন বেশি হলেও খরচ উঠছে না-কৃষকের মাথায় হাত by ইফতেখার মাহমুদ

ধান, পাট, আলুর পর এবার সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। উৎপাদন বাড়লেও দাম পাচ্ছেন না কৃষক। আবার কৃষকের কাছে কম দামে পণ্য কিনে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। চাল, আলু থেকে শুরু করে সব ধরনের কৃষিপণ্যের দাম গত এক মাসে ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। আলু ও সবজি কৃষক পর্যায়ের তুলনায় তিন গুণ বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে।


মাঠপর্যায়ে ধানের দাম নিয়মিতভাবে কমলেও চালের দামের ঊর্ধ্বগতি থেমে নেই। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক মাসে চিকন ও মোটা চালের দর ৩ থেকে ৮ শতাংশ বেড়েছে।
অনুকূল আবহাওয়া আর গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় আরও উৎসাহ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন কৃষক। ফলনও আগের যেকোনো বছরের তুলনায় ভালো। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এবার গত বছরের তুলনায় সাত লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন বেশি সবজি উৎপাদিত হয়েছে। আলুর ফলনও গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ লাখ টন বেশি।
কিন্তু দাম পড়তির দিকে। বিশেষ করে, আলু ও শীতকালীন সবজি মাঠপর্যায়ে পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। আলু বেচে হিমাগারে রাখার খরচ ও চটের দামও উঠছে না কৃষকের। অনেকে হিমাগারের পাশে আলু এবং হাটে সবজি ফেলে চলে যাচ্ছেন। কৃষকেরা বলছেন, গত পাঁচ বছরের মধ্যে আলু ও সবজির এমন দুর্দিন আর আসেনি।
পাটের বাজারও মন্দা। সরকারি পাটকলগুলোতে প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার পাট অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। তাই নতুন পাট কেনাও বন্ধ। পাটের উৎপাদন খরচ ও দাম প্রায় সমান হয়ে গেছে। প্রতি মণ নিম্নমানের পাট গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ এক হাজার টাকার নিচে নেমে এসেছে।
ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ সাজ্জাদ জহীর এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতিবিদেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শহুরে ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর চেষ্টা করেন। কয়েক বছর ধরে বেশির ভাগ কৃষিপণ্যের দাম বাড়ায় কৃষিমজুর ও শহুরে দিনমজুরের পারিশ্রমিক বেড়েছিল। কিন্তু এখন কৃষিপণ্যের দাম কমায় কৃষকের স্বার্থকেও বিবেচনায় আনতে হবে। নইলে কৃষক উৎপাদন কমিয়ে দেবেন।
আলু নিয়ে বিপদ: সাধারণত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাজারে নতুন আলু ওঠা শুরু করে। তার আগে পুরোনো আলু শেষ হয়ে যায়। গত বছরের তুলনায় এবার আলুর ফলন ভালো হয়েছে। সরকারি হিসাবে এবার ৮৩ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন আলু হবে। তবে বেসরকারি হিসাবে আলু উৎপাদনের পরিমাণ এক কোটি টনের কাছাকাছি পৌঁছাবে।
বাংলাদেশ হিমাগার অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, এ বছর এখনো হিমাগারগুলোতে দুই লাখ বস্তা আলু রয়ে গেছে। দাম কম হওয়ায় কৃষক ওই আলু আর ফেরত নিচ্ছেন না। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি থেকে হিমাগারে নতুন আলু আসা শুরু করবে। তাই হিমাগারের মালিকেরা পুরোনো আলু হিমাগারের বাইরে ফেলে দিচ্ছেন।
হিমাগারের গেটে ৮০ কেজি ওজনের এক বস্তা আলু ৮০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটি নতুন চট ও পরিবহন খরচ যোগ করলে প্রতি কেজি আলুর দাম দাঁড়ায় এক টাকারও কম। নতুন ওঠা আলুর দাম গত কয়েক বছরে ১৫ টাকার নিচে নামেনি। এবার পাঁচ টাকার ওপরে উঠছে না।
তবে টিসিবির হিসাবে গত মাসে প্রতি কেজি আলুর দাম ৮ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। চলতি মাসে তা ১২ থেকে ১৫ টাকা। বাংলাদেশ কন্দাল (আলুজাতীয়) গবেষণাকেন্দ্রের হিসাবে প্রতি কেজি আলুর এবার উৎপাদন খরচ পড়েছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। দু-তিন হাত ঘুরে হিমাগারের খরচ জুগিয়ে বস্তা ও পরিবহন খরচ যোগ করে প্রতি কেজি আলু ১০ টাকায় বিক্রি করতে না পারলে কৃষকের লোকসান হবে বলে সংস্থাটির এক হিসাবে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ হিমাগার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আলুচাষি ও হিমাগারের মালিক গত কয়েক বছরের মধ্যে এতটা বিপদে কখনো পড়েননি। বেসরকারি উদ্যোগে এ বছর প্রায় দুই লাখ টন আলু রপ্তানি হয়েছে। সরকার উদ্যোগ নিয়ে আলু রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে পারলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা এতটা সমস্যায় পড়তেন না।
পেঁয়াজের ঝাঁজ কম: প্রায় প্রতিবছরই পেঁয়াজ নিয়ে বাজারে সংকট দেখা দেয়। গত বছর পেঁয়াজের দর প্রতি কেজি ৪৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ভালো দাম পাওয়ায় এ বছর কৃষক অতিরিক্ত সাত হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছেন। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে পেঁয়াজের দাম কমতে কমতে চলতি সপ্তাহে ১৫ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
টিসিবির হিসাবে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৫ থেকে ২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দর ৩৫ শতাংশ কমেছে। আর এক বছরে কমেছে ৫৫ শতাংশ। দেশের চাহিদার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) কৃষি অর্থনীতি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি কেজি পেঁয়াজের মাঠপর্যায়ে উৎপাদন খরচ পড়েছে ১১ টাকা। পরিবহন ও সংরক্ষণ খরচ যোগ করলে প্রতি কেজি পেঁয়াজের পেছনে কৃষকের খরচ হচ্ছে ১৫ টাকারও বেশি। দাম কম পেলে পরবর্তী বছর কৃষক আমদানিনির্ভর এই কৃষিপণ্যের উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারেন।
শীতের সবজির বাজার ঠান্ডা: শীতকালীন সবজির অবস্থা আরও খারাপ। গত পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে এত কম দামে সবজি বিক্রি হয়নি। বিশেষ করে, টমেটো ও ফুলকপির দাম এবার সবচেয়ে কম। কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি টমেটো দুই থেকে তিন টাকায়, একেকটি ফুলকপি এক থেকে তিন টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একেকটি লাউ বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ টাকা করে। অথচ বাজারে দাম তিন থেকে চার গুণ বেশি।
বারির হিসাবে এক কেজি টমেটোর উৎপাদন খরচ দুই টাকা ৫৯ পয়সা। তবে পরিবহন ও সংরক্ষণ খরচ যোগ করলে এক কেজি টমেটোতে কৃষকের খরচ পড়ে আট টাকা, আর কৃষক বিক্রি করছেন তিন-চার টাকায়।
ধানের বাজার থেমে আছে: দুই মাস ধরে ধানের দাম পড়তির দিকে, তবে এক সপ্তাহ ধরে দাম কিছুটা স্থির। আমন ধানে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার দুই লাখ টন চাল কিনেছে। কিন্তু এতে কৃষকের লাভ হয়নি, মুনাফা গেছে চালকল মালিকদের পকেটে।
কারণ, সরকারিভাবে চালকল মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি চাল কেনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার পরামর্শ দিলেও খাদ্য বিভাগ তা আমলে নেয়নি। ফলে ধানের দাম এখনো কৃষকের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি। আবার ধানের দাম কম হলেও চালের দাম কিন্তু বেড়েই চলেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৫৫০ টাকা। আর তা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। টিসিবির হিসাবে বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল গত মাসের তুলনায় ৩ শতাংশ বেড়ে ৩২ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের চালের দর প্রায় ৯ শতাংশ বেড়ে ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ডিজেলের মূল্য কয়েক দফা বৃদ্ধি এবং দেশের যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কৃষিপণ্যের পরিবহন খরচও বেড়েছে। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা জেলা পর্যায়ে বা বড় হাটে পণ্য না এনে স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে এত দিন কৃষিপণ্যের উৎপাদন যে হারে বাড়ছিল, সামনের দিনগুলোতে সেই হারে কমতে থাকবে। এতে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.