ভগ্নপ্রাসাদের জিগরে খুন by মঈনুস সুলতান

নাদিয়া আনজুমান একজন কবি। কিন্তু কবিতা রচনাই তাঁর জন্য একদিন কাল হলো। কবিতায় দেহজ কামনার ইঙ্গিত থাকায় স্বামীর হাতে প্রাণ দিতে হলো তাঁকে... আমি কসর দারুল আমান বলে একটি প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তার পশ্চাৎপটে যেন তুষারের চাষাবাদ হচ্ছে। বরফের সফেদ জমিনে প্রাসাদের প্রতিবিম্ব হারানো জামানার অলীক কোনো কেস্সার মতো ভাসে। দারুল আমানের কেস্সা অনেক।


সত্তর-আশি বছর আগে এখানে বাস করতেন বাদশাহ আমানুল্লা ও তাঁর কুইন সুরাইয়া। বাচ্চা সকাও বলে এক ভিস্তিওয়ালার আনপড় আওলাদ তাদের পাশ্চাত্যপ্রবণতার জন্য কাফের ফতোয়া দিয়ে লড়কেলেঙ্গে দেশছাড়া করলে, তার পরবর্তী আফগান নৃপতিরা ইউরোপীয় স্থাপত্যের এ ইমারতের হেফাজত করতেন। আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক জংবেজঙের জামানায় আহমদ শাহ মাসুদ বলে পানশিরের এক জঙ্গিলাট এখানে থানা গাড়েন। বীর বিক্রমে প্রতিদ্বন্দ্বী জঙ্গিলাট গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের সঙ্গে লড়াইয়ের প্যাঁচমারে মূলত রকেটবাজিতে এ প্রাসাদের মউত হয়। আমি ভগ্নপ্রাসাদের চাতালে দাঁড়িয়ে কাবুলের জনাকয়েক মহিলা কবির জন্য ইন্তেজার করি। নীল বোরকা পরা দুই নারী হালকা চালে হেঁটে দ্বিধাগ্রস্ত পদক্ষেপে প্রাসাদের দরবার হলের দিকে আগালে আমি দূরত্ব রক্ষা করে তাদের অনুসরণ করি।
প্রাসাদের নির্জন করিডরে গোলাদগ্ধ ইট, তৈলচিত্রের ফ্রেম, ফ্রেঞ্চ কেতার টেবিলের পায়া, গলাভাঙা সিরামিকের তৈজস ও রকমারি মার্বেল পাথরের ভাঙাচোরা সব টইলটুকরা। তার ভেতর দিয়ে চালহীন কড়িবরগার ক্ষয়িষ্ণু কাঠামোকে দেখায় তিমি মাছের কঙ্কালের মতো। আমি পরপর কটি হলকক্ষ পাড়ি দিয়ে শায়িত এক নারীমূর্তির সঙ্গে হোঁচট খাই। গ্রিক কেতার এ পিংক মার্বেলের ভাস্কর্যকে বোধ করি দুরমুশ দিয়ে পিটিয়ে আচ্ছাসে শায়েস্তা করা হয়েছে। আমি এক ভাঙাকাচ ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি না—ঠিক কোন দিকে অগ্রসর হব। তখনই ভেসে আসে কাতরানোর ধ্বনির সঙ্গে অস্পষ্ট কিছু কথা, কোথায় যেন কাকে শ্বাসরুদ্ধ করা হচ্ছে। অবাক হয়ে আমি কান পাতি। কে যেন বলে ওঠে ‘জিগরে খুন বা হূদয়ে শোণিত।’ বিষয়টি ঠিকমতো বোঝার আগেই ঝনঝন করে কাচভাঙা দুয়ার ঠেলে বেরিয়ে আসেন কাকা-জনুন। সহসা আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি ফিক্ ফিক্ করে হাসেন। কাকা-জনুন লবজটির মানে হচ্ছে পাগলা-চাচা। তাঁর আকিকায় দেওয়া নামটি কী আমি এখনো তার সন্ধান করে উঠতে পারিনি। তাঁর মোচের মেহেদিমাখা দুই প্রান্ত ক্রমাগত চুমরানোতে পেয়েছে প্রথম বন্ধনীর আকৃতি। কাকা-জনুনের হাসি অস্বাভাবিক। অবশ্য তিনি যে হালতের মধ্যে দিন গুজরান করছেন তাতে তার স্বাভাবিক থাকার কথাও না। তাঁকে আমি পয়লা দেখি কাবুল বিমানবন্দরের কাছাকাছি মাসুদ সার্কেল বলে গোলাকার এক সড়কদ্বীপে দাঁড়িয়ে খামোখা হল্লা চিৎকার করতে। কাকা নিজের আঁকা একটি চিত্র ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ঝাড়ু দিয়ে পথচারীদের ফায়ার করার ভঙ্গিতে শাসাচ্ছেন। তারপর কাকার সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছে বার কয়েক। কাবুলে কালোয়াতি গানের জলসা বা কবিতার মাইফেল হলে কাকা-জনুন বিনা দাওয়াতে হাজির হয়ে প্রথমত বেফায়দা খানিক হট্টগোল করেন, তারপর গাছের ছোট ছোট বাকলায় তিনি এঁকে দেন হাজিরানদের চমৎকার সব ছবি। তাঁর আঁকার হাত কিন্তু খারাপ না। শোনা যায়, অনেক বছর আগে বাদশাহ জহির শাহ তাঁকে মশহুর সব কবিদের তসবির তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর আঁকা ছবিগুলোও নাকি ঝোলানো হয়েছিল এক এক্সিবিশন হলে। তারপর তালেবানি জামানা এলে তিনি পিকআপ নিয়ে যান এক্সিবিশন হল থেকে চাপলিশে ছবিগুলো সরিয়ে গোপন কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেদিন কাবুলে খুব জার পড়েছে, একটু আগে হয়ে গেছে তুষার বৃষ্টি। এক্সিবিশন হলের আঙিনায় তিনি জনা কয়েক তালেবি মোল্লাকে দেখেন। নসিব খারাপ, দ্রুত সটকে পড়ার আগে তালেবরা তাকে পাকড়াও করে আগুন পোহাতে বলে। কাকার চোখের সামনে আগুনের ইন্ধন হয়ে পোড়ে দারি ভাষার তাবৎ কবিকুলের চমৎকার সব চিত্ররাজি। কাকা-জনুনের গর্দিসের এখানেই কিন্তু শেষ হয় না। তালেবানদের সিনিয়র মোল্লারা জহির শাহের পরিত্যক্ত প্রাসাদ ‘আরগে’ তখন গদিনশিন হয়েছেন। প্রাসাদের দেয়ালে বিস্তর ফ্রেস্কো ও তেলের কাজ। কোনো কোনো ছবিতে গুলবাগে বিহার করছে পর্দাহীন জওয়ান সব জেনানা। মোল্লারা কাকাকে ডেকে পাঠান আওরতদের বেশরম অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে কালো সিয়া রং দিয়ে আব্রু করে দেওয়ার জন্য। চিত্রশিল্পকে কালিমালিপ্ত করার কাজ করতে করতে কাকা-জান ক্রমশ দিলেজানে জনুন হয়ে যান।
করিডরের এদিকে হিরাতের কবি নাদিয়া আনজুমান হিরাওয়ির ছবি ও তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদকে ব্লোআপ করে একটি পোস্টার করা হয়েছে। নাদিয়ার সঙ্গে আমার ঘণ্টাখানেকের পরিচয় আছে। নাদিয়া লাইমলাইটে আসেন ইরানের মাসাদ, সিরাজ ও ইস্পাহানে তাঁর কিছু কবিতা ছাপা হওয়ার পর। তালেবানি আমলে বয়সের নিরিখে নাদিয়া ছিলেন কিশোরী। আফগানিস্তান থেকে তখন কিছুই প্রকাশ হচ্ছে না। তার ওপর সামাজিকভাবে মেয়েদের কবিতাচর্চা হয়ে গেছে সাফ হারামের শামিল। নাদিয়া তখন হিরাতের আরও জনাকয়েক মহিলা কবির সঙ্গে মিলেঝিলে সেলাই শেখার ক্লাসে যেতেন। সেলাই-ফোঁড়াই সম্পর্কে এ কবিদের আগ্রহ কিছু ছিল না, কিন্তু এ অজুহাতে তারা কবিতাচর্চার জন্য মিলিত হতে পারতেন। ক্লাসে মেয়েরা কি করছে তা দেখার জন্য মাঝেমধ্যে বন্দুকধারী তালেবানরা উঁকিঝুঁকি দিলে মহিলা কবিরা খাতা লুকিয়ে ফেলে বোরকা সেলাইয়ের ভান করতেন।
করিডরের এদিকে দেখি বোমাবিধ্বস্ত ছাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জন বেইলি ও ভেরোনিকা ডাবোলডে বলে এক বয়স্ক ইংরেজ দম্পতি। আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত, সুতরাং থেমে শুভেচ্ছা বিনিময় করি। ভেরোনিকা ছাদের দিকে নির্দেশ করে বলেন, তিনি যখন সত্তরের দশকের প্রথম দিকে কাবুল আসেন তখনো এ প্রাসাদের তাম্বার মিনা করা চাল সূর্যকিরণে সোনার আভায় ঝলমল করত। ষাটের দশকের শেষ দিকে এ দম্পতি হিরাতে আফগান সংগীতের ওপর গবেষণা করত। তখন তাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে দারি ভাষার অনেক কবির বন্ধুত্ব। তালেবানরা বিতাড়িত হলে ২০০৪ সালে তারা আবার ফিরে আসেন। তখন মূলত ভেরোনিকা সাম্প্রতিক আফগান মহিলা কবিদের কবিতা ইংরেজিতে তর্জমা করার জন্য একটি প্রকল্প করেন। আমি তখন আফগানিস্তানে কাজ করছি। একদিন দুপুরবেলা তাঁদের গেস্টহাউসে গেলে ভেরোনিকা আমাকে নাদিয়া আনজুমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তরুণী নাদিয়া হিরাত থেকে ভেরোনিকার কাছে এসেছিলেন তর্জমার জন্য তাঁর কটি কবিতা জমা দিতে। নাদিয়া তখন দেহজ ভালোবাসার কথা তাঁর কবিতায় সরাসরি লিখে আলোচিত হচ্ছেন। সম্ভবত তাঁর আগে কোনো তরুণী এসব প্রসঙ্গ সরাসরি লেখেননি। আফগান সমাজে এসব কথা বলারও তেমন রেওয়াজ নেই। কালো কাপড়ে সমস্ত শরীর ও চুল ঢেকে নাদিয়া খুব চুপচাপ বসে ছিলেন। আমি তাঁর নির্বাচিত হওয়া একটি কবিতার অনুবাদের প্রিন্টআউট দেখছিলাম। তার একটি চরণ এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে, ‘কে সেই লুটেরা/ ভেঙে তছনছ করে আমার স্বপ্নের স্বর্ণমূর্তি?’ আলাপ-পরিচয়ে কিছু একটা বলতে হয়, তাই আমি জানতে চেয়েছিলাম দারি সাহিত্যে তার প্রিয় কবি কে। অত্যন্ত দ্বিধাহীন জবানে নাদিয়া রাবেয়া বলখির নাম করেন। রাবেয়া বলখিকে ফারসি বা দারি ভাষার প্রথম মহিলা কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে নামজাদা সুফি কবি জামি তাঁর নাফাহাত-উল-উনস্ এবং কবি আত্তার তাঁর মাহনাবিয়াত গ্রন্থে রাবেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। রাবেয়ার জীবনকাল নবম শতাব্দীর। তখন তাঁর ভ্রাতা হারেস বিনতে কুজদারি ছিলেন বলখ প্রদেশের সুবেদার। রাবেয়ার সঙ্গে সুবেদারের তুর্কি ক্রীতদাস বাকতাসের গোপনে প্রণয় হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে হারেস কুজদারি বাকতাসকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে রাবেয়াকে হাম্মাম বা গোসলখানায় অন্তরীণ করেন। একপর্যায়ে রাবেয়া তাঁর হাতের শিরা কেটে রক্ত দিয়ে হাম্মামের দেয়ালে তাঁর জীবনের শেষ কবিতা লিখে যান। কিংবদন্তির এই কবিতার কথা আমি অনেক শুনেছি, কিন্তু কখনো পড়িনি। আলোচনাকে বিস্তারিত করার জন্য আমি নাদিয়াকে রাবেয়ার শেষ কবিতার ভাবানুভূতি ইংরেজিতে তর্জমা করে শোনাতে অনুরোধ করি। নাদিয়ার ইংরেজি তেমন সবল না, তবে তাঁর কাছ থেকে যে তথ্য পাই তা হচ্ছে: ‘জড়িয়েছি ভালোবাসার কুহকী জালে/অশ্রুময় নোনা জল ঝরে/পাঁজরের রক্তিম প্রবালে/ভাঙে হূদয়ের বালিয়াড়ি/উড়ে ঝরা পাতা/পান করি বিষ-বিষে অমরতা।’
আমরা প্রাসাদের প্রশস্ত একটি হলকক্ষে এসে পৌঁছাই। কামরার চারপাশে মানুষসমান উঁচু কাচভাঙা রট-আয়রনের শামাদান। কাবুলের বেশ কজন মহিলা কবি শামাদানের ডালায় তাঁদের বোরকা রেখে অত্যন্ত নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন। কাকা-জনুন এসে মেয়েদের সবাইকে ঝুঁকে ঝুঁকে কুর্নিশ করলে মেয়েরা মুখে ওড়না চাপা দিয়ে ফিকফিক করে হাসে। তিনি দূরের এক কোনায় রাখা ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে মার্কার দিয়ে আঁকতে শুরু করেন নাদিয়া আনজুমানের গুলে দুদি বা গাঢ লাল ফুল নামক কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার কটি চরণ—যার ভাষান্তর হচ্ছে: ‘যদিও কবিতা ও সংগীতের দুহিতা আমি/ পঙিক্ত আমার লাজনম্র নাজুক/ তার পরও স্বরাজপ্রাপ্ত আমার পুষ্পপল্লব / স্বীকার করে না মালির শুশ্রূষা।’ ভেরোনিকা ডাবোলডে যিনি আজকের জলসার ইন্তেজাম করেছেন, এগিয়ে এসে মাইফেলটি কেন ভগ্নপ্রাসাদে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। কাবুলে মহিলা কবিদের মাইফেল করার কোনো রেওয়াজ ছিল না। বিশের দশকের শেষ দিকে পাশ্চাত্যপ্রবণ বাদশাহ আমানুল্লা প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারীশিক্ষার বদনামের ভাগিদার হন। তাঁর মহিষী কুইন সুরাইয়া এ হলকক্ষে সমঝদার কজন মহিলাকে ডেকে এনে মাইফেল করে রাবেয়া বলখির কবিতা পাঠ করান। নাটকীয়ভাবে বাদশাহ মাইফেলে এসে আফগান নারীদের আজ থেকে নেকাব পরার সামাজিক কোনো প্রয়োজন নেই এ ঘোষণা দিলে কুইন সুরাইয়া তার মুখ থেকে খুলে ফেলেন আব্রু। আজকের মাইফেলে আগত নারীদের ওপর ভেরোনিকার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া হয়। তারা সবাই খানিকক্ষণ নতমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে চুল থেকে ওড়না সরিয়ে তাদের মুখমণ্ডল নেকাবমুক্ত করেন। ভেরোনিকাও তাঁর মুখে জড়ানো চাদরি খুলে ফেলেছেন। তিনি একটু বিরতি নিয়ে আজকের মাইফেলের প্রসঙ্গে আসেন। আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক কবিতার প্রেক্ষাপটে বিষয়বস্তুর দিক থেকে নাদিয়ার অর্জন অনেক। রাবেয়া বলখির পর তিনিই সম্ভবত প্রথম মহিলা কবি যিনি ভালোবাসার নারীশোভন অনুভূতিকে উপজীব্য করেছেন। প্রত্যক্ষ এক্সপ্রেশনের কারণে কিশোরী নাদিয়ার ওপর তার পরিবার ছিল ক্ষুব্ধ। তাদের ধারণা, নারী হয়ে ‘ভালোবাসা, দেহ ও রূপ’ সম্পর্কে শিল্পিত পদবিন্যাস করে তিনি বংশের মুখে লেপেছেন চুনকালি। ভেরোনিকা তাঁর একটি কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেন: আমার কলমের অনুপ্রেরণা হয়ে বাজে/ভালোবাসার মঞ্জিল/না ফোটা ফুলে জমে/সৃজনের যে শিশির /উপড়ে নিয়ে শিকড় তার/কারা লেখে—/মনের মৃত্যু আমার?
আজকের মাইফেলে দাওয়াতপ্রাপ্ত হয়েও কাবুলের পুরুষ কবিদের কেউই জলসায় হাজির হননি। মেয়েদের কাছাকাছি একা দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি হয় বলে আমি কাকা-জনুনের ইজেলের কাছে এসে দাঁড়াই। কাকা তাঁর দক্ষ হাতের কটি টানে ক্যালিগ্রাফের নিচে এঁকেছেন নাদিয়া আনজুমানের মুখ। আমি তাঁর সবুজ চোখের দিকে তাকাই। মনে হয় ওখানে জমে আছে জলের গভীরের স্তব্ধতা।
জন বেইলি ডিজিটাল ভিডিও তাক করলে মাইফেল শুরু হয় যুগপৎ দারি ও ইংরেজি ভাষায়। সিমা কালবাসি বলে অস্থির চোখের এক কবি, মনে হয় তিনি বুঝি দুই হাতে ধরে আছেন জলন্ত কিছু অঙ্গার—এ রকম ভঙ্গিতে পাঠ করেন নাদিয়া আনজুমানের আরেকটি কবিতা: ঘুঘুর গাঢ় স্বরের মতো/আমার চারপাশেঘোরে শূন্যতা/ভাঙা ডানা আমি/ক্রন্দনই আমার একমাত্র অর্ঘ।
নদীর স্রোত যে রকম সহসা রূপান্তরিত হয় বৃত্তাকার ঘূর্ণিতে, সে রকম সিমা কালবাসির অস্থির আবৃত্তিতে যেন শ্রোতাদের দেহ-মনে ঊর্মি খেলে যায়, তারা সবাই যুগপৎ গেয়ে ওঠে নাদিয়ার আরেকটি লোকপ্রিয় কবিতা: আনন্দময় সেদিন হবে/যেদিন আমি ভাঙব খাঁচা/গাইব গান/দিলখোলা এক প্রান্তরে/সুর জ্বলে যায় অন্তরে।
সিমা কালবাসিকে এবার অত্যন্ত উত্তেজিত দেখায়। মনে হয় তার শরীরের কিছু অংশ পুড়ে যাচ্ছে ধিকি ধিকি অঙ্গারে। তিনি মাইফেলের দিকে তাকিয়ে সওয়াল করেন। ‘নাদিয়া বলে হিরাতের এক আফগান দুহিতা তার মনের অন্তর্গত খবর প্রকাশ করেছে, হিম্মত দেখিয়েছে সে কবি হওয়ার, এর জন্য কী’ বলে ঢাকনা দেওয়া কেতলির বাষ্পের মতো বলকে ওঠে তাঁর আবেগ। তিনি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে বলেন, ‘এর জন্য কি প্রাপ্য ছিল তাঁর মৃত্যু?’ সারা মাইফেল ভরে ওঠে গাঢ় স্তব্ধতায়।
জন বেইলি ফিসফিস করে বলেন, ‘নাদিয়ার প্রকাশিত একটি কবিতায় শরীরী প্রেমের ইশারা থাকলে তাঁর স্বামী হিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লাইব্রেরিয়ান ফরিদ আহমদ মজিদনিয়া তাঁকে দৈহিকভাবে নির্যাতন করে সন্ধ্যাবেলা। ভোরে বিছানায় পাওয়া যায় তাঁর মৃতদেহ। বিষয়টিকে আত্মহত্যা বলে পুলিশ রিপোর্ট দিয়ে দ্রুত তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫। সি ওয়াজ সো ইয়ং।’
সবাই ততক্ষণে খানিক সামলে নিয়েছেন। মহিলা কবিরা এবার তাঁর স্মৃতিতে স্বরচিত কবিতা পাঠ করছেন। লোহিত বর্ণের কাফতান পরা জোহরা সাইদ বলে এক কবি পাণ্ডুলিপি হাতে নেন। ভেসে যাওয়া মেঘের মতোই তাঁর চোখেমুখে লেগে আছে গাঢ় বিষাদ। তিনি খুব মৃদুস্বরে আবৃত্তি করেন: বহু দূরের জনশূন্য সৈকতে/ আটকে পড়া মাছ আমি/ জোয়ারের হে জলধি—/মৃত্যু হবে তৃষায়/যদি না আবার তরঙ্গে ভাসাও।
পড়তে পড়তে তাঁর চোখ সিক্ত হয়। প্রজাপতির ডানায় রুপালি বৃত্তের মতো দুই ফোঁটা অশ্রু লেগে থাকে তাঁর কপোলে। সবাইকে সহসা চমকে দিয়ে কাকা-জনুন বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘জিগরে মান খুন আস্ত...খুন জিয়াদ আস্ত বা হূদয়ে আমার অনেক রক্ত।’
Mainussultan@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.