চারুশিল্প-ঢাকায় মকবুল ফিদা হুসেন by জাহিদ মুস্তাফা

ঢাকার চিত্রপ্রেমী দর্শকদের জন্য চমৎকার ও বিরল একটি সুযোগ তৈরি করেছে মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসের ১৯/বি সড়কের ৩০০ নম্বর বাড়ির গ্যালারি ব্যাসিলিও। সমকালীন চারুশিল্পে আমাদের উপমহাদেশে সবচেয়ে আলোচিত চিত্রকর মকবুল ফিদা হুসেনের আঁকা সাম্প্রতিক চিত্রকর্মের ৪০টি সেরিগ্রাফের পক্ষকালব্যাপী প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ৬ জানুয়ারি থেকে।


মকবুল ফিদা হুসেনের বর্ণাঢ্য জীবনাবসান ঘটেছে গত বছরের ৯ জুন লন্ডনের একটি হাসপাতালে। একজন ভারতীয় হিসেবে তাঁর জন্ম ১৯১৫ সালে মহারাষ্ট্রের পাঞ্জারপুরে। ৯৫ বছর বয়সে যখন তাঁর মৃত্যু হলো, তখন তিনি আর ভারতীয় নন, কাতারের নাগরিক। ধর্মীয় মৌলবাদের আক্রমণাত্মক আচরণে ত্যক্ত-বিরক্ত শিল্পী তাঁর শেষ জীবনে স্বদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বছর কয়েক আগে ঢাকায় সমকালীন চিত্রশালা শিল্পাঙ্গনে ফিদা হুসেনের কয়েকটি সেরিগ্রাফ চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়েছিল অন্য কয়েকজন ভারতীয় শিল্পীর চিত্রকর্মের সঙ্গে। সে অনুযায়ী ব্যাসিলিও গ্যালারিতে আয়োজিত এই প্রদর্শনীই এ দেশে মকবুল ফিদা হুসেনের প্রথম একক। এ প্রদর্শনীর কাজগুলো গত পাঁচ-ছয় বছরের। এ সময়ে তিনি এঁকেছেন—মাদার তেরেসা, দেবতা গণেশ, বলিউডের নায়িকা মাধুরী দীক্ষিত, ক্ষমতা ও ক্ষিপ্রতার প্রতীক ঘোড়ার গতিময় ভঙ্গি, হিন্দু ও মুসলিম নানা মিথের ছবি। এসব সিরিজের এক বা একাধিক সেরিগ্রাফ প্রদর্শিত হচ্ছে। আমাদের দর্শক ও শিল্প সংগ্রাহকদের জন্য এ এক অনন্য আয়োজন। সেরিগ্রাফ এক ধরনের ছাপচিত্র, যেটির অনেকগুলো কপি করা যায়। এর দাম হয় সংগ্রাহকদের সামর্থ্যের মধ্যে।
হুসেন ছিলেন সমসাময়িক বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ও শক্তিমান একজন চিত্রশিল্পী। তিনি এঁকেছেন বিচিত্র সব বিষয়ে মানবজীবনের মানব ধর্মের, প্রকৃতির বহুবিধ ধরন, কাহিনি, কল্পকথা কত কী নিয়ে! ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী দ্বিমাত্রিক ধাঁচের অঙ্কনরীতির সঙ্গে জগদ্বিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসোর অঙ্কনশৈলীর সমন্বয়ে হুসেন রপ্ত করেছিলেন যে চিত্রভাষা—সেটি তাঁকে এনে দিয়েছে খ্যাতি-অর্থ-যশ। ভারতের অতিসাধারণ মুসলিম এক পরিবারের সন্তান কালপরিক্রমায় হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমানদের আরাধ্য নায়ক।
ফিদার জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে প্রিয় শহর মুম্বাইতে। এখানে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন তরুণ বয়সে। বলিউড চলচ্চিত্রের ব্যানার আঁকতে আঁকতে হয়ে উঠেছিলেন পরিণত এক শিল্পী। ১৯৪৭ সালে মুম্বাইয়ের প্রগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপে যোগ দিয়ে শিল্পের অভিজাত শ্রেণীতে নিজেকে উন্নীত করেন। ওই দলের কয়েকজন পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের চারুশিল্পের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তাঁরা হলেন এফ এন সুজা, এস এইচ রাজা, ভি এস গাইটোন্ডে প্রমুখ।
‘ভারত মাতা’ শিরোনামে হিন্দু দেবীর নগ্ন ছবি এঁকে তিনি মৌলবাদীদের আক্রোশের শিকার হন। ভারতের মানচিত্রকে তিনি দেবী হিসেবে চিত্রিত করেছেন তাঁর স্বকীয় অঙ্কন বৈশিষ্ট্যে। তাঁর সমগ্র শিল্পীজীবনে বারবার ঘুরেফিরে চিত্রপটে এসেছে ঘোড়া ও নানা ধর্মের আখ্যান-অনুষঙ্গ। চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়েও এঁকেছেন। বলিউডের নায়িকা মাধুরীর বিচিত্র রূপ আর তাঁর সাজসজ্জা নিয়ে অসংখ্য ছবি এঁকেছেন। কারণ, মাধুরী তাঁর চোখে আদর্শ এক ভারতীয় নারী। শহর-গ্রাম-মানুষ-প্রকৃতি-নারী-শিশু-ধনী-গরিব-অভিজাত হেন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি আঁকেননি। মহৎ এই শিল্পীর কতক কাজ দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য গ্যালারি ব্যাসিলিওকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.