বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৮২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. আবুল হাসেম, বীর বিক্রম সাহসী ও অদম্য এক মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হাসেম সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝোড়োগতিতে এগোতে থাকলেন শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের দিকে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক গোলাগুলির মুখে প্রচণ্ড সাহসিকতা প্রদর্শনের পরও থেমে গেল তাঁদের অগ্রযাত্রা। হতাহত হলেন তাঁর অনেক সহযোদ্ধা। তার পরও দমে গেলেন না তিনি।


তাঁর সাহসিকতা ও রণকৌশলে উজ্জীবিত হলেন সহযোদ্ধারা। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকল। এ ঘটনা ধলই বিওপিতে। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর। ধলই বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট বা সীমান্ত চৌকি) মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে এখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য এক ঘাঁটি। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের দুই কোম্পানি, টসি ও স্থানীয় রাজাকারের সমন্বয়ে দুই কোম্পানি; সব মিলে এক ব্যাটালিয়ন জনবল। ঘাঁটির অবস্থান ছিল সমতল থেকে বেশ উঁচু স্থানে। চারদিকে ছিল ঘন বাঁশবন, চা-বাগান, জঙ্গল ও জলাশয়। সেখানে দিনের বেলায়ও আক্রমণ চালানো কঠিন ছিল।
২৮ অক্টোবর ভোরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল (প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা, ব্রাভো, চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি) একযোগে ধলই বিওপিতে আক্রমণ করে। চার্লি কোম্পানির একটি প্লাটুনের নেতৃত্বে ছিলেন মো. আবুল হাসেম। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ডান দিক দিয়ে আক্রমণ করেন। মো. আবুল হাসেম তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝোড়োগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণের ব্যাপকতা এত বেশি ছিল যে তাঁদের অগ্রযাত্রা একপর্যায়ে থমকে যায়। তখন তিনি ফায়ার অ্যান্ড মুভ পদ্ধতিতে এগোতে থাকেন। কিন্তু উঁচু টিলার ওপর স্থাপিত একটি এলএমজি পোস্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা প্রায় নিখুঁত নিশানায় গুলিবর্ষণ করছিল। মো. আবুল হাসেমের দলের কয়েকজন ওই এলএমজির গুলিতে আহত হন। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চেষ্টা করেন ওই এলএমজি পোস্ট ধ্বংস করতে। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। হতাহতের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে। এতেও তিনি দমেননি। সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
মো. আবুল হাসেম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এ রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। যশোরের বেনাপোল, নাভারণ, জামালপুর জেলার কামালপুরসহ বৃহত্তর সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত আটগ্রাম সেতু আক্রমণ ও দখলে তিনি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন। অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। তাঁরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কানাইঘাট যুদ্ধে তিনি আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত আটগ্রাম যুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. আবুল হাসেমকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৯। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও বীরত্বের জন্য তিনি ‘তঘমায়ে জুমরাত’ (টিজে) খেতাব পান।
আবুল হাসেমের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার সুধারাম উপজেলার নোয়ান্নই ইউনিয়নের (ডাক শিবপুর) সাহেলপুর গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকার ৩৩৪ সেনপাড়া, মিরপুরে। তাঁর বাবার নাম আবদুল জব্বার। মা তরিকুন নেছা। স্ত্রী শামীমা আক্তার। তাঁর তিন ছেলে, দুই মেয়ে।
আবুল হাসেম বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা দরকার। ১৯৭১ সালে তারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে।’
সূত্র: আবুল হাসেম বীর বিক্রমের সাক্ষাৎকার, ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.