দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে : খালেদা জিয়া

দেশের অর্থনীতি 'ক্রান্তিকাল' অতিক্রম করছে বলে দাবি করেছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, সব কিছু মিলিয়ে সরকার দেশকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। ব্যাংক এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। কোনো কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।


গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গুলশানে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, বৈদেশিক সহায়তা সংগ্রহে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। দৈনিক ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১৪২ কোটি টাকায় পেঁৗছেছে। এখন উচ্চ সুদে বাইরে থেকে ঋণ গ্রহণের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। ১৯৭৪ সালের পর এমন অবস্থা কখনোই হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তা কয়েক দিনের মধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। একই সঙ্গে তাঁর চিঠির জবাবে মনমোহন সিং যে চিঠি দিয়েছেন, তাও সংবাদমাধ্যমে দেওয়া হবে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বিস্তারিত দেশবাসীকে জানাতে আলাদা একটি সংবাদ সম্মেলন করবেন তিনি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে আগামী রবিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকার পর গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তবে ডিসিসি দুই ভাগ করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, আরেক দিন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। জাতীয় অর্থনীতির সামষ্টিক কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, জ্বালানি সংকট, শেয়ারবাজারে লুটপাট চলছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, বিদেশি মুদ্রার মজুদে ঘাটতি, সরকারের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে মারাত্মক অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংক ঋণের ওপর অকল্পনীয় নির্ভরশীলতা অর্থায়নের চাপ বাড়ছে। তিনি বলেন, বৈদেশিক কর্মসংস্থানে স্থবিরতা, রেমিট্যান্স প্রবাহে নিম্নমুখী প্রবণতা, বৈদেশিক সাহায্য ছাড়ে দাতাগোষ্ঠীর অনীহা, কৃষকের পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া, বল্গাহীন মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা, পোশাক শিল্প ও বস্ত্রশিল্পে ঘনীভূত সংকট, দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের অর্থনৈতিক সংকট নাভিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমস্যা অস্বীকার করায় সমাধানের তাগিদ অনুপস্থিত : সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার এই সর্বগ্রাসী সংকটকে মোটেও আমলে নিচ্ছেন না। বরং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, দেশে কোনো অর্থনৈতিক সংকট নেই। সমস্যাকে এভাবে অস্বীকার করার ফলে সমাধানের তাগিদও অনুপস্থিত। ফলে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের নীতি 'লুটপাটের' পথ করে দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকট উত্তরণের চেষ্টা করতে গিয়ে ভর্তুকির চাপে অর্থনীতি আজ চরমভাবে বিপর্যস্ত। তিনি আরো বলেন, যে সর্বগ্রাসী সংকট দেশে চলছে, তার পুরো দায় সরকারকে নিতে হবে। এ রকম অপরিণামদর্শী নীতি অতীতে আর কোনো সরকার গ্রহণ করেনি।
শেয়ারবাজারে কারসাজির মাধ্যমে অর্থ লুট : শেয়ারবাজার থেকে অর্থ পাচার হয়েছে দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, প্রায় ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী পথে বসেছে। কারসাজির মাধ্যমে তাদের অর্থ লুট করা হয়েছে। অথচ বিনিয়োগকারীদের ফটকাবাজ বলেছেন অর্থমন্ত্রী। আন্দোলনরত বিনিয়োগকারীদের 'সুনাগরিক নহে' বলে কটাক্ষ করা হয়েছে।
পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপকে 'জোড়াতালি' বলে আখ্যা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, 'এর পরও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া হাবিবুর রহমান গত পরশু আত্মহত্যা করেছেন বলে আজ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ আত্মহত্যা আমাদের ব্যঙ্গ করছে। এসবের দায় নিয়ে এ সরকারের এখনি পদত্যাগ করা উচিত।' তিনি আরো বলেন, 'জাতীয় অর্থনীতির সর্বনাশ হচ্ছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি। আমরা ক্ষমতায় গেলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
পদ্মা সেতু : খালেদা জিয়া বলেন, পদ্মা সেতুর অগ্রগতির ক্ষেত্রে একজন মন্ত্রীর অপসারণের শর্ত দিয়েছে দাতারা। দুর্নীতির কারণে এ সেতুর কাজ আটকে গেছে। সরকার এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পরস্পরবিরেধী বক্তব্য দিয়ে মূল সমস্যা আড়াল করার চেষ্টা করছে।
টিপাইমুখ : বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, 'সরকারের ব্যর্থতায় ভারত আজ আমাদের না জানিয়ে কাজ করছে। এ বাঁধ নির্মাণ হলে মেঘনা অববাহিকায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। হাওরাঞ্চলের পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাঁধ হওয়ায় তা ভেঙে গেলে আট ফুট পানির নিচে সিলেট তলিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। বিষয়টিকে বাংলাদেশের জীবনমরণ সমস্যা মনে করে এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়েছি। এ জন্য উভয় দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সার্বিক সমীক্ষার আহ্বান জানিয়েছি।'
তারা রেখে যেতে চায় শূন্য কোষাগার : সরকার পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করছে বলে অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, 'যুদ্ধে দখলদার বাহিনী যেমন জনপদের সব স্থাপনা ও মূল্যবান সামগ্রী পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে যায়, সরকারও সে রকম নীতি অবলম্বন করছে। তারা রেখে যেতে চায় শূন্য কোষাগার, বিশাল ঋণের দায়, ভেঙে পড়া শিল্প-বাণিজ্য ও ধসে পড়া শেয়ার মার্কেট।' এ মুহূর্তে অর্থনীতিতে যে সর্বগ্রাসী সংকট বিরাজ করছে তার দায়-দায়িত্ব ভবিষ্যতে এই সরকারকেই নিতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
কেবল হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট : বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, 'বাংলাদেশের ৭৪ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। অথচ আমরা বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই লক্ষ্য করছি যে তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার অগ্রাধিকার হচ্ছে কেবল হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট। গ্রামীণ অবকাঠামো তথা গ্রামীণ অর্থনীতির সহায়ক কর্মকাণ্ডের বিস্ময়কর অনুপস্থিতি আমাদের হতাশ করেছে।' তিনি আরো বলেন, দেশের দরিদ্র জনগণ থেকে সংগৃহীত করের টাকার প্রায় পুরো অংশই গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে শুষে নিয়ে কিছু মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি কুক্ষিগত করছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ অবকাঠামোতে বিনিয়োগের অভাবে দরিদ্র মানুষ ক্রমাগত অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এ সরকারের দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে সারা দেশের সড়ক ও মহাসড়কগুলোর বিপর্যস্ত অবস্থা জনজীবনে নিদারুণ দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, 'ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট ভয়াবহ এ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। যারা এই সংকট সৃষ্টি করেছে তাদের আমরা জনমতের অপরাজেয় শক্তি দিয়ে পরাস্ত করি। আসুন আমরা শপথ গ্রহণ করি, জাতীয় অর্থনীতিকে যারা রক্তশূন্য করে ফেলছে তাদের করাল গ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করব ইনশা আল্লাহ।'
প্রায় ৫৫ মিনিটের লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া দেশের সার্বিক অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ছিলেন বিএনপি নেতা ড. আর এ গনি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আবদুল আউয়াল মিন্টু, ড. ওসমান ফারুক, শওকত মাহমুদ প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.