মৃত্যুর প্রহর গুনে কাটে দিন by এম বদি-উজ-জামান
মুন্সীগঞ্জের আইউব আলী চেয়ারম্যান নামের এক ব্যক্তি ৯ বছর ধরে কারাবন্দি। ষাটোর্ধ্ব এ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছয় বছর আগে নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন পাঁচ হত্যাকাণ্ডের এক মামলায়। সেই থেকে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কারাগারের কনডেম সেলে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। শুধু আইউব আলী নন, এরকম প্রায় ৮০০ বন্দি দেশের বিভিন্ন কারাগারের কনডেম সেলে বছরের পর বছর ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। এর মধ্যে আহসান উল্ল্লাহ মাস্টার এমপি ও জুরাইনের শিল্পপতি মো. আলম হত্যা মামলার আসামিরাও আছে। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে মৃতুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জীবনমৃত এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।
হাইকোর্টে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) পেপারবুক সরকারি প্রিন্টিং প্রেস (বিজি প্রেস) থেকে সময়মতো সরবরাহ না করা এবং ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক আদালত না থাকায় বছরের পর বছর পড়ে থাকছে মামলা।
মুন্সীগঞ্জের ফাইভ মার্ডার মামলায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নিম্ন আদালত ২০০৫ সালের ১২ জুলাই রায় দেন।
এই ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) এখনো বিচারাধীন। একইভাবে টঙ্গীর জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্ল্লাহ মাস্টার এমপি হত্যা মামলায় ওই বছরের ১৬ এপ্রিল ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন। এ মামলায় হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সটিও বিচারাধীন। এ ছাড়া
নিম্ন আদালতের দেওয়া রায়ে জুরাইনের শিল্পপতি মো. আলম হত্যা মামলায় ২০০৫ সালের ৩১ জুলাই নিহত আলমের দুই জামাইসহ ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মতিঝিলে দুই পুলিশকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় ২০০৬ সালের ২৭ এপ্রিল সাবেক ছাত্রদল নেতা আবদুল্লাহিল বাকী ইদুলসহ চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতের দেওয়া এসব মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্টের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে এবং এর ফলে মামলার (ডেথ রেফারেন্স) জট বাড়ছেই।
সূত্র মতে, গত এক বছরে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা ১০০ বেড়েছে। গত ৩১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হাইকোর্টে ৫৫২টি ডেথ রেফারেন্স এখন বিচারাধীন। এর মধ্যে হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চে ১২টি ডেথ রেফারেন্সের বিচার চলছে। এ ছাড়া সাতটি ডেথ রেফারেন্সের পেপারবুক প্রস্তত রয়েছে। আরো ছয়টির পেপারবুক তৈরি করতে বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছে। গত বছর জুন পর্যন্ত বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা ছিল ৪৫১টি।
বর্তমানে বিচারাধীন সাড়ে ৫০০ ডেথ রেফারেন্সের মধ্যে ২০০৫ সালে হাইকোর্টে পাঠানো ডেথ রেফারেন্স এখনো বিচারাধীন। ওই বছর ১২১টি ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে এলেও এখনো চার-পাঁচটি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রয়োজনীয়সংখ্যক আদালত ও পেপারবুকের অভাবেই ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা স্বীকার করছেন।
দেশের ৬৮টি কারাগারে এখন প্রায় ৮০০ মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি কনডেম সেলে রয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই রয়েছে শতাধিক আসামি। হত্যা-অপহরণ করে লাশ গুম করা, ধর্ষণসহ জঘন্যতম অপরাধে নিম্ন আদালত থেকে তাদের ফাঁসির এ সাজা দেওয়া হয়। আইন অনুযায়ী এ সাজা কার্যকর করতে হলে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। কোনো আসামি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকেই এসব মামলার নিষ্পত্তি করতে হয়। নিম্ন আদালত রায় ঘোষণার পর এ-সংক্রান্ত নথিপত্র উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়, ওই রায় অনুমোদনের জন্য, যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত। তবে নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর আসামিপক্ষই উচ্চ আদালতে আপিল করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তরাও নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। বিষয়টি হাইকোর্টে আসার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে ওইসব মামলার পেপারবুক বিজি প্রেস প্রস্তুত করে তা হাইকোর্টে পাঠায়। এরপর তালিকার ক্রম-অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স শুনানির ক্ষমতাপ্রাপ্ত বেঞ্চে পাঠানো হয়। সে অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।
ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে মাত্র তিনটি আদালত রয়েছে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকাকালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ডেথ রেফারেন্সের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করার পর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির জন্য পাঁচটি বেঞ্চ গঠন করেন। কিন্তু এখন তা কমিয়ে তিনটি করা হয়েছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও কমেছে। এ ছাড়া বিচারপতি খায়রুল হকের সময় বিজি প্রেসে দ্রুত পেপারবুক তৈরির জন্য তাগাদা দেওয়া হয়। এরপর বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষ গত জানুয়ারিতে পেপারবুক তৈরির জন্য পৃথক একটি ইউনিট গঠন করে।
পেপারবুক তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এ বছরের শুরুতে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। এ রিট আবেদনে দ্রুত পেপারবুক প্রস্তুতের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি প্রেস স্থাপনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। এরপর হাইকোর্ট একটি রুলও জারি করেন।
বর্তমানে তিনটি বেঞ্চে ১২টি ডেথ রেফারেন্সের বিচারের পাশাপাশি এ তিনটি আদালতে অনেক ফৌজদারি আপিল বিচারাধীন। মূলত অধিকসংখ্যক পেপারবুক না থাকায় এসব আদালতে ডেথ রেফারেন্সের পাশাপাশি ফৌজদারি আপিল শুনানির এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীরা এর কারণ হিসেবে বলেছেন, ডেথ রেফারেন্সের বিচারের জন্য প্রথম শর্ত পেপারবুক তৈরি করা। এই পেপারবুকের অভাবে যেন সংশ্লিষ্ট আদালতকে বসে থাকতে না হয়, সেজন্যই এটা করা হয়। পর্যাপ্ত পেপারবুক থাকলে অন্য কোনো মামলা বিচার করার সুযোগ থাকত না।
অ্যাটর্নি জেনারেল সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হতে বেশ সময় লাগে। এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য মামলার মতো দ্রুত নিষ্পত্তি করার সুযোগ নেই। ডেথ রেফারেন্সের স্তূপ কমাতে হলে অনেক বেঞ্চ গঠন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিচারকের। পর্যাপ্তসংখ্যক বিচারক না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না বলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হলে আরো বিচারক নিয়োগ দিতে হবে, বাড়াতে হবে বেঞ্চ।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিদেশ সফরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ডেথ রেফারেন্স মানেই জীবন-মৃত্যুর সমস্যা। তাই এটা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিচার করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, ডেথ রেফারেন্স শুনানির আগে পেপারবুক তৈরি করতে হয়। এজন্য কিছু প্রশাসনিক কাজ আছে। এটা করতে সময় দরকার। তিনি বলেন, পেপারবুক তৈরিতে বিলম্ব ও প্রশাসনিক সমস্যার কারণে মামলার সংখ্যা কিছু বেড়েছে। তবে ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা কমাতে হাইকোর্ট বিভাগে শিগগিরই আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট আনিসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কনডেম সেলে মানুষকে বেশি দিন আটক রাখা ঠিক নয়। মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে বছরের পর বছর কারাভোগ করুক বা ভীতিতে থাকুক, এটা আমি চাই না।' তিনি বলেন, বিচার প্রার্থী বিশেষ করে আসামিদের বিচার বিলম্বিত হোক, এটা কাম্য হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় থেকে অভিজ্ঞতা হয়েছে, যেকোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মামলায় বিচার বিলম্বিত হয়, এতে শুধু আসামিদেরই দুর্ভোগ হয় না, যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরও বেদনার শেষ নেই। এ কারণেই যত দ্রুত ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয় ততই ভালো।
অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া বলেন, নিম্ন আদালত হত্যা মামলায় প্রতিটি সাক্ষ্য ভালোভাবে পরীক্ষা করে তবেই সাজা দিয়ে থাকেন। কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর হাইকোর্টে সে মামলা বিচারকালে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। বিচারকরা দেখেন, একটু ভুলের জন্য যেন একজন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ না যায়। এই চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রত্যেক সাক্ষীর সাক্ষ্য ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়। এজন্য একটি মামলার বিচার শেষ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। সাধারণ মামলার মতো ডেথ রেফারেন্স শুনানি দ্রুত করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, দ্রুত পেপারবুক তৈরি না হওয়ায় এবং আদালতের সংখ্যা কম হওয়ায় মামলার সংখ্যা বাড়ছে।
মুন্সীগঞ্জের ফাইভ মার্ডার মামলায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নিম্ন আদালত ২০০৫ সালের ১২ জুলাই রায় দেন।
এই ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) এখনো বিচারাধীন। একইভাবে টঙ্গীর জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্ল্লাহ মাস্টার এমপি হত্যা মামলায় ওই বছরের ১৬ এপ্রিল ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন। এ মামলায় হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সটিও বিচারাধীন। এ ছাড়া
নিম্ন আদালতের দেওয়া রায়ে জুরাইনের শিল্পপতি মো. আলম হত্যা মামলায় ২০০৫ সালের ৩১ জুলাই নিহত আলমের দুই জামাইসহ ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মতিঝিলে দুই পুলিশকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় ২০০৬ সালের ২৭ এপ্রিল সাবেক ছাত্রদল নেতা আবদুল্লাহিল বাকী ইদুলসহ চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতের দেওয়া এসব মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্টের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে এবং এর ফলে মামলার (ডেথ রেফারেন্স) জট বাড়ছেই।
সূত্র মতে, গত এক বছরে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা ১০০ বেড়েছে। গত ৩১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হাইকোর্টে ৫৫২টি ডেথ রেফারেন্স এখন বিচারাধীন। এর মধ্যে হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চে ১২টি ডেথ রেফারেন্সের বিচার চলছে। এ ছাড়া সাতটি ডেথ রেফারেন্সের পেপারবুক প্রস্তত রয়েছে। আরো ছয়টির পেপারবুক তৈরি করতে বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছে। গত বছর জুন পর্যন্ত বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা ছিল ৪৫১টি।
বর্তমানে বিচারাধীন সাড়ে ৫০০ ডেথ রেফারেন্সের মধ্যে ২০০৫ সালে হাইকোর্টে পাঠানো ডেথ রেফারেন্স এখনো বিচারাধীন। ওই বছর ১২১টি ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে এলেও এখনো চার-পাঁচটি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রয়োজনীয়সংখ্যক আদালত ও পেপারবুকের অভাবেই ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা স্বীকার করছেন।
দেশের ৬৮টি কারাগারে এখন প্রায় ৮০০ মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি কনডেম সেলে রয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই রয়েছে শতাধিক আসামি। হত্যা-অপহরণ করে লাশ গুম করা, ধর্ষণসহ জঘন্যতম অপরাধে নিম্ন আদালত থেকে তাদের ফাঁসির এ সাজা দেওয়া হয়। আইন অনুযায়ী এ সাজা কার্যকর করতে হলে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। কোনো আসামি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকেই এসব মামলার নিষ্পত্তি করতে হয়। নিম্ন আদালত রায় ঘোষণার পর এ-সংক্রান্ত নথিপত্র উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়, ওই রায় অনুমোদনের জন্য, যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত। তবে নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর আসামিপক্ষই উচ্চ আদালতে আপিল করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তরাও নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। বিষয়টি হাইকোর্টে আসার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে ওইসব মামলার পেপারবুক বিজি প্রেস প্রস্তুত করে তা হাইকোর্টে পাঠায়। এরপর তালিকার ক্রম-অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স শুনানির ক্ষমতাপ্রাপ্ত বেঞ্চে পাঠানো হয়। সে অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।
ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে মাত্র তিনটি আদালত রয়েছে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকাকালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ডেথ রেফারেন্সের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করার পর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির জন্য পাঁচটি বেঞ্চ গঠন করেন। কিন্তু এখন তা কমিয়ে তিনটি করা হয়েছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও কমেছে। এ ছাড়া বিচারপতি খায়রুল হকের সময় বিজি প্রেসে দ্রুত পেপারবুক তৈরির জন্য তাগাদা দেওয়া হয়। এরপর বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষ গত জানুয়ারিতে পেপারবুক তৈরির জন্য পৃথক একটি ইউনিট গঠন করে।
পেপারবুক তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এ বছরের শুরুতে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। এ রিট আবেদনে দ্রুত পেপারবুক প্রস্তুতের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি প্রেস স্থাপনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। এরপর হাইকোর্ট একটি রুলও জারি করেন।
বর্তমানে তিনটি বেঞ্চে ১২টি ডেথ রেফারেন্সের বিচারের পাশাপাশি এ তিনটি আদালতে অনেক ফৌজদারি আপিল বিচারাধীন। মূলত অধিকসংখ্যক পেপারবুক না থাকায় এসব আদালতে ডেথ রেফারেন্সের পাশাপাশি ফৌজদারি আপিল শুনানির এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীরা এর কারণ হিসেবে বলেছেন, ডেথ রেফারেন্সের বিচারের জন্য প্রথম শর্ত পেপারবুক তৈরি করা। এই পেপারবুকের অভাবে যেন সংশ্লিষ্ট আদালতকে বসে থাকতে না হয়, সেজন্যই এটা করা হয়। পর্যাপ্ত পেপারবুক থাকলে অন্য কোনো মামলা বিচার করার সুযোগ থাকত না।
অ্যাটর্নি জেনারেল সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হতে বেশ সময় লাগে। এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য মামলার মতো দ্রুত নিষ্পত্তি করার সুযোগ নেই। ডেথ রেফারেন্সের স্তূপ কমাতে হলে অনেক বেঞ্চ গঠন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিচারকের। পর্যাপ্তসংখ্যক বিচারক না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না বলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হলে আরো বিচারক নিয়োগ দিতে হবে, বাড়াতে হবে বেঞ্চ।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিদেশ সফরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ডেথ রেফারেন্স মানেই জীবন-মৃত্যুর সমস্যা। তাই এটা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিচার করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, ডেথ রেফারেন্স শুনানির আগে পেপারবুক তৈরি করতে হয়। এজন্য কিছু প্রশাসনিক কাজ আছে। এটা করতে সময় দরকার। তিনি বলেন, পেপারবুক তৈরিতে বিলম্ব ও প্রশাসনিক সমস্যার কারণে মামলার সংখ্যা কিছু বেড়েছে। তবে ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা কমাতে হাইকোর্ট বিভাগে শিগগিরই আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট আনিসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কনডেম সেলে মানুষকে বেশি দিন আটক রাখা ঠিক নয়। মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে বছরের পর বছর কারাভোগ করুক বা ভীতিতে থাকুক, এটা আমি চাই না।' তিনি বলেন, বিচার প্রার্থী বিশেষ করে আসামিদের বিচার বিলম্বিত হোক, এটা কাম্য হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় থেকে অভিজ্ঞতা হয়েছে, যেকোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মামলায় বিচার বিলম্বিত হয়, এতে শুধু আসামিদেরই দুর্ভোগ হয় না, যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরও বেদনার শেষ নেই। এ কারণেই যত দ্রুত ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয় ততই ভালো।
অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া বলেন, নিম্ন আদালত হত্যা মামলায় প্রতিটি সাক্ষ্য ভালোভাবে পরীক্ষা করে তবেই সাজা দিয়ে থাকেন। কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর হাইকোর্টে সে মামলা বিচারকালে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। বিচারকরা দেখেন, একটু ভুলের জন্য যেন একজন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ না যায়। এই চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রত্যেক সাক্ষীর সাক্ষ্য ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়। এজন্য একটি মামলার বিচার শেষ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। সাধারণ মামলার মতো ডেথ রেফারেন্স শুনানি দ্রুত করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, দ্রুত পেপারবুক তৈরি না হওয়ায় এবং আদালতের সংখ্যা কম হওয়ায় মামলার সংখ্যা বাড়ছে।
No comments