ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার by তানভীর মোকাম্মেল

ম্যাক্সিম গোর্কির একটা বিখ্যাত ছোটগল্প আছে ‘ছাব্বিশ জন মানুষ ও একটি মেয়ে’।  খবরের কাগজে দুটো খবর পাশাপাশি দেখে ওই গল্পের শিরোনামটি মনে পড়ল। একটি খবর হচ্ছে ‘হা-মীম গ্রুপের পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন মানুষের মৃত্যু’ এবং আরেকটি খবর ‘শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশু গ্রেপ্তার’। কিছুদিন ধরে পোশাকশিল্পে মজুরি নিয়ে অস্থিরতা চলছিল চট্টগ্রামের ইপিজেডে, নারায়ণগঞ্জে ও ঢাকার খিলক্ষেতে।
মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে পোশাকশিল্পের মালিকপক্ষের সঙ্গে বসলেও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসার প্রয়োজন বোধ করেননি। শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের শক্ত হাতটাই কেবল দেখানো হয়েছে—বেধড়ক লাঠিপেটা, হয়রানি ও গ্রেপ্তার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কলঙ্কলেপনের চেষ্টা, যারা পোশাকশিল্পের মেয়েদের মজুরি নিয়ে আন্দোলন করে, তারা বিদেশের চর। এই অভিযোগটি যা মালিকপক্ষ বা ক্ষমতাসীনেরা প্রায়ই বলার চেষ্টা করে থাকেন যে পোশাকশিল্পের মিছিল-মিটিং-আন্দোলনের পেছনে বিদেশি শক্তি রয়েছে। একটু ঝেড়ে কাশলে হতো না! এই বিদেশি শক্তি ঠিক কারা? সেই পাকিস্তান আমল থেকেই এ দেশের শাসকশ্রেণীর একটা কায়দা চালু রয়েছে, যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামকেই ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ বলার। যেভাবে সরকারি দলের লোক ও পোশাকশিল্পের মালিকেরা প্রতিবেশী দেশের হাত আছে—এসব বলছেন, তাতে সরাসরি ভারতের নাম না বললেও ভারতের প্রতিই যেন ইঙ্গিতটা যায়। এখন বায়ান্ন সালে যাঁরা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাজউদ্দীন আহমদ কিংবা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা, তাঁদের সবারই তকমা জুটেছিল ‘ভারতের চর’ (!) হিসেবে। এমনকি একাত্তর সালের এই ডিসেম্বর মাসেই রায়েরবাজারের ইটের পাঁজায় এ দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের যখন গুলিতে ও বেয়নেটের খোঁচায় খুন করা হচ্ছিল, তখনো তাঁদের ‘ভারতের এজেন্ট’ হিসেবেই হত্যা করা হয়েছিল! পোশাকশিল্পের আন্দোলনকারী শ্রমিক ও নেতানেত্রীদেরও আজ দেখছি সেই তকমাই জুটছে!
যদিও সস্তা ভারতবিরোধিতা এ দেশে বেশ ভালো রাজনৈতিক সুবিধা দেয় কিন্তু পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কুৎসার আসলে কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কারণ ভারত পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের কোনো প্রতিযোগী নয়। যারা সত্যিকারের প্রতিযোগী, সেই ভিয়েতনাম বা কম্পুচিয়া বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে অস্থির করার জন্য এ দেশে এজেন্ট-প্রভোকেটায়ার পাঠাচ্ছে, এটা ভাবা বেশ কষ্টকল্পিত কল্পনা! আসলে এমন কোনো আন্দোলন কি কোনো কারখানায় কখনো হয়েছে, যেখানে নিয়ম মেনে মাসের প্রথম সপ্তাহে শ্রমিকদের ঠিকঠাকমতো বেতন দেওয়া হয়েছে? বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে এসব মেয়ে কারখানায় চাকরি করতে এসেছে মজুরি পাওয়ার আশায়। আন্দোলন-মিছিল, গাড়ি ভাঙচুর বা পুলিশের প্রতি ঢিল-পাটকেল মারার জন্য নয়। যখন মালিকপক্ষ বেতন নিয়ে কোনো ঝামেলা করে, কেবল তখনই আন্দোলন-বিক্ষোভ হয়।
পোশাকশিল্পের মালিকেরা কথায় কথায় বলেন, এই শিল্প থেকে কত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে। নিজেদের বিলাসব্যসনে তাঁরা অনেক ব্যয় করলেও এই শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি গত কয়েক বছরে কিন্তু বেড়েছে সামান্যই এবং সেই যৎসামান্য মজুরি দিতেও মালিকপক্ষের নানা গড়িমসি। ফলে আন্দোলন তো হবেই। মোশরেফা মিশুর মতো নেত্রীও তৈরি হবে।
আসলে পোশাকশিল্পের দুই দশক পার হলেও বাংলাদেশের মালিকদের মধ্যে এখনো দায়িত্বশীল ফ্যাক্টরি-মালিকের চরিত্র তেমনভাবে গড়ে ওঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেন না, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন না, তাঁদের যেকোনো দাবি বা ক্ষোভকে মাস্তান বা পুলিশ দিয়ে দমাতে চান। দাবি তোলেন শিল্পাঞ্চল পুলিশের, যেন সমস্যাটা কেবল আইনশৃঙ্খলার। নিজ নিজ কারখানায় শ্রমিকদের প্রতি কারখানা-মালিকদের দায়িত্ববোধ কাকে বলে, সেটা পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর কথা বাদই দিলাম, প্রতিবেশী দেশের টাটা গ্রুপের শিল্প-কারখানাগুলো দেখেও তো তাঁরা শিখতে পারেন। আসলে আমাদের এই প্রথম প্রজন্মের পোশাকশিল্পের মালিকেরা এখনো কারখানাগুলো চালান ব্যবসায়ী হিসেবে, ঠিক শিল্পপতি হিসেবে নয়। ফলে দ্রুত এবং আরও দ্রুত সর্বোচ্চ মুনাফা বাগিয়ে নেওয়ার বেনিয়া তাগিদ তাঁদের যতটা দেখা যায়, শ্রমিকদের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করে একটা শিল্প গড়ে তোলার পরিশ্রম ও নিষ্ঠা ততটা দেখা যায় না। পোশাকশিল্প বর্তমানে হাজার হাজার কোটি টাকার এক শিল্প, যা দরিদ্র বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই খাতে লাখ লাখ পরিবার ও মানুষের ভাগ্য আজ জড়িত। তাই এ খাতের উত্থান-পতনের ব্যাপারে কেউই আর নীরব থাকতে পারেন না।
মালিকপক্ষের দায়িত্বহীনতার আরেকটা সাম্প্রতিক ও করুণ অভিজ্ঞতা ঘটল হা-মীম গ্রুপের অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন অসহায় নারী-পুরুষ দরিদ্র শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায়। হ্যাঁ, এখানেও আগুন লাগার পর গেটে তালা! হয় আগুনে ঝলসে মরো, অথবা কয়েক তলা ওপর থেকে ঝাঁপ দাও!! গাড়ি ভাঙচুরের কথিত অপরাধে যদি শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশুকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া হয়ে থাকে, আমরা তো জানতে চাইতেই পারি যে ২৬ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আর এটাই তো প্রথম নয়, পোশাকশিল্পের জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার নারী শ্রমিক বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মরেছেন বা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অগণন। রাস্তায় মিছিল-বিক্ষোভ করলে যদি তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে এতগুলো মানুষের মৃত্যুর কারণে কতজন পোশাকশিল্পের মালিককে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে তালিকাটা দেখতে পারলে খুশি হতাম। কাগজে ও টিভির পর্দায় প্রায়ই ছবি দেখি, পুরুষ পুলিশেরা মিছিল করার অপরাধে নির্মমভাবে পোশাকশিল্পের মেয়েদের লাঠিপেটা করছে। দেশবাসী কতই না খুশি হতো, যদি এ পর্যন্ত তিন হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য এবং অসংখ্য নিয়ম ভাঙার জন্য দায়ী মালিকদের কাউকে পুলিশ শায়েস্তা করছে—এ রকম দৃশ্য দেখতে পেত! পুলিশের সমস্যাটা আমরা বুঝি, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম! কিন্তু দেশের আদালতগুলোর কাছ থেকে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্বে আমরা আরও নিরপেক্ষতা আশা করি।
হা-মীম গ্রুপের অগ্নিকাণ্ডের পর টেলিভিশনের পর্দায় ফ্লাশ নিউজে বারবার দেখানো হচ্ছিল, নিহত প্রতিজনের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। যেন এই লাখ টাকাই একজন মানুষের জীবনের বিনিময়মূল্য! আমাদের ধর্মশাস্ত্রে আছে, ‘মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত’, সৃষ্টির সেরা জীব। তাকে এভাবে পুড়িয়ে মেরে কিছু মূল্য ধরিয়ে দেওয়া দরিদ্র-অসহায় এ পরিবারগুলোর অশ্রু ও অবরুদ্ধ কান্নার প্রতিই যেন এক নির্মম উপহাস মাত্র!
পোশাকশিল্পের মেয়েদের মধ্য থেকে আরও অনেক প্রতিবাদী মোশরেফা মিশু যে জন্ম নেবে, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
=================================
৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন  এরশাদের বিচার হওয়া উচিত  ছোটদের বড় সাফল্য  প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাঃ পাস ৯২%, প্রথম বিভাগ বেশি  বাংলাদেশের বন্ধুঃ জুলিয়ান ফ্রান্সিস


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ তানভীর মোকাম্মেল
চলচ্চিত্রনির্মাতা


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.