বরুণ ফোটার অপেক্ষায় ভাটির ভাসান পানি -শ্রদ্ধাঞ্জলি by পাভেল পার্থ

বাংলাদেশে একেক অঞ্চলে একেক রকমের তৃণগুল্ম ও বৃক্ষরাজি। একেক ফুলের একেক রং, একেক ঘ্রাণ। হাওর-ভাটির নানা প্রান্তে জন্মে এমনই কত না বর্ণ-গন্ধের উদ্ভিদ। করচ, হিজল, কদম, তমাল, সিংড়া, বনতুলসীর মতো বরুণ এক বৈশিষ্ট্যময় জলাভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ। ভাটি অঞ্চলে ধানকাটার সময় টেপী বোরোর গরম গরম ভাতের সঙ্গে বরুণের কচি ডগা ভর্তা-ভাজি করে গৃহস্থ নারীরা কামলাদের খেতে দেন। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে হাওরের নারীরা সংগ্রহ করেন বরুণ ফুল। আসছে বছরটি যাতে পরিবার ও গ্রামসমাজের জন্য মঙ্গলময় হয়, সে জন্য বরুণের ফুল গ্রামময় গেঁথে দেওয়া হয় গোবরের দলায়। হাওরাঞ্চলে এ পর্ব আড়িবিষুসংক্রান্তি নামে পরিচিত। বসন্তের শুরুতে সাদা ফুলে ছেয়ে যায় বরুণের ডাল। বর্ষাকালে বরুণের ডালে থোকা থোকা ফল ধরে। ফলের ভেতরেই থাকে আগামী দিনের অনন্য সব বরুণের সম্ভাবনার বীজ। বর্ষাকালেই হাওরজুড়ে ভাসান পানির থইথই। বর্ষার ভাসান পানির সঙ্গী হয় ফলন্ত পোয়াতি বরুণের ঘাড় উঁচু সব ডাল। বরুণগাছ ছাড়াও আরেক বরুণ হাওর-ভাটির ভাসান পানির সঙ্গী হয়েছিলেন। নথিপত্রে প্রসূন কান্তি (বরুণ) রায় নাম থাকলেও ভাটিবাংলায় তিনি বরুণ রায় নামেই জয় করেছিলেন হাওরবাসীর বিশ্বাস।
বাংলাদেশে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড দেশে ৪১৪টি হাওর আছে বলে তাদের এক দলিলে উল্লেখ করে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪২৩টি হাওর রয়েছে। দেশের মোট আয়তনের ৬ ভাগের ১ ভাগজুড়ে এই হাওরাঞ্চলে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। এককালে হাওরে জন্মাত অবিস্মরণীয় সব গভীর পানির ধানের জাত। উপমহাদেশের প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৪ সালে হাওরের হবিগঞ্জ জেলার নাগুড়াতে। সেই প্রতিষ্ঠানকে বদলে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক গবেষণাকেন্দ্র। গবেষণা ও উন্নয়নের নাম করে গভীর পানির ধানের জাতগুলো ডাকাতি করেছে ইরি ও সিজিআরআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকের পর তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের নামে রাষ্ট্রের মাধ্যমে রাসায়নিক কৃষি চালু হওয়ায় বাংলাদেশের হাকালুকি, হাইল, শনির, দেখার, টাঙ্গুয়ার, পচাশোল, সজনার মতো বৈশিষ্ট্যময় হাওরগুলোতে জমেছে করপোরেট কোম্পানির বিষ। মেঘালয় পাহাড়ে অন্যায় ও অপরিকল্পিত করপোরেট কয়লা, পাথর ও ইউরেনিয়াম খনির ফলে ভাটিবাংলার হাওর-জলাভূমি প্রশ্নহীনভাবে জখম হচ্ছে দিনের পর দিন। হাওরের ধান-মাছ-বন-জলসহ প্রাণসম্পদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হাওরবাসী এভাবেই দিন দিন হাওরের সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক করপোরেট বিশ্বায়িত দুনিয়ার পুতুল নাগরিকে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছে।
রাষ্ট্রের রাজস্ব উন্নয়নের নাম করে জমিদারি প্রথার পর হাওরাঞ্চল দখল করে প্রশ্নহীন অন্যায় ইজারাদারি। হাওর ইজারাদারেরা কিছুদিনের মধ্যেই ‘ওয়াটার লর্ড’ নামে হাওর এলাকার দখলদার হয়ে ওঠে। অন্যায়ভাবে তারা হাওরনির্ভর কৃষক ও জেলের ভাসান পানিতে মাছ ধরার প্রথাগত অধিকারও কেড়ে নেয়। রাষ্ট্র সমানে রাজস্ব আদায়ের নাম করে দেশের সব হাওর-জলাভূমি ইজারা দিতে থাকে। বহিরাগত ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা মত্স্যজীবী সংগঠনের নামে কেবল হাওর নয়, নদী পর্যন্ত ইজারা নেওয়ার মতো বাহাদুরিও করেছে হাওর এলাকায়। যেমন, একটি ২০ একর বা তার ওপরের হাওর-জলাভূমি বিল (সরকারের ভাষায় যা জলমহাল) ইজারা দিয়েছে সরকার। ওই বিলের সীমানা হেমন্তকালে ২০ একর হলেও বর্ষাকালে প্লাবনে ভেসে যায় চারদিক। আর কোনো সীমানা থাকে না জলাভূমির। ২০ একরের ভেতরের মাছসহ সব জলজ প্রাণ ‘সীমানা লঙ্ঘন’ করে। ইজারাদার বাদে যদি গ্রামের কোনো দরিদ্র প্রান্তিক কৃষক বা জেলে বা যে কেউ এই ভাসান পানিতে মাছ ধরতে যায়, তবে তাকে ভয়াবহভাবে জখম হতে হয়। ইজারাদার তাকে বাধা দেয় এবং ভাসান পানিতেও তাকে মাছ ধরতে দেওয়া হয় না। তখন আর ইজারাদার তার সীমানাকে ২০ একর হিসাবে চিহ্নিত না করে ভাসান পানিতেও তার মাছ ভেসে গেছে বলে ওই মাছ না ধরার ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করে। ধানের আবাদ না করলে যেমন হাওরবাসীর চলে না, তেমনি মাছ না ধরলেও হাওরবাসীর চলে না। বর্ষার ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকারের দাবিতে হাওরের প্রান্তিক জনগণ সংগঠিত হয়েছে নানা সময়ে। ভাটিবাংলার বরুণের ডালে ডালে ঝুলে থাকা বরুণ ফলের ভেতর সেই সব স্মৃতিচিহ্নের দ্রোহের ঝাঁজ এখনো বিরাজমান।
বরুণ রায় ভাটিবাংলার বরুণ ফলের ভেতরের সেই আহাজারি টের পেয়েছিলেন। তাই বরুণ ফলের মতো তিনিও সঙ্গী হয়েছিলেন ভাসান পানির। মূলত হাওরাঞ্চলে আশির দশকে গড়ে ওঠে ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার আন্দোলন। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ভাসান পানির অধিকারের দাবিতে সংগঠিত এই গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বরুণ রায়। মূলত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক ও ক্ষেতমজুর সমিতির সদস্য-কর্মীরা এই আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক চেহারা দাঁড় করান।
কমরেড বরুণ রায় ১৯২২ সালের ১০ নভেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী গ্রামের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন এবং ১৯৫০ সালে পার্টির সিলেট জেলা শাখার সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের এক লড়াকু বীর বরুণ রায় ১৯৮৮ সালে সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ৮ ডিসেম্বর ২০০৯ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় সুনামগঞ্জ শহরের হাসননগরের নিজ বাসভবন থেকে ৮৮ বছর বয়সে বরুণ রায় হাওরের পাড়ে লড়াই করে টিকে থাকা বরুণগাছের শীর্ষে চলে যান। শীলা রায়, যিনি তাঁর সংসার-জীবনেরও সহযোদ্ধা হয়ে ছিলেন, তিনিই মঙ্গলবার রাতে তাঁর মুখাগ্নি করেন।
হাওরের ভাসান পানি বরুণের ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বসন্তেই ফুটবে ফুল, তারবাদে বর্ষাতে ডালে ডালে থোকা থোকা ফল। আর ফলের ভেতরেই থাকবে আগামীর সব অপ্রতিরোধ্য সম্ভাবনা। আবারও ভাটিবাংলায় বরুণের ফল থেকে গজাবে চিরঅম্লান বরুণেরা। অসাম্যের ইজারাদারি বাতিল করে ভাসান পানিতে হাওরের প্রান্তিক জনগণের অধিকার একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই হবে। বরুণের বীজের ভেতর হাওর-ভাটির সেই দ্রোহের ব্যঞ্জনা নিরন্তর বিরাজমান। বরুণ রায় বীজের ভেতর সেই সম্ভাবনা ও আহাজারিকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। ভাটিবাংলার জনগণও তার প্রয়োজনেই বরুণের বংশ শেষ হতে দেবে না কোনো দিন। ভাসান পানির সঙ্গী বরুণ বৃক্ষের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে বঞ্চিত হাওর। আমরা কি বরুণ রায়ের মতো হাওর-ভাটির সেই ডাকে সাড়া দিতে আগ্রহী?
পাভেল পার্থ: প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.