বিএনপির বিলম্বিত কাউন্সিল সফল হোক -সৈয়দ আবুল মকসুদ

স্কুলছাত্রদের পরীক্ষায় ভাবসম্প্রসারণ আসে: ‘জন্ম হোক যথাতথা, কর্ম হোক ভালো।’ অর্থাত্ কোথায় কার জন্ম সেটা বড় কথা নয়, কে কত ভালো কাজ করে নিজের ও মানুষের মঙ্গল করতে পেরেছে, সেটাই বড়। এ কথা কোনো মানুষের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও। আব্রাহাম লিঙ্কন জন্মেছিলেন দীর্ণতম কাঠের ঘরে, তিনিই দেশের ও জাতির উপকার করেছেন আর যেকোনো প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি। কোন রাজনৈতিক দলের কোথায় জন্ম, সে কথা কে মনে রাখে। হতে পারে কোনো দলের জন্ম মোগলটুলি বা স্বামীবাগের গোলাপবাগানে অথবা কুর্মিটোলায়। তাতে বিশেষ কিছু যায়-আসে না। দলটি জনগণের জন্য কী করল, সেটাই বিচার্য।
বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, যার ইংরেজি তর্জমা ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি’, সংক্ষেপে বিএনপি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই দল গঠন করেন। দল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় নিয়ে যায়নি; নিজের হাতে গঠন করে তিনিই দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যান। তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ছিল তাঁর অনুকূলে। সুতরাং নানা মত ও পথের মানুষকে জড়ো করে তিনি তাঁর দলকে সংহত ও শক্তিশালী করেন। কেউ ক্ষমতার রাজনীতির স্বাদ উপভোগ করতে চাইলে বিএনপির দরজার দুটি পাল্লাই তার জন্য খোলা ছিল। মোটের ওপর একটি মধ্যপন্থা অবলম্বন করায় জিয়ার অনুপস্থিতিতেও দলটি তাঁর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারে। জিয়ার মৃত্যু ও বেগম জিয়ার মঞ্চে প্রবেশ—তার মাঝখানের সময়টিতেও দলটি শক্তই ছিল।
প্রতিষ্ঠাতা সামরিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় বিএনপির মধ্যে যে সামরিক গন্ধ ছিল, বেগম জিয়া দলের হাল ধরার পর, বিশেষ করে আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর আপসহীন ভূমিকার কারণে, তা দূর হয়ে যায়। দলটি সম্পূর্ণ বেসামরিক চরিত্র অর্জন করে। বেগম জিয়ার নীতি যতই রক্ষণশীল হোক, তিনি একজন গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। সেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সমান্তরালভাবে নেতৃত্ব দেয়। স্বৈরাচারের পতনের পর দুটি দলই ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত চারবার পালাক্রমে সরকার গঠন করেছে এ দুই দলই। এতে প্রতীয়মান হয়, জনগণের মধ্যে তাদের অবস্থান খুবই শক্ত।
এক নেতানির্ভর হওয়ায় দুটি দলেই নেতৃত্বের গণতান্ত্রিক বিকাশ ঘটেনি। তাঁরা দেশে গণতন্ত্র চান, অবশ্য জনগণ চায় বলেই তাঁরা চান, কিন্তু দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা হোক তা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পছন্দ নয়। দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চেয়ে সামন্তবাদী চেতনাই বেশি কার্যকর। নেতা-কর্মীদের স্বাধীন মত প্রকাশের উপায় নেই বললেই চলে। নেতার নির্দেশ নতমাথায় মেনে চলতে হয়। সাহস করে কেউ মাথা তুলতে চাইলে তাঁর মাথায় লগুড়ের আঘাত পড়ে।
যেকোনো দলের গণতন্ত্রের চর্চা দেখা যায় তার কাউন্সিলে। কিন্তু একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর মতো এক নেতাবাদী দলগুলোর জন্য কাউন্সিল এক উটকো ঝামেলা। কোনো দিনই যদি আমাদের বড় দলগুলোর কাউন্সিল ডাকতে না হতো, তাহলে খুবই ভালো হতো। এতকাল সে অবস্থাই ছিল; কিন্তু বিপত্তি ঘটিয়ে গেছে গত বিশেষ সরকার। তারা আরশ থেকে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে এসেছিল দেশ থেকে দুর্নীতি ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেন এবং রাজনীতিতে এমন সংস্কার করবেন যা পৃথিবীর আর কোনো দেশে এ পর্যন্ত হয়নি। কথিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অগণিত মামলা ঠোকার কারণে গিনেস বুকে ওই সরকারের স্থান হতে পারে। রাজনীতির সংস্কার করতে গিয়ে বিশেষ সরকার ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) আইন, ২০০৯’ প্রণয়ন করে যায়, যা নবম জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এ আইনে নানা রকম শর্ত আছে। প্রধান ও প্রথম শর্ত হলো—রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য হতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিবন্ধিত হতে হবে এবং তাহলে তার গঠনতন্ত্রে যেসব বিধান রাখতে হবে তা হলো—১. কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ের কমিটির কর্মকর্তাদের নির্বাচিত হতে হবে; ২. কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ের কমিটিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে; ৩. কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা ছাত্র অথবা আর্থিক, বাণিজ্যিক অথবা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তা অথবা শ্রমিকদের অথবা অন্য কোনো পেশার সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংগঠনকে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না ইত্যাদি।
নির্বাচন কমিশন যখন এই ফরমান জারি করে, তখন বড় দলগুলো প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া ও তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে। তারা বলতে চাইল: এসব ছাইপাঁশ আমরা মানব না। এত দিন খুশিমতো দল করেছি, এখন এসব কী? কিন্তু বৈদেশিক বন্ধু, প্রচারমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের চাপে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধিত হতে হয়েছে এবং গঠনতন্ত্র জমা দিতে হয়েছে নির্বাচন কমিশনে। দায়ে পড়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটিও গঠন করা হয়েছে। দল নিবন্ধন ও গঠনতন্ত্র জমা দিতে গিয়ে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছিল জামায়াতে ইসলামী। তার খোলনলচেয় টান পড়েছিল। কোনো রকমে আল্লাহ আল্লাহ করে উতরে গেছে।
কিন্তু কাউন্সিল ডাকা, নির্বাচন করা ইত্যাদির কথা শুনে সবচেয়ে বেশি মেজাজ তিরিক্ষে হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। শেষ পর্যন্ত ৩৯টি দল অস্থায়ী গঠনতন্ত্র জমা দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারম্যান সেনাপতির মতোই ঘোষণা দিলেন: ‘আমি মৃত্যু পর্যন্ত চেয়ারম্যান থাকব।’ মরণোত্তর চেয়ারম্যান থাকলেই বা আমরা বাধা দেওয়ার কে? ‘খুব ভালো’ কাউন্সিল করার জন্য বিএনপি ছয় মাস সময় চেয়েছিল। সাত বছর পর তড়িঘড়ি করে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল করে দায় সেরেছে, দায়িত্ব পালন করতে পারেনি যথাযথভাবে। সব দলই বাধ্য হয়ে গঠনতন্ত্র জমা দিয়েছে নির্বাচন কমিশনে। কিন্তু যে রাষ্ট্রে সংবিধানই রাজনীতিকেরা মান্য করতে চান না, সেখানে দলীয় গঠনতন্ত্র যে অবহেলা করা হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এ উপমহাদেশে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসই একমাত্র দল, যা ১৮৮৫ থেকে বিশেষ কারণ ছাড়া প্রতিবছরই কাউন্সিল করে নতুন কমিটি নির্বাচন করেছে। সেভাবেই উমেশচন্দ্র বোনার্জি, দাদাভাই নওরোজি, বদরুদ্দিন তায়েবজি, ফিরোজশাহ মেহতা, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, জিন্নাহর শ্বশুর দীনশ ওয়াচা, অ্যানি বেশান্ত, মতিলাল নেহরু, হাকিম আজমল খাঁ, চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা মোহাম্মদ আলী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু থেকে ইন্ধিরা গান্ধী পর্যন্ত কংগ্রেস সভাপতির পদ অলংকৃত করেছেন অন্তত ৮০ জন নেতা। মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা বছর-বছর কাউন্সিল করে নতুন নেতা নির্বাচন করা পছন্দ করত না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুসলিম লীগেরই বংশধর। সুতরাং এ দলে এক বছর, দুই বছর বা তিন বছর পর পর নতুন নেতা নির্বাচিত হবেন তা আশা করা মরুভূমিতে পুকুর প্রত্যাশা করার মতো দুরাশা। দুর্ভাগ্য এ দুই দলের বড় নেতাদের। তাঁদের অবিচুয়ারিতে কোনো দিন লেখা হবে না: তিনি অত সাল থেকে অত সাল দলের সভাপতি ছিলেন। হয় প্রেসিডিয়াম সদস্য, নয়তো স্ট্যান্ডিং কমিটিতে গিয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আমৃত্যু।
বহু বছর পরে বিএনপির কাউন্সিল হতে যাচ্ছে। কোনো কাগজ লিখেছে ‘কাউন্সিল উত্সবমুখর পরিবেশে হবে’, কোনো কাগজ বলছে ‘কাউন্সিল নিয়ে সাজ সাজ রব’ ইত্যাদি। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেগম খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন করে নির্বাচিত হওয়ায় তাঁকে অভিনন্দন জানাই। এ মুহূর্তে তাঁর চেয়ে যোগ্য আর কোনো নেতা দলে নেই, তা একজন বালকও বলবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াও দোষের কিছু নয়। মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু হতেন। এখন শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়া হচ্ছেন। ভারতে কংগ্রেসে সোনিয়া গান্ধীর প্রতিদ্বন্দ্বী আপাতত কেউ নেই।
উত্সব ও সাজ সাজ রবের কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবিক পক্ষে দলের কাউন্সিল কোনো বড়সড় বৌভাতের অনুষ্ঠান নয়, চেহলামের জেয়াফতও নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও নয়। কাউন্সিল কোনো যাগযজ্ঞের মতো ব্যাপার নয়, এক অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অনুষ্ঠান। কোনো কোনো কাউন্সিল থেকে দেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হয়।
কমিউনিস্ট পার্টির প্লেনাম আর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পার্টির কাউন্সিলও এক রকম নয়। সিপির প্লেনাম বড় সাংঘাতিক। সেখানে থিসিস দেওয়া হয়। কোনো কোনো থিসিস বা দলিল পাঠ করে কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক সদস্যের মাথা পর্যন্ত খারাপ হয়ে যাওয়ার জো হয়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলে সে সমস্যা নেই। নেতার কথা শিরোধার্য করে বিরিয়ানি বা তেহারি খেয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেই হলো।
ইসলামি দর্শনে সংস্কারবাদীদের বলা হয় মোতাজিলা সম্প্রদায়। পৌষ-পরবর্তী দুই-বছরি সরকার এসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে দুটি মোতাজিলা গোষ্ঠী তৈরি করে গেছে। আওয়ামী লীগের মোতাজিলাদের কেউ কেউ শুধু উপদেশ দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন, কেউ কিছুই পাননি। বিএনপির মোতাজিলাদের প্রায় সবাই মূলস্রোতে আসতে পেরেছেন। মান্নান ভুঁইয়া এককালে বামপন্থী ছিলেন। সাইফুর রহমানকে ডেকে এনে তিনি ড্রইংরুমেই পার্টির প্লেনাম করে ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সাইফুর রহমানকেও বেগম জিয়া গ্রহণ করেছিলেন। শুধু মান্নান ভুঁইয়াই মোতাজিলা বা সংস্কারবাদী হিসেবে বর্জিত হলেন।
বিএনপিতে এখন সনাতনপন্থী ও সংস্কারপন্থীর সমস্যা বিশেষ নেই। কাউন্সিলে পদ পাওয়া নিয়ে একে অপরকে সংস্কারবাদী বলে চিত্রিত করার চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু তাতে বড় কোনো ঝামেলা হবে বলে মনে হয় না। পুনর্নির্বাচিত হয়ে বেগম জিয়া ‘কাউন্সিলের পর দলকে নবরূপে সাজানোর প্রত্যাশার কথা জানিয়ে’ বলেছেন, এরপর ‘এক নতুন বিএনপি দেখা যাবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘গুণীজনদের দিয়ে নতুনদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী দিনে বিএনপিকে দেশে-বিদেশে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’ অতীতের দোষ ও দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে যদি অগ্রসর ও আধুনিক ‘নতুন বিএনপি’ আত্মপ্রকাশ করে, তাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া আর সবাই স্বাগত জানাবে। দেশের গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দল দরকার।
কাউন্সিল উপলক্ষে বিএনপি আটটি বই প্রকাশ করেছে। জ্ঞানের ও চিন্তার চর্চা হওয়া ভালো। বইগুলোর শিরোনাম এ রকম: জাতীয় কাউন্সিল স্মারকগ্রন্থ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব ও সমকালীন প্রসঙ্গ, মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্স, জাতীয় বিপ্লব ও সংহতির ৭ নভেম্বর, দেশবাসীর প্রতি দেশনেত্রী প্রভৃতি। যুগ্ম মহাসচিব আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, ‘দলের প্রতিনিধিরা বইগুলোতে জাতীয়তাবাদী দলের ঠিকানা খুঁজে’ পাবেন। বিএনপির যাত্রীরা যদি পথের প্রান্তে তাঁদের দলের ঠিকানা খুঁজে পান, সেটা খুশির কথা।
নোমান সাহেব আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ওপর মৌলিক লেখাগুলোর একটি অংশ নিয়ে যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে, আশা করি এর মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও শহীদ জিয়ার আদর্শের মৌলিকত্ব খুঁজে পাবেন নেতা-কর্মীরা।’ দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও বইটির বিষয়বস্তুর মধ্যে আছে টিপাইমুখে বাঁধ, এশিয়ান হাইওয়ে, করিডর, ট্রানজিট, তেল-গ্যাস ব্লক ইজারা, পার্বত্যচুক্তিতে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি প্রভৃতি। এ বইগুলো আমাকে রিভিউ করতে দিলে আমি বলতাম: এগুলোর বিষয়বস্তু সময়োপযোগী, ভাষা ঝরঝরে, প্রচ্ছদ চমত্কার। কাগজ, ছাপা ও বাঁধাই সুন্দর। আমি এসব বইয়ের বহুল প্রচার কামনা করি।
তবে মনে হয়, আরও কয়েকটি বিষয়ে কিছু বই প্রকাশ করলে আয়োজনটা সম্পূর্ণ হতো। আহমদীয় সরকারের সময় অন্যায্যভাবেও বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই সরকারের ক্ষমতা দখলের পটভূমি সৃষ্টিতে বিএনপির অপশাসন কতটা দায়ী সে সম্পর্কে আত্মসমালোচনামূলক একটি পুঁথি প্রকাশ করা যেত। বাংলার অধ্যাপক ভাই ও শায়খ সাহেবদের উত্থান, পৃষ্ঠপোষকতাদান, পরে বৈদেশিক চাপে তাদের আটক ও শাস্তিদান প্রভৃতি সম্পর্কে হতে পারত একটি সহি বড় জঙ্গনামা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা হতে পারত একটি বইয়ের উপজীব্য। পাকিস্তানের আইএসআই এ দেশে কোনো মহত্তম প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যস্ত আছে কি না সে সম্পর্কে প্রকাশ করা উচিত ছিল একটি মাঝারি আকারের কেতাব।
কাউন্সিল উপলক্ষে খানাপিনার বাইরে আছে স্মরণিকা প্রকাশ, মনোগ্রাম, টিশার্ট, গেঞ্জি, টুপি, কলম, কোট-পিন, বিলবোর্ড, রিংটোন তৈরি প্রভৃতি এন্তেজাম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্বাচনী সংগীত ‘ইয়েস উই ক্যান’-এর অনুকরণে বিএনপির কাউন্সিল সংগীত তৈরি করা হয়েছে। [ইত্তেফাক] এবারের স্ল্লোগান হচ্ছে, ‘নানান মানুষ নানান পথ, দেশ বাঁচাতে ঐক্যমত’। খুব ভালো স্ল্লোগান। কিন্তু ‘ঐক্যমত’ অর্থ ‘আমার মত’ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, অন্যের কাছে আমারও এগিয়ে যাওয়া।
মাথামোটা মানুষ যেকোনো দলেই থাকে, কিন্তু বিএনপিতে উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী মানুষ অনেকেই আছেন। তেমন মানুষ তৃণমূল পর্যায়েও আছেন। তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগালে দল শক্তিশালী হবে। তাঁদের দূরে রেখে মাথামোটা নেতারা যদি নেতা-কর্মীদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাতে থাকেন, তাতে দল দুর্বল হবে।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যেদিন স্বৈরাচারের পতন ঘটে, সেদিন যেন বিধাতা বাংলাদেশি গণতন্ত্রকে আমাদের দুটি বড় দলের হাতে তুলে দিয়েছেন। গত ১৮ বছরে দেখা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়ে, আওয়ামী লীগ দেশ চালালে বিএনপির জনপ্রিয়তার মিটার ওপরের দিকে উঠতে থাকে। আমাদের ভোটারদের মন ওভাবেই গঠিত হয়েছে। এক নতুন বিএনপির কথা বলা হচ্ছে, দেখা যাক কাদের নেতৃত্বে কেমন এক নতুন কমিটি আসে।
বাংলাদেশে একটি ভালো লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি হতে হলে তাকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ইতিহাস-প্রবাহিত আবেগ যুক্তিশীলতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করতে হবে। দ্বিজাতিতত্ত্ব-নির্ভর মুসলিম জাতীয়তাবাদের চেয়ে বাঙালিত্বকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দিতে হবে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো, হাজং, মণিপুরি, রাখাইন প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগণের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সংবেদনশীল হতে হবে। তা ছাড়া মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিদ্যমান বিশ্বপরিস্থিতিতে একটি ছোট দেশের স্বার্থ কীভাবে রক্ষা হতে পারে, সে সম্পর্কে বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করতে পারবে যে দল তারই ভবিষ্যত্ আছে। ধর্মীয় ভাবাবেগ উসকে দিয়ে ভারতবিরোধী জিগির তুলে দলের ও দেশের মঙ্গল করা যাবে না।
বিএনপির চলতি কাউন্সিল অধিবেশনের সাফল্য কামনা করি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.