ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর মরিচের গুঁড়া ছুড়লেন ইসরায়েলি সেনারা: যুদ্ধের বর্বরতার নিন্দায় পোপ
এদিকে গাজা যুদ্ধের বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পোপ লিও চতুর্দশ। একই সঙ্গে তিনি শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন।
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানায়, গাজার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণবাহী ট্রাক পৌঁছানোর পর ৮০ জন নিহত হন। আর দক্ষিণে রাফার কাছে একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর এক দিন আগে এই এলাকায় বহু মানুষ নিহত হন।
সংস্থাটির মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, উপত্যকার দক্ষিণের খান ইউনিসের আরেকটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে আরও ৪ জন নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, তাদের খাদ্য বহনকারী ২৫টি ট্রাকের একটি বহর গাজা সিটির কাছে পৌঁছালে বিপুলসংখ্যক ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় লেগে যায়। এই ভিড়ের মধ্যে গুলি চালানো হয়।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী নিহতের সংখ্যা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তারা বলেছে, গাজা সিটির কাছে হাজারো মানুষ জড়ো হলে সেনারা ‘তাৎক্ষণিক হুমকি প্রতিহত করতে’ সতর্কতামূলক গুলি চালান।
গাজায় ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে বেসামরিক মানুষের মৃত্যু এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র সংকটের কারণে মানুষ ত্রাণকেন্দ্রগুলোয় ভিড় করছেন। আর সেখানেই ইসরায়েলি গুলিতে প্রাণহানি ঘটছে।
জাতিসংঘের হিসাবে, গত মে মাসের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০০ জন ত্রাণপ্রত্যাশী নিহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলা পর গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ইসরায়েলে হামলায় ১ হাজার ২১৯ জন নিহত হন। সেদিন ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস।
জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৮ হাজার ৮৯৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক।
গাজা সিটির হলি ফ্যামিলি গির্জায় আশ্রয় নেওয়া তিন ব্যক্তির নিহত হওয়ার ঘটনায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত বৃহস্পতিবার পোপ লিও চতুর্দশের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। নেতানিয়াহু দাবি করেন, ভুলবশত ছোড়া গোলাবারুদের আঘাতে এ ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল রোববার প্রার্থনার পর পোপ গাজায় চলমান যুদ্ধের বর্বরতার নিন্দা জানান। তিনি শান্তির আহ্বান জানান। গাজার একমাত্র ক্যাথলিক গির্জায় ইসরায়েলি হামলার কয়েক দিন পর তিনি এ আহ্বান জানান।
পোপ বলেন, ওই হামলা ছিল গাজার বেসামরিক জনগণ ও প্রার্থনাস্থলগুলোর ওপর ধারাবাহিক সামরিক আক্রমণের অংশ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার গাজার হলি ফ্যামিলি গির্জায় হামলা চালায় ইসরায়েল। গির্জাটির সঙ্গে প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস নিয়মিত যোগাযোগ করতেন।
ঘটনার দিন জেরুজালেমের রোমান ক্যাথলিক নেতা গ্যাব্রিয়েল রোমানেল্লি জানিয়েছিলেন, গির্জায় হামলায় প্রাণহানি ছাড়াও অনেকে আহত হয়েছেন।
ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর মরিচের গুঁড়া ছুড়লেন ইসরায়েলি সেনারা
গাজায় বিতর্কিত ত্রাণ সংস্থা জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে জড়ো হওয়া ক্ষুধার্ত ও অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর মরিচের গুঁড়া ছুড়েছেন ইসরায়েলি সেনারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
আল–জাজিরার ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা সানাদ ২০ সেকেন্ডের ওই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেছে। এতে দেখা গেছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফা শহরের শাকুশ এলাকায় ইসরায়েলি সেনারা মরিচের গুঁড়ার স্প্রে ব্যবহার করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করছেন।
মুঠোফোনে ভিডিওটি ১০ জুলাই ধারণ করা হয়। শনিবার রাতে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, তিনজন সশস্ত্র ইসরায়েলি সেনা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের ওপর মরিচের গুঁড়া ছুড়ছেন।
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, পুরুষ, নারী ও শিশুরা চারদিকে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছেন। কারও মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা। কেউ আবার পিঠে ময়দার বস্তা তুলে নিয়ে আতঙ্কে ছুটে যাচ্ছেন।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত শনিবার বলেছে, মে মাসের শেষ দিকে জিএইচএফ গাজায় কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৮৯১ জন খাবারের খোঁজে গিয়ে নিহত হয়েছেন।
১৫ জুলাই জাতিসংঘ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৬৭৪ জনেরই মৃত্যু হয়েছে জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রগুলোর আশপাশে।
গাজায় ইসরায়েলের দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা পূর্ণ অবরোধ কিছুটা শিথিল করার পর উপত্যকায় জিএইচএফের ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যত জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন বিশাল ত্রাণ সরবরাহ নেটওয়ার্ককে পাশ কাটিয়ে বিতর্কিত এ কার্যক্রম চলছে।
গতকাল রোববার গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৮৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৩ জনই ত্রাণ সংগ্রহের জন্য জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষ।
এর আগে গত শনিবার গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি হামলায় ১১৬ ফিলিস্তিনি নিহত হন। এর মধ্যে অন্তত ৩৮ জন ছিলেন ত্রাণপ্রত্যাশী।
গাজার বাসিন্দা মাহমুদ মোকাইমার বলেন, তিনিও অন্য মানুষদের সঙ্গে জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রের দিকে যাচ্ছিলেন। ইসরায়েলি সেনারা প্রথমে সতর্কতামূলক গুলি ছোড়েন। এরপর সরাসরি গুলি চালান।
বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে মোকাইমার বলেন, ‘দখলদার বাহিনী আমাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।’
মোকাইমার বলেন, তিনি অন্তত তিনজনের নিথর দেহ মাটিতে পড়ে থাকতে ও আহত বহু মানুষকে দৌড়ে পালাতে দেখেছেন।
গাজার দেইর আল-বালাহ শহর থেকে আল–জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খোদারি বলেন, ইসরায়েল যদি গাজায় আর কোনো খাবার ঢুকতে না দেয়, তাহলে ফিলিস্তিনিদের সামনে খাবারের জন্য জীবন ঝুঁকিতে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।
হিন্দ খোদারি আরও বলেন, মা–বাবারা জানেন, জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রে গেলে গুলিতে মারা পড়তে পারেন, তবুও যান। কারণ, না গেলে তাঁদের শিশুদের না খেয়ে থাকতে হয়। বাজারে কিছুই কেনার মতো অবস্থা নেই, সবকিছুর দাম খুব বেশি।
গাজার অনেক জায়গায় শিশু, এমনকি নবজাতকেরাও না খেয়ে মারা যাচ্ছে।
রোববার গাজা নগরীর আল-আকসা মারটায়ার হাসপাতালের একটি সূত্র আল–জাজিরাকে বলেছেন, রাজান আবু জাহের নামের চার বছর বয়সী এক শিশু অপুষ্টি ও অনাহারের কারণে মারা গেছে।
শনিবার আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক বলেছেন, সেখানে দুজন ফিলিস্তিনি অনাহারে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫ দিন বয়সী এক শিশুও আছে।
![]() |
| গাজা উপত্যকার একটি এলাকায় ত্রাণের জন্য জড়ো হয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। ২০ জুলাই ২০২৫ ছবি: রয়টার্স |

No comments