ইসরায়েলকে পস্তাতে হবে: সহায়তা না পেয়ে সিরীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্ষোভ

সিরিয়ায় যুদ্ধরত অন্তত ১২টি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে গোপনে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়েছিল ইসরায়েল। সিরিয়ায় সক্রিয় থাকা ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য ও ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকে সীমান্ত থেকে দূরে রাখতে ইসরায়েলের এই গোপন প্রচেষ্টা। কিন্তু রাশিয়ার সমর্থনে অগ্রসরমান আসাদ বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে সহায়তা না করায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ এতদিন ধরে ইসরায়েলি সহায়তা পেয়ে আসা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার কারণে বিদ্রোহীদের সরকারি বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়ার ইসরায়েলি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে মন্তব্য করা হয়েছে, ইসরায়েলের মানবতার প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই। তার মূল লক্ষ্য, তার নিজের স্বার্থ। সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আপোষ করতে বিদ্রোহীরা বাধ্য হয়েছে। আর এর ধারাবাহিকতায় নিকট ভবিষ্যতে ইসরায়েলকেই ভুগতে হবে। দক্ষিণ সিরিয়ার হামলার বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থাকা ইসরায়েল তার সিদ্ধান্তের কারণে পস্তাবে। মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসি জানিয়েছে, গত জুন মাসে ইসারায়েল বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সংশ্লিষ্ট ১২টি সশস্ত্র গোষ্ঠীর দুই ডজন কমান্ডার ও উচ্চপদস্থ নেতারা এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার এই প্রক্রিয়া চলেছে গত কয়েক বছর ধরে। ইসরায়েলের কাছ থেকে অ্যাসাল্ট রাইফেল, মেশিন গান, মর্টার লঞ্চার এবং যানবাহন পেয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এসব সরবরাহ করা হয়েছে গোলান মালভূমিতে অবস্থিত সিরিয়া-ইসরায়েল সীমান্তের তিনটি চৌকি দিয়ে। ওই একই সীমান্ত দিয়ে ইসরায়েল এতদিন দক্ষিণ সিরিয়ায় যুদ্ধপীড়িত মানুষের জন্য ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়ে এসেছে। অস্ত্রের পাশাপাশি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের বেতন বাবদ অর্থ পরিশোধ করেছে ইসরায়েল। এসব যোদ্ধারা মাসে ৭৫ ডলার করে পেত। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, সিরিয়ার বিদ্রোহী এসব গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র কেনার জন্য আলাদা বরাদ্দও দিয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলি সহায়তা পেতে থাকা গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রত্যাশা করেছিল, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের বাহিনী যদি দক্ষিণ সিরিয়ায় হামলা চালায় তাহলে ইসরায়েল মধ্যস্ততার জন্য এগিয়ে আসবে। কিন্তু রাশিয়ার সহায়তায় বাসার বাহিনী যখন সত্যি দক্ষিণ সিরিয়ায় হামলা চালায়, তখন তাদের হতাশ করে দিয়ে ইসরায়েল নীরবতা বজায় রেখেছে। ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ এককালে ইসরায়েলের সহায়তা পাওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো।  ফোরসান আল জোলান নামের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যোদ্ধা মন্তব্য করেছেন, ‘ইসরায়েলের বিষয়ে এই শিক্ষা আমরা কোনও দিন ভুলব না। ইসরায়েলের মানুষের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই। মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা নেই।  ইসরায়েল শুধু নিজের স্বার্থ দেখে।’
ফরেন পলিসি লিখেছে, ইসরায়েল এতদিন এই সমঝোতা গোপন রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া ও দক্ষিণ সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের রক্ষায় পদক্ষেপ না নেওয়ার প্রেক্ষিতে বিদ্রোহীরা এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে। আগে কয়েকটি প্রকাশনায় ইসরায়েলের এমন সম্পৃক্তরা বিষয়ে অল্প বিস্তর তথ্য উঠে আসলেও, এবারই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা গেল। ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী যোদ্ধারা ফরেন পলিসিকে ইসরায়েলি সম্পৃক্তরা বিষয়ে তথ্য দিতে রাজি হয়েছে। তবে তাদের শর্ত, নাম-পরিচয় গোপন রাখতে হবে।
ইসরায়েল সিরিয়া হাজারখানেক সদস্যকে সহায়তা দিয়েছে। সিরিয়া যুদ্ধে সৌদি আরব, কাতার, তুরস্কে এবং যুক্তরাষ্ট্র এর চেয়ে ঢের বেশি যোদ্ধাকে সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু ফরেন পলিসির মতে, সংখ্যায় কম হলেও বিদ্রোহীদের সমর্থন করার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সম্পৃক্ততা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইসরায়েলের এমন সম্পৃক্ততা যেখানে ছিল সেখানে যুদ্ধ পরবর্তী সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের প্রশ্নে ইসরায়েলের ভূমিকার গুরুত্ব নতুন করে হিসেব করার দরকার হয়ে পড়েছে। সিরিয়ায় আসাদ বাহিনীকে সহায়তা করা ইরানের দেশটি থেকে চলে যাওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। ফলে ইসরায়েল-ইরান দ্বন্দ্বের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে সিরিয়া। তাছাড়া, সিরিয়া যুদ্ধে ইসরায়েলের সম্পৃক্ততার প্রকৃত চিত্র পাওয়ার ক্ষেত্রেও এ ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন ধরে মূলত ইরানি স্থাপনায় ইসরায়েলি বিমান হামলার কথাই জানা গেছে। ইসরায়েল যে ইরানকে ঠেকাতে সিরিয়ায় মাঠ পর্যায়ের যোদ্ধাদের ব্যবহার করছে তা আগে স্পষ্টভাবে জানা ছিল না।
ইসরায়েল ২০১৩ সাল থেকে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মির’ সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র দেওয়া শুরু করে। প্রথমে তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রস্তুত করা এম-১৬ অ্যাসাল্ট রাইফেল দেওয়া হতো। পরে সহায়তার উৎস গোপন রাখতে ইসরায়েল অন্য পরিকল্পনা করে। তারা লেবাননের হেজবুল্লাহর জন্য পাঠানো ইরানের একটি অস্ত্রের চালান আটক করেছিল ২০০৯ সালে। সেই চালানে আটক ইরানি অস্ত্র সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সরবরাহ শুরু করেছিল ইসরায়েল।
প্রথম দিকে শতাধিক যোদ্ধাকে সহায়তা করলেও পরের দিকে ইসরায়েলের সিরিয়া নীতিতে আসে বিশাল পরিবর্তন। সিরিয়ায় সক্রিয় ইরান সমর্থিত যোদ্ধাদের ইসরায়েলি সীমান্ত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে দেশটি ক্রেমলিন ও হোয়াইট হাউজের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু সেই দুই জায়গা থেকে আশানুরূপ কোনও সাড়া না পেয়ে ইসরায়েল আরও বেশি আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করে। দেশটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর শখানেক সদস্যের  বদলে এরপর গোষ্ঠীগুলোর হাজারখানেক সদস্যেকে সহায়তা দেওয়া শুরু করে। এর ধারাবাহিকতাতেই সিরিয়ার মধ্যে ইরানি অস্ত্রের চালান ও ইরানি ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো শুরু করে দেশটি।
সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সিরিয়াতে সক্রিয় অন্যন্য শক্তিগুলোর মতো সাংগঠনিকভাবে হস্তক্ষেপ করেনি ইসরায়েল। তারা বরং বাহিনী প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। এসব বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্তত দুইটির নাম প্রকাশ্যে চলে এসেছে। একটি হলো কুনেইত্রার যুবাতা আল খাশাব শহরের ফোরসান আল জোলান এবং অপরটি হচ্ছে বেইত জিন শহরের লিওয়া ওমর বিন আল খাত্তাব। সংশ্লিষ্ট বাহিনী প্রধানরা মূলত ফোনে ইসরায়েলি সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। কখনও কখনও গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি দেখাও হয়েছে। কমান্ডাররা যখন গোষ্ঠী ত্যাগ করেছে বা স্থান পরিবর্তন করেছে তখন ইসরায়েলি সহায়তাও তাদের অনুসরণ করেছে। তবে আন্তঃকোন্দলের ক্ষেত্রে স্থগিত রাখা হয়েছিল ইসরায়েলি সহায়তা।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রিয় ছিল ফোরসান আল জোলান। ইসরায়েল তাদের কাছে অস্ত্র পাঠাত অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর কাছে সরবরাহ করার জন্য। ইসরায়েলের অর্থ সহায়তাও বেশি পেয়েছে গোষ্ঠীটি। তার যখন ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল তখন বিমান হামলা করে সহায়তা দিয়েছে ইসরায়েল। কিন্তু ইসরায়েল সমর্থিত অন্যান্য বাহিনীগুলো যখন আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তখন তারা ইসরায়েলের কাছ থেকে এমন বিমান হামলার সহায়তা পায়নি।
এক পর্যায়ে ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে মানবিক সহায়তা দেওয়াও শুরু করে। সিরিয়ার অনেক অসুস্থ নাগরিককে চিকিৎসা দেওয়া ইসরায়েলি হাসপাতালে। প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ভাবের যে কার্যক্রম ইসরায়েল শুরু করেছিল তা আরবিতে প্রচারও করেছিল ইসরায়েল।  স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ সিরিয়ার সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা ইসরায়েলকে বন্ধু হিসেবে দেখ শুরু করে। কিন্তু হিসেব পাল্টে যায় যখন রাশিয়ার সমর্থনে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী দক্ষিণ সিরিয়ায় বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালায়। ইসরায়েল তার সমর্থনে কাজ করা গোষ্ঠীগুলোকে রক্ষার জন্য এগিয়ে যায়নি। এ প্রসঙ্গেই ফোরসান আল জোলানের একজন যোদ্ধা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ইসরায়েল কেন সরে গেল? এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার রাশিয়ার সঙ্গে হওয়া তার সমঝোতার প্রসঙ্গটি। সিরিয়া যুদ্ধে আসাদ বাহিনীর প্রতি অব্যাহত রুশ সহায়তার প্রেক্ষিতে ইসরায়েল গত জুলাই মাসে রাশিয়ার সঙ্গে এক সমঝোতায় উপনীত হয়। ওই সমঝোতার কারণে ইসরায়েলের কাছে বিদ্রোহীদের সহায়তা করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। রাশিয়া ও ইসরায়েল একমত হয় যে আসাদ বাহিনী দক্ষিণ সিরিয়ার এলাকাগুলো পুনর্দখল করবে, যাতে ইসরায়েল বাধা দেবে না এবং বদলে রাশিয়া ইরান সমর্থিত বাহিনীগুলোকে ইসরায়েলের সীমান্ত থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে থাকতে বাধ্য করবে।
দক্ষিণ সিরিয়ায় আসাদ বাহিনীর হামলা শুরু হলে স্থানীয়রা আশা করেছিল, ইসরায়েল তাদের প্রতিরোধে সহায়তা করবে। কিন্তু ইসরায়েল তা করেনি। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করা বাহিনীগুলোর কমান্ডারদের অনেকে ইসরায়েলের কাছ রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। ইসরায়েল মাত্র কয়েকজন কমান্ডার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আশ্রয় দেয়। কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়া হয় বাকিদের। এদের কেউ কেউ পরবর্তীতে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্টতার জন্য সিরীয় বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। বাকিরা নির্যাতন থেকে বাঁচতে আসাদ সমর্থিত বাহিনীতে যোগ দেন।
নিজেকে আবু খালেদ নামের পরিচয় দিতে সম্মত হওয়া পশ্চিম দারার একজন নেতা বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সহায়তাপূর্ণ সম্পর্ক রাখার ভুল এখন তারা বুঝতে পারছেন। তার ভাষ্য, ‘বিশ্বাস করুন, দক্ষিণ সিরিয়ার বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করার জন্য ইসরায়েল একদিন অনুতাপ করতে বাধ্য হবে। পার্শ্ববর্তী শহরেগুলোর বাসিন্দারাসহ আমরা সবাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসাদ বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু এই সমঝোতার কারণেই নিকট ভবিষ্যতে ইসরায়েলকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।’
ইসরায়েলের সহায়তা পাওয়া বিদ্রোহীদের একাংশ
ইসরায়েলের সহায়তা পাওয়া বিদ্রোহীদের একাংশ

No comments

Powered by Blogger.