ইভিএম প্রকল্পে বিলাসী কেনাকাটা by সিরাজুস সালেকিন

নির্বাচন কমিশনের ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পে কেনাকাটায় বিলাসিতার অভিযোগ উঠেছে। নতুন ইভিএম প্রস্তুতে কমিটি হলেও মূল্য নির্ধারণে কোনো কমিটি হয়নি। প্রকল্পে খরচের ক্ষেত্রে বাজার যাচাই করা হয়নি। কেনাকাটায় বাজার দরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মূল্যে আসবাবপত্র  ক্রয় করা হচ্ছে।
সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রায় ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার এ প্রকল্প প্রস্তাব করেছে ইসি। ইসির এমন কার্যক্রমকে বিলাসিতা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ইসি সূত্রে জানা গেছে, ‘নির্বাচনব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয়ের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গত মাসে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) প্রস্তাবের ওপর বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়। সেখানে যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ সামগ্রিক কেনাকাটার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়।
পরবর্তীতে ডিপিপি প্রস্তুত করে পিইসিতে জমা দেয় ইসি। নির্বাচন কমিশনের জমা দেয়া ডিপিপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে,  প্রকল্পের আওতায় ইভিএম ছাড়াও আনুষঙ্গিক আসবাবপত্র কেনা হচ্ছে উচ্চমূল্যে। নতুন ইভিএমের প্রতি ইউনিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। যা পূর্বের ইভিএমের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। আসবাবপত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রেও বাজার দর অনুসরণ করা হয়নি। আসবাবপত্রের যে মূল্য তালিকা দেয়া হয়েছে তাও কয়েক গুণ বেশি।
প্রকল্পে একটি নরমাল চেয়ার ১০ হাজার টাকা, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ৪০ হাজার, এক্সিকিউটিভ টেবিল ৮০ হাজার, সাইড টেবিল ১৫ হাজার, ড্রেসিং টেবিল ১৫ হাজার টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এরকম প্রায় ২০ ধরনের আসবাবপত্র ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে উচ্চমূল্যে। রাজধানীর পান্থপথে বেশ কিছু ফার্নিচারের শো-রুমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক্সিকিউটিভ চেয়ারের বিভিন্ন ধরন আছে। শো-রুম গুলোতে সাধারণ চেয়ারের মূল্য এক থেকে তিন হাজারের মধ্যে। আর এক্সিকিউটিভ চেয়ারের মূল্য দশ থেকে বিশ হাজারের মধ্যে। দেশের নামকরা ফার্নিচারের শো-রুম হাতিলে ঘুরে ১৮ হাজার টাকার ওপর কোনো এক্সিকিউটিভ চেয়ার পাওয়া যায়নি। এক্সিকিউটিভ টেবিলের মূল্য সর্বোচ্চ পাওয়া গেছে ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৫ হাজার টাকার ওপরে কোনো সাইড টেবিল ফার্নিচারের শো-রুমে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব কার্যক্রম মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে। এটাকে অর্থের অপচয় এবং একই সঙ্গে বিলাসিতা বলা যেতে পারে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পিইসির মূল্যায়ন কমিটির মতামতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালানো হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। এর জবাবে ডিপিপিতে বলা হয়েছে, এ প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নের পূর্বে কোনো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বা প্রাক-বিনিয়োগ সমীক্ষা করা হয়নি।
তবে অত্যাধুনিক ও নির্ভরযোগ্য ইভিএম প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দক্ষ ও আইটি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। এ কারিগরি কমিটির পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) নতুন কনফিগারেশনের উন্নতমানের ইভিএম প্রস্তুত করে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, এবার প্রতি ইউনিট ইভিএমের দাম পড়ছে প্রায় দুই লাখ টাকা। যা আগের তুলনায় প্রায় ৪ গুণ বেশি। এর আগে ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রথমবার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে। প্রথম পর্যায়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ১১ হাজার ৫৫৬ টাকা দরে ১৩০ ইউনিট ইভিএম সংগ্রহ করে ওই কমিশন। দ্বিতীয় ধাপে একই প্রতিষ্ঠান থেকে ৩২ হাজার ৫৪৭ টাকা দরে ৪০০টি ও তৃতীয় পর্যায়ে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) থেকে ৪৬ হাজার ৫০১ টাকা দরে ৭০০টি সব মিলিয়ে ১ হাজার ২৩০ ইউনিট কিনেছিল ড. হুদা কমিশন।
জানা গেছে, ইসির এ প্রকল্পে ৬টি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। এতে দেড় লাখ ইভিএম মেশিন ক্রয়, ভোটারদের মধ্যে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এসব মেশিন বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে বলেও প্রকল্পের ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকল্পটি ৫ বছর মেয়াদে (জুলাই ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের জুন) বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য- দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ফল প্রকাশ ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় আস্থা ফেরানো।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতি ইউনিট ইভিএমের দর প্রথমে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। সর্বশেষ কমিশন যে ১৯০ সেট ইভিএম সংগ্রহ করেছে তার দর পড়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৭৫ টাকা। যদিও প্রকল্পে প্রস্তাবিত ইভিএমের দর ড. হুদা কমিশনের কেনা ইভিএমের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
উল্লেখ্য, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও ইভিএম ব্যবহারে তাড়াহুড়া না করার পরামর্শ দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের অধীনে দেড় লাখ ইভিএম কেনার পরিকল্পনা করছে ইসি।
এজন্য জাতীয় নির্বাচনের চার মাসেরও কম সময় সামনে রেখে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়। ইভিএম যুক্ত করে আরপিও সংশোধনে উঠেপড়ে লাগে ইসি। ৩০শে  আগস্ট কমিশন সভায় আরপিও সংশোধনের বিরোধিতা করে নোট অব ডিসেন্ট দেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। কমিশন সভাও বর্জন করেন তিনি। পরবর্তীতে বাকি কমিশনারদের সম্মতির ভিত্তিতে আরপিও’র খসড়া ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.