রক্ত ও রাজনীতি by সৈয়দ আবুল মকসুদ

রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির এক গণবক্তৃতায় বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘রক্তমাখা হাত উদারতার সংস্কৃতির গলা টিপে ধরেছে। চতুর্দিকে রক্ত। বিএনপির দুহাতে, হেফাজতে ইসলামের দুহাতে, জামায়াতের দুহাতে রক্ত এবং আওয়ামী লীগের দুহাতে রক্ত। এই রক্ত ও রক্তপাত থেকে আমাদের রাজনীতিকে উদ্ধার করতে হবে।’ [প্রথম আলো, ২৩ মে ২০১৪]
রাজনীতির সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক চিরকালের। শুধু আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির শাসনামলে নয়, আওরঙ্গজেবের দুটি হাতেই রক্ত ছিল। তাঁর তিন ভাই ছিলেন—দারা শিকোহ, সুজা ও মুরাদ। আওরঙ্গজেবের হাত যদি তিনটি থাকত, তা হলে তিন হাতেই থাকত রক্ত। তাঁর টুপি সেলাই ও কোরআন নকল করে বিক্রির গল্প আমরা স্কুলে পড়েছি। তঁার সততা চ্যালেঞ্জ করার সাহস নেই। কিন্তু ভাইদের ও অন্যদের রক্ত যে তাঁর হাতে লেগে ছিল অামৃত্যু, তাতে সন্দেহ পোষণ করি না।
সিরাজউদ্দৌলা ও তাঁর সেনাদের রক্ত ছাড়া ক্লাইভ ও তাঁর লোকেরা ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারতেন না। ইংরেজরা খুব অল্পস্বল্প রক্তখোর ছিল না। যারাই স্বদেশের স্বাধীনতা চাইত তাদেরই রক্ত খেতে চাইত। ১৮৫৭-তে তারা দিল্লির লালকেল্লা থেকে ঢাকা সদরঘাটের বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। িততুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেনদের রক্ত দিতে হয়। তাঁরা চেয়েছিলেন তাঁদের দেশের মাটি থেকে বিদেশিদের তাড়াতে। তার নাম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা একটি রাজনৈতিক বিষয়। চরমপন্থী নেতারা বলতেন, তোমরা যখন এ দেশের মানুষের রক্ত নিচ্ছ, রক্ত দিয়ে হলেও আমরা স্বাধীনতা আনব। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বললেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’
গান্ধীজি ছিলেন অন্য রকম নেতা। রক্ত পছন্দ করতেন না। প্রাণী হত্যা হবে বলে ডিম পর্যন্ত খেতেন না। প্রাণিজ প্রোটিনের মধ্যে ছাগলের দুধ। স্বাধীনতা তিনিও খুবই চান, কিন্তু রক্তপাত ছাড়া। অহিংস পথে। কিন্তু তিনি চাইলেই যে রাজনীতি অহিংস থাকবে তার নিশ্চয়তা কী? তাঁর দলেরই অন্য নেতারা চান না। তাঁদের লোকেরা জ্বালিয়ে দিলেন চৌরিচৌরা থানা। থানার সব পুলিশ শুধু নয়, একটি শিশুও মারা যায়। শোকে স্তব্ধ হয়ে যান গান্ধীজি। আন্দোলনই বন্ধ করে দিলেন।
তঁার নেতৃত্বে ভারত স্বাধীন হলো। হিন্দুধর্মকে তিনি ভালোবাসতেন তাঁর প্রাণের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতার সাড়ে পাঁচ মাস পরে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতেই তাঁর প্রাণ গেল। বিড়লা হাউসের মেঝে ভেসে গেল তাঁর পবিত্র রক্তে। অখ্যাত নাথুরাম গডসের ঠাঁই হলো ইতিহাসে। পৃথিবীর ঘৃণ্য ঘাতকের তালিকায় উঠল তাঁর নাম।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রক্তের ওপর দিয়ে। কলকাতা, নোয়াখালী, বিহারে রক্তের স্রোত বইল। পাঞ্জাবে যে রক্তবন্যা প্রবাহিত হয়, তার তুলনা সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে বিরল। জিন্নাহকে যক্ষ্মা বাঁচিয়ে দিয়েছিল। ক্ষয়রোগে মারা না গেলে তাঁর ভাগ্যও গান্ধীর মতো হতো। তিনি প্রাণ দিতেন মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে। কারণ, তিনি চাইছিলেন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও পাকিস্তান হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাঁর ভাষায় ‘রিলিজিয়ন শুড নট বি অ্যালাউড টু কাম ইনটু পলিটিকস’—ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনা উচিত নয়। যে রক্তের রাজনীতির ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের জন্ম—রক্ত তাকে ছাড়বে কেন? রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রক্তপিপাসুদের হাত থেকে বাঁচতে পারলেন না।
২৪ বছর রক্তের রাজনীতি অব্যাহত থাকল। বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে হবে। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ কিন্তু যা অনুমান করা গিয়েছিল, রক্ত দেওয়ার পরিমাণটা তার চেয়ে হাজার গুণ বা ১০ হাজার গুণ বেশি হলো। স্বাধীনতা এল, রক্তপাত থামল না। রক্তপাতের রাজনীতিই বহাল রইল। সাধারণ মানুষেরও মুক্তি এল না।
রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-রাষ্ট্রপতি ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্তের রাজনীতির শিকার হলেন। অভাবনীয় মর্মান্তিক ঘটনা। সাধারণ মানুষের তাতে কোনো ভূমিকা ছিল না। রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত কর্মচারী ও তাঁরই দলের—অন্য কোনো দলের নয়—একশ্রেণির রক্তপ্রিয় নেতাই ঘটনা ঘটান। তবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার অপঘাতে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই যে রক্তের রাজনীতি থেমে যায় তা নয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় যাঁরা প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন, কারাগারের কড়া নিরাপত্তার ভেতরেও তাঁদের চারজনের জীবন যায় ঘাতকের হাতে।
রক্তের রাজনীতি বন্ধ হলো না। চট্টগ্রাম পুরোনো সার্কিট হাউসের বারান্দা ভেসে গেল রক্তে। রাষ্ট্রপতির এককালের সহকর্মী-বন্ধুরাই ঘাতকের দায়িত্ব পালন করেন। জনগণের যে ওই রক্তপাতে কোনো ভূমিকা ছিল না, তা তারা জানিয়ে দিল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জানাজায় অংশ নিয়ে।
বাংলার মাটিতে রক্ত ও রাজনীতি সমার্থক। উগ্র বামপন্থীরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করবেন, তাঁদের প্রয়োজন রক্তের। শ্রেণিশত্রু খতম শুরু হলো। ইসলািম মৌলবাদীরা আল্লাহর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। ছুরি নিয়ে নেমে পড়লেন রাস্তায় ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। প্রগতিবাদীদের কল্লা ও হাত-পায়ের রগ কাটা শুরু হলো। রাজনীতি যখন করেন তখন পাতিবুর্জোয়ারা বসে থাকতে পারেন না সুফিদের মতো। প্রতিপক্ষদের সরিয়ে না দিলে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা যায় না। এ দেশে কারও হাতে মুজিবের রক্ত, কারও হাতে সিরাজ সিকদারের রক্ত, কারও জামায় জিয়ার রক্ত, কারও জামাকাপড়ে তাহেরের রক্ত, কারও হাতে ডাক্তার মিলনের রক্ত। গণতান্ত্রিক শাসনামলের কারও হাতই রক্তমুক্ত নয়।
রক্তের রাজনীতি ছাত্ররাজনীতিতে সংক্রমিত না হয়ে পারে না। মুহসীন হলের চত্বর ভেসে গেল সাত ছাত্রনেতার রক্তে। সেই যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের লাশ পড়া শুরু হলো, আজও তা থামেনি। মাত্র কয়েক দিন আগেই ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রক্তে লাল হলো। সে রক্ত রাজনীতিবহির্ভূত রক্ত নয়। ক্ষমতার জন্য রক্তপাত।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেই রক্তের চড়া দাম। নেপালে মাওবাদী ও অ-মাওবাদীরা লড়াই করে রক্তবন্যা বইয়ে দিলেন। হাজার হাজার জীবন গেল, সমাজতন্ত্র এল না। রাজপ্রাসাদে নাশতার টেবিলে গোটা রাজপরিবার শেষ হয়ে গেল মুহূর্তে। শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েক থেকে শুরু। কতজন নেতা প্রাণ হারালেন। স্বাধীন তামিল রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলনে দুই পক্ষেরই হাজার হাজার লোক নিহত হন। ভারতে দুজন জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী আততায়ীর হাতে জীবন দিলেন। তার জের ধরে প্রাণ গেল হাজার হাজার মানুষের। মিয়ানমারের রাজনীতিতে রক্তপাতের শুরু সু চির বাবার থেকে।
এই উপমহাদেশে রক্ত ছাড়া রাজনীতি অচল। ভারতের মতো সুপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও রক্তের চড়া দাম। মাওবাদীদের সঙ্গে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ লেগেই আছে। এক অবিস্মরণীয় নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর পাকিস্তানে ডনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদিকে বেছে নেওয়া হয়েছে কারণ তিনি এমন ব্যক্তি, যিনি রক্তপাতের মুখেও—শুধু মুসলমানদের নয়, যেকোনো রক্তপাতে—থমকে যান না।...উন্নয়নের এই মডেলের সঙ্গে রক্তপাতের সহজাত সম্পর্ক রয়েছে।’ [ডন নিউজ]
রাজনীতিতে শীর্ষ পর্যায়ের রক্তপাত এক জিনিস, সেটা আওরঙ্গজেবের সময়ও ছিল, কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিতে রক্তপাত হাল আমলের ব্যাপার। তবে স্থানীয় নেতারা সাহস পান উচ্চপর্যায়ের প্রশ্রয়ে। ঘাতক নেতারা জানেন তাঁদের কিছুই হবে না। খুব বেশি হলে কয়েকবার থানা ও কোর্টে হাজিরা দেওয়া লাগতে পারে। কাগজে কয়েক দিন লেখালেখি হবে, তারপর মানুষ দিব্যি ভুলে যাবে। সাংসদ শাওনের গাড়িতে তাঁরই পিস্তলের গুলিতে যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম নিহত হলেন। সে মামলার কী হলো কেউ জানে না। নরসিংদীর মেয়র লোকমান মারা গেলেন আততায়ীর গুলিতে। মুহূর্তে দেরি না করে ঢাকা থেকে বিএনপির এক নেতাকে পিঠমোড়া করে হ্যান্ডকাফ লাগানো হলো। পরে দেখা গেল, আসামিরা নিজেদেরই লোক। বেচারা বিশ্বজিৎকে দিনদুপুরে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। সবাই দেখল কারা মারছে, বলা হলো বিরোধী দলের কথা। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের পর কালবিলম্ব না করে ঘোষিত হলো স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক চক্রের কর্ম। সরকারি দলের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত বলতে বাধ্য হলেন, সব ব্যাপারে জামায়াত-বিএনপির ঘাড়ে দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। রক্তপাতের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক গভীরতর থাকলে প্রশাসনের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। তবে সে অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তারা স্বাধীন অন্যভাবে। নিজেদের স্বার্থে যা-খুশি-করার স্বাধীনতা তাঁরা পান।
শনিবার এক আলোচনা সভায় মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, ‘প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি সরকার। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, প্রশাসনের যুগ্ম সচিব কিংবা জমির সার্ভেয়ার হলো সরকার। আসলে এ দেশে কে সরকার, সেটাই বুঝতে পারি না।’ শুধু জমির সার্ভেয়ার বা তহশিল অফিসের কেরানি নন, সরকার হলো ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজ হলো তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও নিরাপত্তা দেওয়া। আর আসল সরকার হলো ক্যাডারদের ধর্মবাবারা, যাঁদেরকে অনেকে সম্বোধন করেন, ‘ভাই, আপনে আমার বাপ লাগেন।’ বাপ মানে ফাদার। গড-ফাদার যথার্থ শব্দ। একই সঙ্গে ভাই ও বাবার ভূমিকা পালন করা শুধু রাজনৈতিক গড-ফাদারদের পক্ষেই সম্ভব।
বিরোধী দলকে স্বাভাবিক সভা-সমাবেশ করতে না দিলে সরকারি দলের মধ্যেই স্বার্থান্বেষী বিরোধী উপদল তৈরি হয়। তারা বিরোধী দলের মতো নিয়মতান্ত্রিক সভা-সমাবেশ করে না—সন্ত্রাস করে। দিনদুপুরে রক্তপাত ঘটায়। নষ্ট রাজনীতিতে রক্তের প্রয়োজন—যুক্তি ও বিতর্ক নয়। উদার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি না থাকলে উগ্র রাজনীতির জন্ম নেয়। তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সরকারি দলের—বিরোধী দলের নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.