ডানে বামে আসন ভাগাভাগি

ইউরোপের ২৮ দেশের জনগণ আবারও আগামী পাঁচ বছরের জন্য তাদের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করলেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন ঘিরে কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউরোপের নানা দেশজুড়ে আলোচনা ও বিতর্ক ছিল, কোন দলীয় জোট এবার ইউরোপীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হবে বা ক্রমাগত এগিয়ে আসা ইউরোপের সম্মিলিত ধারণাবিরোধী, বর্ণবাদী বা ইউরো স্কেপটিস দলগুলোই বা কতটা সাফল্য পাবে? ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোয় এই দলগুলোর সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তি ইউরোপের রাজনীতিতে তাদের ক্রমাগত উত্থান হিসেবে দেখা দিলেও, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সর্বোচ্চসংখ্যক ২১১টি আসন পেয়েছে ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ধারার জোট এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৩টি আসন পেয়েছে সামাজিক গণতান্ত্রিকদের জোট।২০০৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল ইউরোপীয় ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক জোট আর দ্বিতীয় হয়েছিল সামাজিক গণতান্ত্রিক জোট; পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে সেই ফলাফলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। ২২ থেকে ২৫ মে টানা চার দিনে নিজ নিজ দেশগুলোর জনসংখ্যার ভিত্তিতে বণ্টিত দেশগুলোর নির্ধারিত আসনে, সর্বমোট ৭৫১ আসনবিশিষ্ট ইউরোপীয় পার্লামেন্টভুক্ত নানা দলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচিত করলেন ২৮টি দেশের চার কোটি মানুষ। ইউরোপ মহাদেশের ৪৭টি দেশের সবাই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অন্তর্ভুক্ত না হলেও নানা ভিন্ন জাতিসত্তার একই ছাদের িনচে পার্লামেন্টে বসা একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
১৯৫৭ সাল থেকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কার্যক্রম শুরু হলেও সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন শুরু হয় ১৯৭৯ সাল থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ইউরোপীয় রাজনীতিকদের মধ্যে সংশয় ও অবিশ্বাস কাটিয়ে অভিন্ন ইউরোপ গড়ার যে প্রবণতা, তারই ফসল আজকের এই ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা এই ঐক্যবদ্ধতাকে আরও এগিয়ে নিতে চাইছিলেন, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রতিক কালের ইউক্রেন সমস্যা। অবশ্য এর আগেও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সাবেক যুগোস্লাভিয়া ও ইরাকের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে নানা মতপার্থক্য দেখা দিলেও তা সংকটে পরিণত হয়নি, প্রতিকূলতা থাকলেও তা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলার প্রবণতা রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সাত দশক ধরে ইউরোপীয় রাজনীতি মূলত চারটি ধারায় পরিচালিত হচ্ছে। ধারাগুলো ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ধারা, সামাজিক গণতান্ত্রিক ধারা, লিবারেল গণতান্ত্রিক ধারা এবং বাম রাজনৈতিক ধারা৷ এই মূল রাজনৈতিক ধারার বাইরে পরিবেশবাদী সবুজ দলও বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। নব্বই দশকে দুই পরাশক্তির ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান তথা সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভাঙনের পর থেকে বাম রাজনীতির ধারা বেশ পিছিয়ে গেলে বা হোঁচট খেলেও একদম শেষ হয়ে যায়নি। আর এই চারটি ধারার জোটই ইউরোপীয় রাজনীতিতে এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রভাব বিস্তার করছে। তবে এবারের নির্বাচনে সম্মিলিত ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিবিরোধী বর্ণবাদী কট্টর দক্ষিণপন্থী দলগুলোর ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলোয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং ভোটপ্রাপ্তি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ধারার বিলোপ আর অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিস্তারের পর থেকে ইউরোপীয় রাজনৈতিক ধারায় মূলত দক্ষিণপন্থী ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দল ও সামাজিক গণতান্ত্রিক দল দুটিই ঘুরেফিরে বিভিন্ন দেশের ক্ষমতায় আসীন হচ্ছে। কোনো কোনো সময় এই দল দুটির সঙ্গে অন্যান্য ধারার ছোট দলগুলোও শরিক হচ্ছে।
তবে ইউরোপের নানা দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইউরোপ ঐক্যবিরোধী, কট্টর জাতীয়তাবাদী বা নব্য নাৎসি দলগুলো স্থান বিশেষে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং এবারের নির্বাচনে ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড এই দলগুলোর সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তি ইউরোপের রাজনীতিতে তাদের ক্রমাগত উত্থান হিসেবে দেখা হচ্ছে। এদের পুঁজি কৌশলী সস্তা স্লোগান, অভিবাসীবিদ্বেষী আস্ফালন তথা ইসলামবিদ্বেষ আর ইদানীং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয় ঐক্যের বিরোধিতা। এই কৌশল অবলম্বন করে এরা ফ্রান্স, হল্যান্ড, জার্মািন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, গ্রিস, ইতালি প্রভৃতি দেশগুলোয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং স্থানীয় শহর জেলা বা প্রাদেশিক পার্লামেন্ট নির্বাচনগুলোয় মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদারি করতে চাইছে বা করছে। তবে জাতীয় নির্বাচন বা রাজনীতিতে এরা এখনো তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সমস্যাকে পুঁজি করে এই দলগুলো দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও আশার কথা, সব জায়গায় রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে এরা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। অবশ্য ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলোর, পার্লামেন্টে জোট বাঁধতে ২৮টি সদস্যদেশের ৭৫১ জন সদস্যবিশিষ্ট ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ দেশ, অর্থাৎ সাতটি দেশের ন্যূনতম ২৫ জন সংসদ সদস্যের প্রয়োজন। সেই ১৯৫৭ সালে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কয়লা আর ইস্পাত বিনিময়ের মাধ্যমে ছয়টি ইউরোপীয় দেশ যে অর্থনৈতিক সমঝোতা করেছিল, তা পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নামে, যা ২৮টি জাতির জাতিগত সমন্বয় আর সমঝোতার বিশ্বজনীন উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য, ইউরো মুদ্রা চালু, ভিসামুক্ত যাতায়াতব্যবস্থাসহ নানা রকম শিক্ষা, সাংস্কৃতিক গবেষণামূলক কার্যক্রম, স্বাস্থ্য ভোক্তানীতি, মানবাধিকার, বিশ্ব নিরাপত্তা ও শান্তি এবং দরিদ্র দেশগুলোর উন্নয়ন–সহযোগিতার কর্মসূচি ও পরিকল্পনা—সব বিষয়েই আলোচনা ও প্রস্তাবগুলো গৃহীত ও আইনে রূপান্তরিত হচ্ছে এই বহুজাতিক পার্লামেন্টের অধিবেশনগুলোতেই। ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কৃতি তথা মহাদেশীয় পার্লামেন্টারি প্রথা গড়ে তুলেছে, তা বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি৷

No comments

Powered by Blogger.