সুন্দরবন আর জনকূটনীতি

ছাই-কাদায় ধ্বংসপ্রায় এমোরি নদী
সুন্দরবন থেকে মাত্র নয় কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে হতে যাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সুন্দরবনকে হুমকিতে ফেলে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির এ পরিকল্পনা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বনাম প্রকৃতি বা পরিবেশ সংরক্ষণের পুরোনো বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে স্বাভাবিকভাবেই।
যাঁরা পক্ষদলে আছেন, তাঁরা দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ-ঘাটতি কমানোটাকে অনেক বেশি জরুরি বলে মনে করছেন। তাঁরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই মুহূর্তে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং কারিগরি দক্ষতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, ‘সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি’র সর্বোচ্চ প্রয়োগ সুন্দরবনকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে। বিরোধী পক্ষের দাবি, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প শুরুর প্রক্রিয়াগত ত্রুটি, অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্থান নির্বাচন, জমি অধিগ্রহণ, দুর্বল এবং পক্ষপাতমূলক পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ), নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পরিবেশগত ছাড়পত্র সংগ্রহ, প্রকল্পের দূরত্বভিত্তিক অবস্থানের বিতর্ক প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রকল্প নিশ্চিতভাবে সুন্দরবনের বিনাশ করবে। তবে দুই পক্ষের তর্ক-বিতর্ক ছাড়িয়ে এখন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে একটা নতুন প্রবণতা খুব লক্ষণীয়। তা হলো স্যাটেলাইট চিত্রের জনকূটনীতি। এর অংশ হিসেবে সংসদে প্রদর্শন করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন লোকালয়ে অবস্থিত গুগলের তোলা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচ-ছয়টি স্যাটেলাইট চিত্র। মহাশূন্য থেকে তোলা এসব স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে সরকারপক্ষ রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, লোকালয়ে অবস্থিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনেক দূরবর্তী স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে কি ভূমিতে ঘটে যাওয়া পরিবেশগত বিপর্যয়ের আসল চিত্র জনসাধারণের পক্ষে বোঝা সম্ভব? এখানে স্যাটেলাইট চিত্রের অন্তত একটি, তথা বিজ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্রকেই বেছে নেয়। যদিও অস্ট্রেলিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কুইন্সল্যান্ড ও নিউ সাউথ ওয়েলসের যেসব উন্মুক্ত খনি থেকে কয়লা সংগ্রহ করা হয়, সেগুলোর পরিবেশগত বিপর্যয় এবং তার রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে ২০১২ সালে প্রকাশিত শ্যারিন মানরো কর্তৃক রচিত ম্যাকমিলান পাবলিশারের রিচ ল্যান্ড, ওয়্যাস্ট ল্যান্ড: হাউ কোল ইজ কিলিং অস্ট্রেলিয়া গ্রন্থটিতে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পরিবেশগত ভূমিস্থ বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এই ‘ফটো-কূটনীতি’র আওতাভুক্ত হয়েছে, সেটির নাম হলো ‘কিংস্টন ফসিল পাওয়ার প্ল্যান্ট’। টিনেসি রাজ্যের রোন কাউন্টিতে ১৯৫৫ সালে ১ দশমিক ৭ গিগাওয়াট বা এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এটি মূলত এমোরি ও ক্লিঞ্চ নদীর মোহনায় অবস্থিত। এর অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য অনেকটাই মেলে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে। বাংলাদেশের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রও পশুর নদ ও শিবসা নদীর মোহনায় অবস্থিত।
এমনকি রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তাবিত অবকাঠামোগত নকশায় ছাই ব্যবস্থাপনার জন্য প্রস্তাবিত পুকুরের অবস্থানগত আদল অনেকটাই কিংস্টন বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুকুরের মতো। উভয় ক্ষেত্রে পুকুর দুটি নদীর মোহনাসংলগ্ন। ৮৪ একরের কিংস্টন বিদ্যুৎকেন্দ্রের এই পুকুরটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপজাত হিসেবে ছাইয়ের কাদা নিঃসরিত হতো। এই ছাই-কাদা পুকুর থেকে আস্তে আস্তে চুইয়ে এমোরি ও ক্লিঞ্চ নদীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই চুইয়ে পড়া ছাই-কাদা শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটায় ২০০৮ সালের ডিসেম্বর নাগাদ। চার মিলিয়ন ঘনমিটার পরিমাণ এই ছাই-কাদা প্রায় ১ দশমিক ২ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। এতে নদীর দুই তীরের লোকালয়েও পরিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসে। মৎস্যসম্পদ ধ্বংস হওয়াসহ প্রায় ১০ কিলোমিটারজুড়ে নদীর পানিও দূষিত হয়ে পড়ে। এর ক্ষতিকর প্রভাব স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানির ওপরও পড়েছিল। এই পানিতে লেড, থ্যালিয়াম, পারদ ও আর্সেনিকের মাত্রাও সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক ওপরে উঠে গিয়েছিল। ছাই-কাদায় ঢেকে যাওয়া এমোরি নদী। (উৎস: উইকিপিডিয়া) যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি জানিয়েছিল, নদীগুলো দূষণমুক্ত করতে চার-ছয় সপ্তাহ লাগবে। কিন্তু ছয় মাস পরে দেখা গেল, নিঃসরিত ছাই-কাদার মাত্র ৩ শতাংশ সরানো সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কিংস্টন বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা টিনেসি ভ্যালি অথরিটি ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি প্রচারপত্রের মাধ্যমে দাবি করে যে নদীতে নিঃসরিত এই ছাই-কাদা ‘দূষণ-সম্ভাবী নয়’। এই কিংস্টন ফসিল পাওয়ার প্ল্যান্ট দূষণের তিক্ত অভিজ্ঞতা ২০০৯ সালে মার্কিন সিনেটে আলোচিত হয় এবং দেশজুড়ে অবস্থিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই ব্যবস্থাপনার পুনর্মূল্যায়নের দাবিও কংগ্রেসে উঠে আসে। পরবর্তী সময়ে মার্কিন কংগ্রেসের প্রাকৃতিক সম্পদসংক্রান্ত পর্ষদ ছাই ব্যবস্থাপনার পর্যবেক্ষণসংক্রান্ত একটি বিলও পাস করতে বাধ্য হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারপক্ষ থেকে দূরবর্তী স্যাটেলাইট চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে যে জনকূটনীতির সূচনা ঘটানো হলো, অন্তত তা কিংস্টন ফসিল পাওয়ার প্ল্যান্টের অভিজ্ঞতায় কোনো সততার প্রমাণ দেয় না; বরং এটা নিশ্চিত করে, যে তারা মননে জনবিচ্ছিন্ন এবং তাদের কাছে জনস্বার্থের চেয়ে অন্য কিছু এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই সরকারপক্ষের জনকূটনীতি জনকূটচালে আটকা পড়ে গেছে। এ সবকিছুই সুন্দরবনকে ঘিরে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে যাঁরা বলছেন, তাঁদের নৈতিক পরাজয়ের প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই জনবিক্ষোভের আশঙ্কায় বাগেরহাটের রামপালে অবস্থিত তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে হয় কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়!
মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.