এ দুঃসহ যাত্রার শেষ কোথায়?

সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে একখানা চিঠি ছাপা হয়েছিল। চিঠি না বলে নিবন্ধ বলাই শ্রেয়। তরতাজা অসি যুবক এসেছিল বাংলাদেশ ভ্রমণে। তরতাজা উল্লেখ করার কারণ, ঐ তাজা ভাবটা শুকিয়ে মিইয়ে, ভয়ে চুপসে বেলুনের মতো হয়ে উঠেছিল ঢাকায়।
অভিযোগ তার মূলত যানবাহন নিয়ে। এক একটি যাত্রায় মৃতু্যপথযাত্রীর অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়ানো তার মতো যুবকের জন্য দুঃসাধ্যই বটে। ঢাকা-চট্টগ্রাম পারাপারে প্রতিমহূর্তে জীবনের ঝুঁকি আর কষ্টের সে বর্ণনা এতটাই চাৰুস যে কেউই তা নিজের মনে করে নিতে পারে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ ভ্রমণে ইচ্ছুক পর্যটকদের জন্য এ নিবন্ধ সহায়ক নয়। বরং ভয় জাগানো এক সাবধানী নোটিস। আমরা বাংলাদেশী, জন্মেছি বঙ্গে, জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়ে এক বয়সে অভিবাসন নিয়ে বিদেশ পাড়ি, অথচ এক যুগ, অর্ধ যুগ, পনেরো, কুড়ি বছরের বসবাসেই জীবন হয়ে উঠেছে অন্যধরনের। নিরাপত্তা ও নিয়ম না থাকলে জীবনের মানে বিপদ। সে বিপদ রাজধানী ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। যে অসি যুবকটা বঙ্গ দেশে জন্মায়নি, যার মাথা, বুদ্ধি, মগজে যানজট বলে কিছু নেই। যে কোন দিন ওভারটেক দেখেনি, তার জন্যে এ-তো এক ধরনের নরকবাস মনে হতেই পারে। পৃথিবীর খুব কম দেশে এ রকম ভয়ানক ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ যাত্রায় মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও কলকাতা ভ্রমণে দেখেছি নিয়ম মানার, শৃঙ্খলা রৰার প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়ছে। দেশ ভেদে একেক ধরনের বটে, তবু সব কটা দেশ ও রাজধানীতে ট্রাফিক ব্যবস্থা এক জাতীয় নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই আবদ্ধ। বাংলাদেশ অদ্ভুতভাবে তার ব্যতিক্রম। অথচ শানশওকত আর টিকেটের দামে কম্বোডিয়া, ব্যাংকক বা কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রামের কাছে মুখ লুকিয়ে বাঁচতে চাইবে। ঢাকা থেকে অন্যান্য শহরে ছুটে চলা বিশাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস, পা ছড়িয়ে আয়েশে বসার ব্যবস্থা, সুশিৰিত বাস হেলপারের শুদ্ধ উচ্চারণে ঘোষণা, তাক লাগানো, ইংরেজী ভাষ্য সব মিলিয়ে ফার্স্টকাস ব্যাপারস্যাপার। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই অমোঘ কবিতার পঙক্তির মতো "জীবনে কিছুই কিছু নয়/যদি কৃতকার্য হতে না পারলে।" ধ্রম্নব সত্য। অত সাজগোছ ঘোষণাপত্র কিছুই কিছু নয় বাস খাদে পড়ে গেলে অথবা ঠিকমতো গনত্মব্যে পেঁৗছে দিতে না পারলে। যাচ্ছিলাম ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, অঘোষিত ধূলিঝড়, রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলি কবিতার আবহে হঠাৎ কালো হয়ে আকাশের কামনায় ভারি হয়ে উঠেছিল জনপদ। এতটাই অাঁধার যে যাত্রাও হলো বিলম্বিত। ততৰণে পিচ্ছিল রাজপথ, সাবধানতা তখন জীয়নকাঠি। কিন্তু কে শোনে কার কথা, যতটা বিলম্ব ততটাই অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন চালক। এই পড়ে তো সেই পড়ে অবস্থা। পেছনের আসনে উপবিষ্ট ইংরেজী বলতে অভ্যসত্ম প্রবাসী বাংলাদেশী যুবকটি আর স্থির থাকতে পারেনি। খাঁটি আইরিশ ধাতে দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা আর বাসচালকের প্রতি বিনীত অনুরোধে মন গলানো গেল না। ভয়ার্ত যুবকটিকে দেখেই বোঝা গেল, দ্বিতীয়বার এ পথে ভ্রমণে আগ্রহী হবে না। আমি ভাবছিলাম অদ্ভুত যোগাযোগের ব্যাপারটি। কয়েক মাস পূর্বে ঘুরে যাওয়া অসি যুবক আর প্রবাসী বাংলাদেশী তরম্নণ, উভয়ের এক অভিজ্ঞতা, একই দুশ্চিনত্মা ও নিরাপত্তাহীনতার অভিজ্ঞতা। এরা কিভাবে এ দেশে আসবে? কিভাবে এ দেশটিকে দেখবে অনুভব করবে ও ভালবাসবে?
ঝববরহম রং নবষবরারহম বলে কথা, দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলে পর্যটন পর্যটন বলে গলা ফাটালেও লাভ হবে না। পর্যটন তো দূর অসত্ম। ভেবে দেখুন, আমাদের যানগুলো কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। থাই রাজকন্যার গাড়ি বহর তো আমজনতার বাস, ট্রেন ছিল না, সেখানেও ঢুকে পড়েছিল, শুধু কি তাই? প্রাণ হারানোর মতো ঘটনাও ঘটে গেছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সে খবরে আর যাই হোক দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়নি পর্যটনের ভবিষ্যত। এ জাতীয় বিষয়গুলোর প্রতি যতটা মনোযোগ ও নজরদারি থাকা প্রয়োজন ততটা চোখে পড়েনি। দিন বদলের সরকারের সামনে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো সেভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না। অথবা তুলে ধরলেও মনোযোগ পাচ্ছে না। অথচ এ বিষয়ে মনোযোগ কতটা প্রয়োজন সেটা তো রাজবহরের দুর্ঘটনাতেই বোঝা সম্ভব। সুকুমার বড়ুয়ার সেই ছড়াটা মনে পড়ছে : জমিদার বাহাদুর চড়েছেন পালকি/লোকে দেয় পেন্নাম আর সেলামালকি /চারজন বেহারা/কিম্ভূত চেহারা/মরমর/ঝুপপুড়/ভেবে দেখো হাল কি!
জমিদার বাহাদুর, সরকার বাহাদুররাও যে নিরাপদ নন, সেটা বুঝতে পারলেই মঙ্গল। সাধারণ মানুষ তো প্রত্যাশা করেই বাঁচে।
ফধংমঁঢ়ঃধধলড়ু@যড়ঃসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.