ভিন্নমত-শেয়ারবাজারে ভল্লুকের প্রবেশ ঘটবে! by আবু আহমেদ

আমার ছাত্র কামাল এখন একটা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমাকে পেয়ে এক রকম জোর করেই তার অফিসে নিয়ে গেল। নিয়ে এক কাপ চা পান করতে দিয়ে শেয়ারবাজার সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগল।
সে বলল, স্যার, আপনাকে জিজ্ঞেস করার মূল উদ্দেশ্য হলো, সারা জীবনের সঞ্চয় আমার এখন শেয়ারবাজারে। লাভ কতটা হয়েছে তার চেয়ে ভয়ে থাকি পুঁজিটা কতটা খোয়ালাম এ নিয়ে। আমি কামালকে বললাম, তুমি অর্থনীতির লোক, এখন আবার বাণিজ্যের লোক। তোমার তো অবশ্যই ধারণা আছে শেয়ারবাজার মূলধনী প্রাপ্তির বাজার যেমন, তেমনি মূলধন ক্ষয়েরও বাজার। তবে এই বাজারে তোমাদের মতো লোকদেরই ভালো করার কথা।
কারণ, তোমার তাত্তি্বক জ্ঞান আছে; আবার বাজার পড়তি অবস্থা শেষে সুবিধা নেওয়ার জন্য নতুন অর্থের জোগানও আছে। তাই তোমার মতো লোকের ভয় পাওয়ার কথা নয়। কামাল বলল, ভয় এখন আর পাই না। প্রথম প্রথম পেতাম। তাত্তি্বক জ্ঞান যতই থাক না কেন, প্রায়োগিক বা অ্যাপ্লাইড জ্ঞান কম ছিল। আপনার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ-জয়ের কৌশল বইটা পড়ে প্রায়োগিক দিকটার অনেক কিছু জানতে পারলাম। আপনার বই আমাকে আত্মবিশ্বাসও ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন আমি ভোগ করি কম, সঞ্চয় করি বেশি। আর সঞ্চয় অর্থ ব্যাংকে না রেখে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছি। কামাল জানতে চাইল, ডিসেম্বরের শেষদিকে পর পর তিন দিন বাজার পড়া দেখে সেই পড়া বিয়ার মার্কেটের (ইবধৎ গধৎশবঃ) ইঙ্গিত দেয় কি না।
আমি কামালকে থামিয়ে বললাম, তিন দিনের পড়া থেকে ভল্লুক বা বিয়ারের পদচারণ বোঝা যাবে না। অতি স্বাভাবিক বাজারে তিন দিন শেয়ারবাজার পড়তে পারে। ও বলল, ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ যে ৫৫০ পয়েন্ট পড়ে গেল, ওই পড়া বাজার ক্র্যাশের ইঙ্গিত দেয় কি না। আমি বললাম, তাও দেয় না। এক দিন বড় রকমের কারেকশন বা শুদ্ধ হতেই পারে, বিশেষ করে বাজার যখন একাধারে অনেক দিন বাড়তে থাকে। তবে আমাদের বাজারটা কোনো রকম বড় ঘটনার প্রতি জবাব দিতে গিয়ে পড়েনি, বলা চলে, নিজের ভারে নিজেই পড়েছে। কামালের ভয় হলো সামনের অবস্থা নিয়ে। সে আমার মত জানতে চাইল সামনে শেয়ারবাজার কেমন যাবে। আমি বললাম, যাবে ভালো-মন্দ মিশিয়ে। তবে ২০১০ সালের মতো আশা কোরো না। ২০১০ সাল ছিল শেয়ারবাজারে অর্থ কামাই করার স্বর্ণ বছর, তা চলে গেছে। তবে সত্য হলো, অধিকাংশ বিনিয়োগকারী অর্থ বাইরে নিতে পারেনি, তারা বেশি মূল্যে শেয়ার বেচেছে, আবার বেশি মূল্যে শেয়ার কিনেছে। ব্যাংক ও লিজিং কম্পানিগুলো শেয়ারবাজার থেকে অনেক ফায়দা লুটেছে। চাহিদার বিস্ফোরণ ঘটেছে। সে হিসেবে শেয়ারের সরবরাহ কম ছিল।
বাজার সামগ্রিকভাবে অতি মূল্যায়িত হয়েছে। ২০১১ সালে বাজার শুধু শুদ্ধ হবে। এর কারণ হলো, বাজারে নতুন শেয়ার আসতে থাকবে। অন্যদিকে বাজার সম্প্রসারণের বড় কাজটা ২০১০ সালে ঘটে গেছে। শুধু এই বছরই ১৫ লাখ নতুন বিনিয়োগকারী বাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তুমি কি মনে করো, ২০১১ সালে আরো ১৫ লাখ বিনিয়োগকারী যোগ হবে? আমি মনে করি না। বাজার ভালো দেখলে ৫-৭ লাখ যোগ দিতে পারে। আর বাজার খারাপ গেলে ৩৩ লাখের মধ্যে ২০ লাখই ইনঅ্যাকটিভ হয়ে বসে পড়বে। কামাল জানতে চাইল, বড় রকমের দরপতন যদি ইবধৎ গধৎশবঃ সিগন্যাল না দেয়, তাহলে কী কী চিহ্ন ওই ব্যাপারে ইঙ্গিত দেবে?
আমি কামালকে বললাম, ওই জন্য তোমাকে বাজার ওয়াচ বা পর্যবেক্ষণ করে যেতে হবে। প্রথম চিহ্ন হবে বাজারে টার্নওভার বা লেনদেন কমে যাবে। দ্বিতীয় চিহ্ন হবে, অধিকাংশ বিনিয়োগকারী কেনাবেচা না করে ডধরঃ ধহফ ংবব ঢ়ড়ষরপু গ্রহণ করবে। তৃতীয় চিহ্ন হবে ব্রোকার হাউসগুলোতে বিনিয়োগকারীদের নিত্যউপস্থিতি অনেকটা কমে যাবে। চতুর্থ চিহ্ন হবে, সংবাদ মাধ্যম শেয়ারবাজার নিয়ে বড় নিউজ করবে না। আর শেষ চিহ্ন হবে চারদিকে একটা হতাশার আবহ তৈরি হবে। আর বাজার তখন শুধু পড়বেই। সে পড়া কত দিন যাবৎ পড়ে, তা কেউ বলতে পারবে না।
বাজার বটম বা তলানিতে গিয়েও অনেক দিন অবস্থান করতে পারে। তারপর অতি ধীরে উঠতে থাকবে। তোমরা বিয়ার মার্কেটকে ভয় না করে তখন যদি বিনিয়োগ কর তাহলে উপকৃত হবে। বিয়ার মার্কেটে মার্জিন লোন বা শেয়ার কেনার ঋণ প্রদানও অনেকটা কমে যাবে। ব্যাংক ও লিজিং কম্পানিগুলো নিজেদের পোর্টফলিওতে কেনা-বেচা কমিয়ে দেবে।
কারণ, এসব কম্পানির কর্মকর্তারা বসদের কাজে জবাবদিহি করতে পারবেন না। এসব কম্পানি চায় ছয় মাস-এক বছরের মধ্যে লাভ। অথচ বিয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করলে লাভ ঘরে আসতে সময় লাগে। সেই জন্য বলছি ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা ইড়ঃঃড়স ড়ঁঃ মার্কেটে বিনিয়োগ করলে লাভ বেশি পাবে। কামাল আমার কথা শুনল এবং ভাবতে লাগল ২০১১ সালে কি বাজারে সত্যিকার অর্থে ভল্লুক বা বিয়ার প্রবেশ করবে?

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.