মানবতাবিরোধীদের বিচার যেন বিলম্বিত না হয় by আবদুল মান্নান

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে বিচার হচ্ছে, তা বানচাল করার চেষ্টা করছে জামায়াত ও তার সহযোগীরা। যখন বিচার শুরু হয়, বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেছিলেন, বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল দরকার নেই। প্রচলিত ফৌজদারি আইনের মাধ্যমেই বিচার হতে পারে।
সেখান থেকে বিরোধিতা শুরু। জামায়াত সব সময়ই চেষ্টা করেছে বাধা দিতে। বিচারের প্রতিবন্ধকতা তৈরির জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে সবখানেই তারা নানাভাবে তৎপরতা চালিয়েছে। অনেক দেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে, যারা মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকাসহ অনেক জায়গায় জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা এ ব্যাপারে প্রচার করেছে প্রচুর। যেমন অনলাইনে খবর প্রচার করা হয়েছে, ১৫০টি দেশের কিছু লোক একত্রিত হয়েছিল সুদানের খার্তুমে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। গোলাম আযমের জন্য খার্তুমে বৈঠক হয়েছে- এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তেমন অনেক প্রচার হচ্ছে। তুরস্কেও এমনটি হয়েছে বলে অনলাইনে খবর প্রচারিত হয়েছে। এ খবরে যে ছবি দেখানো হয়েছে, ওটা ছিল ওখানকার কোনো উৎসবের ছবি। ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট ইনকরপোরেশনের কর্ণধার কে? তিনি ইহুদি। এই প্রতিষ্ঠানটিকে লাখ লাখ ডলার প্রদান করেছে জামায়াত।
টবি এডমেনের একটি লবিস্ট ফার্মকে ছয় মাসে ১৯০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। তিনি পূর্ব লন্ডনের একটি মসজিদেও জামায়াতের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। তিনি মসজিদে গিয়ে বক্তৃতা করেছেন। যে জামায়াত ভিন্নধর্মীদের সহ্য করতে পারে না, তারাই মসজিদে ঢুকিয়েছে অমুসলিমকে।
বিচারপতি নিজামুল হকের টেলিফোনে কথোপকথন হ্যাক করা হয়েছে। এ ধরনের কাজ আন্তর্জাতিক আইনেও অপরাধ। এটা বাংলাদেশে আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশ করেছে। তারাও বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করেছে বলে মনে করি।
বিচারপতি মহোদয়ের কথোপকথন হ্যাকিং নিয়ে আমাদের কিছু লোক ভুল বিশ্লেষণ করছে। আমাদের একজন বুদ্ধিজীবী বলেছেন, এটা নাকি ২০১২ সালের সাংবাদিকতার বড় অর্জন। একজন বলেছেন, ওই পত্রিকার সম্পাদককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত। তাতে মনে হয়, সুধী সমাজও বিভক্ত। জামায়াত কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। দুর্ভাগ্যবশত বলতে হয়, কিছু মন্ত্রী অকারণে ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এতেও ট্রাইব্যুনালের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। জামায়াতে ইসলামী সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
এখন বিচারপতি মহোদয়ের পদত্যাগের ঘটনাকে তারা ব্যবহার করতে চাইছে। সেই সুযোগে তারা বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। অথচ ট্রাইব্যুনালের আইনের ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বিচারপতির পদ শূন্য হলে তিনি যে পর্যন্ত কাজ করেছেন তার পর থেকে কাজ শুরু হবে। তার পরও জামায়াত অহেতুক বিলম্ব করছে। ট্রাইব্যুনাল পুনর্বার সাক্ষীকে হাজির করতে বাধ্য নন। সুতরাং যাঁরা বলেন, সাকা চৌধুরী, গোলাম আযমদের বিচার পুনরায় শুরু করতে হবে, তার আইনগত ভিত্তি নেই। হ্যাক করা আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ। নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড ১৬৮ বছরের পুরনো পত্রিকা, এটিও বন্ধ হয়ে গেছে আড়ি পাতার অপরাধে। আমাদের এখানে কী হবে সেটা দেখার বিষয়। জামায়াত সঙ্গী পেয়েছে বিএনপিকে। বিএনপি পক্ষাবলম্বন করে তাদের শক্তিশালী করছে।
বাংলাদেশের সুধী সমাজ, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে সব মত ভুলে বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার কাজে সহযোগিতা করতে হবে। বাংলাদেশের এই বিচারপ্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ। এখানে আপিলের সুযোগ আছে। ফলে রায় ঘোষণার পর অভিযুক্তরা ইচ্ছা করলে উচ্চ আদালতে যেতে পারে। তেমনটি হলে আরো দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করা দরকার হবে। এর জন্য একটি পরামর্শক কমিটিও গঠন করা যেতে পারে। আমরা চাই, মানবতাবিরোধী যে বিচার হচ্ছে তার দ্রুত সমাপ্তি ঘটুক।
আমাদের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের সুধী সমাজ গণ-আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এখন তাদের ভূমিকা আগের মতো শক্তিশালী নয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ। এর সুযোগ গ্রহণ করছে বিরোধীপক্ষ। সরকারের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। সামনের এক বছর তাদের আরো শক্তিশালী ভূমিকা নিতে হবে। এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ আছে মাত্র এইটুকু সময়। স্বাধীনতাবিরোধীচক্র চাইবে কোনোভাবে বিচার বিলম্বিত করতে। তাদের এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলে জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভোগে পড়তে হবে। এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে সুধী সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
(অনুলিখন)
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.