জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন বাংলাদেশের কৃষি by মো. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী

জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধিকে যদি বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে কৃষি হচ্ছে তার মূল, শিল্প তার শাখা ও বাণিজ্য তার পাতা। মূলে কোনো কারণে ক্ষত দেখা দিলে তা পুরো বৃক্ষটিকে ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশের কৃষির গুরুত্ব বিচারে চীনের এই প্রবাদটি ধ্রুব সত্য। কৃষিই হচ্ছে বাংলাদেশের জীবন।


বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি সুষ্ঠু কৃষি উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান দেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিকাজকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাই কৃষির অবনতি হওয়া মানে গোটা জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো পঙ্গু হয়ে যাওয়া।
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় হুমকি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী এক মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৃদ্ধি, আবহাওয়া উপাদানসমূহে পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণ এবং এদের প্রভাবে জীবন ও জীবিকা আজ বিপন্ন। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা; কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠী এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন। বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার অবনতি হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন। কোনো এলাকার সাধারণত ৩০-৪০ বছরের গড় আবহাওয়াকে জলবায়ু বলে। আর এ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে বায়ুর তাপমাত্রা, চাপ প্রবাহ, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক নিয়মের অভাবনীয় পরিবর্তন। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় একে গ্রিনহাউস প্রভাব বলে। গত শতাব্দীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ২৫ শতাংশ, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ ১৯ শতাংশ এবং মিথেনের পরিমাণ শতভাগ বেড়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন আবহাওয়ার ধরন এবং ঋতুবৈচিত্র্য পাল্টে দিচ্ছে। এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি ঘটার আশঙ্কা ও ফলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। ইতিমধ্যেই অনেক দেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং জনগোষ্ঠী এর প্রভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। জলবায়ুর এ পরিবর্তনের ফলে কৃষি খাতে বাড়ছে অনিশ্চয়তা, হারিয়ে যাচ্ছে ঋতুবৈচিত্র্য, বর্ষা আসছে প্রকৃতি সময়ের অনেক আগে কিংবা পরে। ফলে বর্ষানির্ভর কৃষিক্ষেতে ব্যবহার হচ্ছে সেচ পদ্ধতি, তাতে লাভের তুলনায় লোকসান হচ্ছে বেশি। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় জমি চাষ বা বীজ বপন- কোনোটিই ঠিক সময়ে করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার কখনো কখনো অসময়ে বা অত্যধিক বৃষ্টি হওয়ার ফলে মাঠের প্রায় সব ফসল বিনষ্ট হয়ে যায় কিংবা ফসলের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা, কাটা, মাড়াই ও শুকানো- কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে অনাবৃষ্টি বা অল্পবৃষ্টির ফলেও অতিবৃষ্টিপাতের মতো ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে। 'ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ'-এর মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বে ২০২০ সালের মধ্যে বৃষ্টির ওপর নির্ভর ফসলের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। অথচ ২০২০ সালের মধ্যে আমাদের জনসংখ্যা হবে প্রায় ২৫ কোটি। ফলে কী ধরনের সমস্যা হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অভাবনীয় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা বিশ্বে মোট উৎপাদন ক্রমাগত কমে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরই দ্বিতীয় রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবছর প্রায় ২৫ মিলিয়ন (দুই কোটি ৫০ লাখ) টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়। কিন্তু বিগত বছরের তুলনায় এর উৎপাদন ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৬ সালে সেখানে মাত্র ৯.৮ মিলিয়ন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়েছে, যার ফলে বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়েছে গত ২৮ বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। যেভাবে দ্রুত জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে আমাদের দেশের উৎপাদন ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
প্লাবনের কারণে দেশে আমন ধানের উৎপাদন ১৩.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন হ্রাস পাবে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, শীতকালে বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা খরার কবলে পড়ে, কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এর ব্যাপ্তি আরো দুই হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার বেড়ে যেতে পারে। ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সামগ্রিকভাবে ভেঙে পড়বে দেশের অর্থনীতি।
প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে ১৯-৩৭ সেন্টিমিটার। ফলে বাংলাদেশসহ সব দ্বীপরাষ্ট্র ও নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে সমুদ্রে। উপকূল নিমজ্জিত হওয়ার ফলে কচ্ছপের মতো অনেক প্রাণী ও প্যাগাসাস-পেঙ্গুইনের মতো অনেক শীতল পানির প্রাণী বিলুপ্তের সম্মুখীন হবে। প্রকৃতির প্রাচীর হিসেবে দেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের শক্তির পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। অথচ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৪৫ সেন্টিমিটার বাড়লে সুন্দরবনের প্রায় ৭৫ শতাংশ নিমজ্জিত হবে। এক মিটার বাড়লে পুরো বনই ডুবে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্নীতির কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপকূলীয় বনাঞ্চল সুন্দরবন আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। বাংলাদেশের বিশিষ্ট জলবায়ু গবেষক আহসান উদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছেন, খুলনা ও সাতক্ষীরার বাইরে যশোর ও মাগুরাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় লোনা মাটির গাছ, যেমন কেওড়া, গরান প্রভৃতি গাছ জন্মাচ্ছে। অর্থাৎ যশোর ও মাগুরায় লোনা পানির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে সমুদ্রের পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে লোনা পানির পরিমাণ বেড়ে গেলে মিঠা পানির গাছ আর জন্মাতে পারবে না। ফলে বন ও পরিবেশের বাস্তুসংস্থানে আসবে আমূল পরিবর্তন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ১১ শতাংশ জমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষ হবে ক্ষতিগ্রস্ত। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, এসব মূলত জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের ফল। ইতিমধ্যে বিগত ২৫ বছরে বাংলাদেশ প্রায় ছয়টি বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। এ ছাড়া সিডর, আইলা ও নার্গিসের মতো ভয়াবহ দুর্যোগের কবলে পড়েছে। শুধু ১৯৮৮ সালের বন্যায় মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় হাজার মানুষ, ক্ষতি হয়েছে বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে আগামী দশকে ২৫০ লাখ মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। বাংলাদেশে প্রতিদিন বহু মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ উদ্বাস্তু হচ্ছে। নদীভাঙন, প্লাবন ইত্যাদি কারণে মানুষ ঘরবাড়ি, জমি হারিয়ে পরবর্তী সময়ে শহরাঞ্চলের বস্তিতে মানবেতর জীবন যাপন করে। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল সময়ে বাংলাদেশে ৯৩টি বড় ধরনের দুর্যোগ হয়; যা কৃষি ও অবকাঠামো খাতে ৫৯০ কোটি ডলারের ক্ষতি সাধন করে। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া এক তথ্য মতে, বিশ্বের শীর্ষ ১২ বন্যাপ্রবণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম ও ঝড়ের জন্য দ্বিতীয়। কেবল বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব উপকূলবর্তী দেশ এসব সমস্যার সম্মুখীন হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমাদের জীবন ও জীবিকার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন যেমন কৃষিতে প্রভাব ফেলে ঠিক তেমনি মৎস্য ও অবকাঠামো ক্ষেত্রও প্রভাবিত করে। তাই আমাদের সভ্যতার নিদর্শন ও অর্থনীতির মেরুদণ্ড এই কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে হলে রুখতে হবে এ জলবায়ু পরিবর্তনকে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ দৈনিক দুই ডলারের কম আয় করে, যাদের পক্ষে উন্নত দুর্যোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদের সরকারি-বেসরকারি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বনায়ন তথা তৈরি করতে হবে সবুজ উদ্ভিদের সমারোহ। উন্নত ও অনুন্নত দেশের আন্তরিক সমঝোতা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষিতে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে খুবই গুরুত্বপূর্ণর্ ভূমিকা পালন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিপন্ন জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা অর্জন অতিজরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সব বিপন্ন জনগোষ্ঠী, দায়িত্বশীল সরকারি প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবার সচেতনতা বৃদ্ধি। সর্বোপরি, কৃষি গবেষণার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বের করতে হবে নিত্যনতুন জাতের খরাসহিষ্ণু, লবণাক্তসহিষ্ণু ও বন্যাসহিষ্ণু ফসল। এসব জাতের ফসল কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এসব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে তখন হয়তো নতুন করে ভাবতে হবে কৃষিনির্ভর এই বাংলাদেশকে নিয়ে।
লেখক : এমএসইন. বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

No comments

Powered by Blogger.