একজন ক্ষণজন্মা অসাধারণ মানুষ by মুশফিকুর রহমান

কামরুলের সঙ্গে আমার পরিচয় কিভাবে, কোথায় হয়েছিল, তা মনে না থাকলেও ঘনিষ্ঠতা হয় আমি এলজিইআরডির সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক তখন লোকাল গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরোর (এলজিইবি) প্রধান হিসেব দায়িত্ব পালন করছিলেন।


এলজিইবির প্রধান হিসেবে তিনি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে এটাকে আর বেশি দিন প্রকল্প হিসেবে চালানো সম্ভব হবে না। কারণ প্রকল্পে কর্মরত স্টাফরা সরকারি চাকরির কোনো বেনিফিট পান না। অন্যদিকে তাঁদের চাকরির মেয়াদও প্রকল্প চলাকালীন পর্যন্ত। যদি কোনো কারণে প্রকল্প দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে প্রতিবছর প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। স্বভাবত কারণেই দক্ষ বা মেধাবী লোকেরা প্রকল্পের চাকরিতে অনীহা প্রকাশ করেন। সেসব বিষয় অনুধাবন করে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক তাঁর পরিচালিত এলজিইবি প্রকল্পকে একক উদ্যোগে কঠোর পরিশ্রম করে সরকারের উচ্চ মহলের সহযোগিতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে (এলজিইডি) উন্নীত করেন এবং এলজিইডির প্রথম প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে তাঁকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। আমার সঙ্গে তাঁর এই প্রকল্পকে বিভাগে রূপান্তর করা এবং তা বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশের উন্নয়নে এলজিইডির মাধ্যমে কী ধরনের ভূমিকা নেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর আমি তাঁকে তাৎক্ষণিক আমার সম্মতি জানাই এবং দ্রুত প্রস্তাব আকারে আমার দপ্তরে উপস্থাপনের জন্য নির্দেশ দিই। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক শুধু একজন প্রকৌশলী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন যোগ্য ও দক্ষ প্রশাসক। তা জ্বলন্তভাবে প্রমাণ করে গেছেন এলজিইবিকে এলজিইডিতে রূপান্তর করে, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে। আমাদের দেশে সরকারি নিয়মাবলিতে কোনো প্রকল্পকে বিভাগে রূপান্তর করা যে কী কঠিন কাজ, তা শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই জানেন।
আশির দশক। তখনো উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হননি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই উপজেলার প্রধান। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে তিনি হবেন উপজেলা প্রশাসনের প্রধান, অর্থাৎ উপজেলা প্রকৌশলীদের তাঁর অধীনে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অনেক উপজেলায় সম্ভাব্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান হবেন একজন স্থানীয় ঠিকাদার অথবা স্বল্প শিক্ষিত ব্যবসায়ী। যিনি এত দিন উপজেলায় কর্মরত প্রকৌশলীর সঙ্গে নম্রতার সঙ্গে কথা বলতেন, এখন তাঁরই নির্দেশে দায়িত্ব পালন করতে হবে- বিষয়টি অধিকাংশ প্রকৌশলীর মনঃপূত ছিল না। আমাদের দুর্ভাগ্য, গণতান্ত্রিক-প্রক্রিয়ার সঙ্গে শিক্ষিত-অশিক্ষিত কারো ঘনিষ্ঠ পরিচয় নেই। আর আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধির গ্রহণযোগ্যতা স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। উপজেলা তৈরির পর এ দ্বন্দ্ব প্রকট ছিল। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের দূরদৃষ্টিতে এ সমস্যা তখনই ধরা পড়ে এবং গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তাঁর কর্মকর্তাদের সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্যোগী হন। যা তিনি সফলভাবে সমাধান করতে পেরেছিলেন বলেই এ দেশের পল্লী ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে এক যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করেন। আজকের গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে গতি এসেছে, যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের ফলেই সম্ভব হয়েছে। সারা দেশে আজ যে মাইক্রো ক্রেডিটের সুফল দেখা যায়, তা শুধু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের দূরদৃষ্টিতার ফলে। গ্রামীণ কৃষকের পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত-প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সার্ভিস (এমআইএস) চালুর কারণে। জনজীবনের উন্নয়নে অবকাঠামোর যে গুরুত্ব, তা কামরুল ইসলাম সিদ্দিক অনুধাবন ও অন্তর্দৃষ্টির কারণে এলজিইডিকে শূন্য থেকে সফলতার শিখরে নিয়ে গেছেন। এলজিইডির মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবর্তনের যে রূপরেখা তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন, এর সার্থক বাস্তবায়ন আজ সারা দেশে বিদ্যমান। আশির দশকে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের যে ধারা শুরু করেছিল তৎকালীন সরকার, তাঁর মতো একজন যোগ্য প্রশাসকের কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল, তা না হলে আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ে সাড়ে তিন বছরে এ কাজ কতটুকু সম্ভব হতো, তাতে আমার নিজেরই সন্দেহ ছিল।
আমার দায়িত্বকালীন তিনি যখনই কোনো প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, তা আমি নির্দি্বধায় অনুমোদন করে দিয়েছি। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের গতানুগতিক নিয়মে আবদ্ধ না থেকে কাজের ক্ষেত্রে সব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেছিলেন তাঁর অসামান্য দেশপ্রেম ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে। আধুনিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক বিশ্বের সর্বশেষ প্রযুক্তি সম্পর্কেও জ্ঞান রাখতেন এবং সেই প্রযুক্তি বাংলাদেশে কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তা নিয়ে বিভোর থাকতেন। তাঁর উজ্জ্বল প্রমাণ এলজিইডিকে আধুনিক প্রযুক্তি-ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা। আজকের বাংলাদেশে ডিজিটাল শব্দটি ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেলেও এর বাস্তবায়ন শুরু হয় কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের মাধ্যমে, নব্বইয়ের দশকে জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা দেশের মানচিত্র তৈরি করার মাধ্যমে। যে মানচিত্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে দেশের কোন অঞ্চলে কী ধরনের কাজ করা সম্ভব, তা নির্ধারণ করা যায়। আজকের এলজিইডির দৃষ্টিনন্দন ভবন তাঁরই সৃষ্টি। আমার সময়ে এ ভবন নির্মাণের জন্য অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। জাইকা ও জেবিআইসির সহায়তায় রুরাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টার (আরডিইসি) ভবন নির্মাণ করে এলজিইডির সব প্রকল্পকে একই ছাদের নিচে সংকুলান করেন। ফলে এলজিইডির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয় সহজতর হয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে আসে ক্ষিপ্র গতি।
নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ, উন্নত কলাকৌশল নিয়ে কাজ করা এবং আধুনিক বিশ্বের ভাবনাকে দেশের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর বিষয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছেন। দেশের স্বার্থে দাতা সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে তাঁর কাজ আদায় করে নেওয়ার দক্ষতা দেখে আমি অবাক হয়েছি। পাশাপাশি সরকারের কোনো দপ্তর থেকে কাজ আদায় করার ক্ষেত্রে তিনি যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন, তা এক কথায় অসাধারণ। সময়মতো কাজ আদায়ের পাশাপাশি মনিটরিং করার ক্ষেত্রে তাঁর যে অক্লান্ত চেষ্টা ছিল, তা সত্যি অবাক করার মতো। তিনি শুধু বর্তমানকে নিয়ে কাজ করতেন না, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাজের প্ল্যানিং ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতেন। দেশের সম্মান উজ্জ্বল করার মতো এই মানুষটি আজ আমাদের মাঝে নেই। আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক : সাবেক সচিব ও বিকল্প নির্বাহী
পরিচালক, বিশ্বব্যাংক

No comments

Powered by Blogger.