কল্পকথার গল্প-'মানুষের মুখ হইতে সাবধান'! by আলী হাবিব

বহু কাল আগে একবার চিত্রগুপ্ত স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। নির্ধারিত সময়ে স্বর্গে ফেরত যাননি তিনি। উপযুক্ত বিবেচিত না হলেও সে জন্য কারণ দর্শাতে হয়েছিল তাঁকে। দীর্ঘদিন পর আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। নারদ মর্ত্যে এসে স্বর্গে ফিরে যাননি।


মাঝে কয়েক দিন তিনি স্বর্গধামে কারো সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগও রাখেননি। পরেমশ্বর তাই ক্ষুব্ধ। এমনটি হওয়ার কথা নয়। একটা বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে নারদকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পাঠানো হয়েছিল। পাছে কেউ তাঁকে চিনে ফেলে সে জন্য তাঁর বাহন ঢেঁকি সঙ্গে আনতে পারেননি তিনি। কিন্তু তাই বলে স্বর্গে ফিরে যাওয়া তাঁর জন্য মোটেও কঠিন কাজ নয়।
এ নিয়ে দরবারকক্ষে পরমেশ্বর বৈঠক ডেকেছেন। উপস্থিত দেবতাদের উদ্দেশ করে পরমেশ্বর বললেন, 'নারদের কাণ্ডজ্ঞান দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। তাঁকে একটা বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। সে অ্যাসাইনমেন্টের রিপোর্ট পাঠিয়ে সে নিরুদ্দেশ। কোনো খোঁজখবর নেই তাঁর।'
একটু দূরে বসে ছিলেন চিত্রগুপ্ত। পরমেশ্বর তাঁর দিকে তাকাতেই ভয়ে অনেকটা জড়োসড়ো হয়ে চিত্রগুপ্ত বললেন, 'এসে যাবে। নিদেনপক্ষে একটা খবর অন্তত সে পাঠাবে। চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া নারদ যথেষ্ট বুদ্ধি রাখেন। তাঁর কোনো বিপদ হবে না।'
চিত্রগুপ্তের কথা শেষ হওয়ার আগেই পরমেশ্বর যেন গর্জে উঠলেন। তাঁর সব রাগ যেন চিত্রগুপ্তের ওপর গিয়ে পড়ল। তিনি বললেন, 'সব কিছুর জন্য তুমিই দায়ী। তুমিই পথ দেখিয়েছ। এর আগে একবার তোমাকে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। তুমিও ঠিক এমনটি করেছিলে। নির্দিষ্ট সময়ে স্বর্গধামে ফিরে না এসে বেশ কিছুদিন মর্ত্যে কাটিয়ে এসেছিলে।'
চিত্রগুপ্ত ভয়ে ভয়ে বললেন, 'পরমেশ্বর আমার বিষয়টি ছিল ভিন্ন। নারদ কী কারণে মর্ত্যে এত দিন পরিভ্রমণ করছেন, তা জানাটাই এখন আমাদের জন্য জরুরি।'
পরমেশ্বর বললেন, 'তুমি কেমন করে জানলে নারদ পরিভ্রমণে বেরিয়েছেন? এটা পরিভ্রমণ না প্রমোদভ্রমণ? আমি তো তাঁকে নির্দিষ্ট কাজ দিয়ে পাঠিয়েছি। এর বাইরে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি তাঁকে কে দিয়েছে? তুমি যখন পরিভ্রমণের কথা বলছ, তখন তো ধরেই নেওয়া যায়, তোমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে। কালকের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আমার সামনে হাজির করবে।'
সেদিনের মতো সভা মুলতবি হয়ে গেল। বৃদ্ধ চিত্রগুপ্ত প্রমাদ গুনলেন। কথা বলতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছেন। নারদ মর্ত্যে যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এটা সত্য। কিন্তু এখন কোথায় আছেন, তা তিনি জানেন না। দেবতাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের একটা মাধ্যম আছে। সেই মাধ্যমে তিনি যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। ধরতে পারলেন না। পরদিন পরমেশ্বরের সভায় নারদ সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। এর অন্যথা হলে হেনস্তা হতে হবে তাঁকে। ভরা সভায় হেনস্তা হতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু কী আর করা যাবে! দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না চিত্রগুপ্ত। এমনিতেই বেশিক্ষণ কোথাও বসে থাকলে ঘুম পেয়ে যায় তাঁর। এ নিয়ে অনেকবার বিব্রত হতে হয়েছে তাঁকে। যমরাজ তো একবার তাঁকে স্বর্গ থেকে বের করে দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু এই রাতে তাঁর চোখ থেকে ঘুম উধাও।
পরদিন সকালে ঘুম ঘুম চোখে পরমেশ্বরের দরবারে হাজির হতেই চিত্রগুপ্ত দেখেন, নারদ একপাশে চুপ করে বসে আছেন। তিনি তাড়াতাড়ি নারদের পাশে গিয়ে বসলেন। নারদ আস্তে করে বললেন, 'এমনিতেই আমার জন্য আপনাকে অনেক হেনস্তা হতে হয়েছে। পাশে বসলে আজ আবার হেনস্তা হতে হবে। দূরে গিয়ে বসুন।' চিত্রগুপ্ত জানতে চাইলেন, 'এত দিন কোথায় ছিলেন?' নারদ বললেন, 'সে অনেক ইন্টারেস্টিং কাহিনী। দরবারে আজ সেটাই আলোচনা করব।'
একে একে দেবতারা আসতে শুরু করলেন। সবার শেষে পরমেশ্বর দরবারকক্ষে ঢুকলেন। নারদকে একপাশে বসে থাকতে দেখেই বললেন, 'সবার আগেই এসে বসে আছ! বেশ। তা বলো এই কদিন নিরুদ্দেশ থেকে কোন মহৎ কর্মটি করে এলে?
নারদ বললেন, 'আপনার অ্যাসাইনমেন্টের বাইরে একটু ডিটেইলে কাজ করতে চেয়েছিলাম পরমেশ্বর। কিন্তু মর্ত্যে মানুষের কারবার দেখে আমি তাজ্জব বনে গেছি। কী করব কিছুই বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকতে পারিনি। পালিয়ে এসেছি।'
পরমেশ্বর বললেন, 'তোমার মতো একজনকে মর্ত্য থেকে পালিয়ে আসতে হলো কেন?'
'পরমেশ্বর তো অনেক কিছুই জানেন। আহা, আগের সেই পুরাণের যুগ এখন আর নেই। আগের দিনের মতো রাজারা নেই।' নারদ তাঁর কথা শুরু করেছিলেন। পরমেশ্বর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, 'থাকলে কী হতো?'
'অশ্বমেধযজ্ঞ হতো, আপনার মনে আছে পরমেশ্বর। একটা ঘোড়া বেছে নেওয়া হতো। সেই বিশেষ ঘোড়াটিকে ছেড়ে দেওয়া হতো। তারপর সেটা যেদিকে যেত, সেই পথে রাজার সৈন্যরা যেত। ঘোড়াটি যে রাজ্যের ভেতর দিয়ে যেত, সেই রাজ্যের রাজাদের এই অশ্বাধিকারী রাজার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে হতো। স্বীকার না করলে যুদ্ধ হতো। এক বছর পর ঘোড়াটি ফিরে এলে শাস্ত্রমতে সেটাকে বধ করা হতো। তারপর তো নানা ব্যাপার-স্যাপার। আজকাল আর সেই অশ্বমেধযজ্ঞ নেই পরমেশ্বর। আজকাল অদৃশ্য ঘোড়া ছোটানো হচ্ছে।'
'পৃথিবীতে আজকাল এক ধরনের অদৃশ্য হেলমেট তৈরি হয়েছে শুনেছি। অদৃশ্য ঘোড়ার কথা তো শুনিনি!' পরমেশ্বর যেন একটু বিস্মিত হলেন।
নারদ বললেন, 'সেই কথাই তো বলতে চাইছি পরমেশ্বর। ব্যাপারটা আমিও তো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। আমরা তো পৌরাণিক আমলের আচার-আচরণ ভালো করে জানি। এ আমলের ব্যাপার-স্যাপার আমাদের বুঝে উঠতে একটু দেরি হয়। খটকা লাগে। আমিও শুরুতে বুঝে উঠতে পারিনি। পরে এই অদৃশ্য অশ্ব দাবড়ানোর ব্যাপারটি ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছি।
ব্যাপারটি একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি পরমেশ্বর। মর্ত্যে অনেক দেশ আছে, যে দেশগুলো অন্য দেশের ওপর কর্তৃত্ব করতে চায়। আবার এমন অনেক দেশ আছে, যে দেশগুলো নিজেদের মতো করে চলতে চায়। তারা নিজেদের স্বাধীন মনে করে। স্বাধীন ভাবে। এই দেশগুলোতে আবার অভাব আছে। দেশের উন্নয়নের জন্য তাদের অন্যের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হতে হয়। এটাই হচ্ছে এখনকার অশ্বমেধযজ্ঞ। এই অশ্বের নাম অর্থ। যে দেশটি কর্তৃত্ব করতে চায়, সে দেশটির কথা না শুনলে অর্থ তো পাওয়া যাবেই না, উল্টো অনর্থ হবে।'
'এটাই স্বাভাবিক। নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সবাই চেষ্টা করে থাকে'- বললেন পরমেশ্বর। 'এতে নতুনত্বের কিছু নেই। নতুন কোনো খবর থাকলে সেটা আমাদের শোনাও।'
নারদ বললেন, 'ইন্টারেস্টিং একটা খবর আছে পরমেশ্বর। আপনি জানেন সর্পের মস্তকে মণি থাকলেও সে ভয়ংকর। সাপ দেখে মানুষ সব সময় দশ হাত দূরে থাকে। সে আমলে এক রাজার পুত্রকে সর্প দংশন করলে তাঁর স্ত্রী স্বামীর মরদেহ নিয়ে এই স্বর্গলোকে চলে এসেছিলেন। বাসুকিকে সমুদ্র মন্থনের রজ্জু হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সে মন্থনে বাসুকি হলাহল উগরে দেওয়ায় সেটা পান করতে হয়েছিল দেবাদিদেব মহাদেবকে। কিন্তু সম্প্রতি মানুষের কামড়ে সাপের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে পরমেশ্বর। বুঝুন, তাহলে কী ভয়ংকর ব্যাপার! মানুষের মুখের বিষে সাপের মৃত্যুর ঘটনা এর আগে আর কখনো কি কেউ শুনেছে!'
নারদ এটুকু বলে থামতেই পরমেশ্বর বললেন, 'তোমাকে পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশে। তুমি বাংলাদেশের কথা বাদ দিয়ে দেশ-বিদেশের কথা বলে যাচ্ছ।'
পরমেশ্বরের কথা শুনে নারদ বললেন, 'বাংলাদেশের অবস্থা আরো খারাপ পরমেশ্বর। সেখানে মানুষের মুখের কথায় আরো বেশি বিষ। বিষে বিষ ক্ষয় বলে একটা কথা আছে। বোধ করি, সে কারণেই সে বিষক্রিয়া অনেকের চোখে পড়ে না। আগে মানুষ বনে-বাদাড়ে গেলে মুরব্বিরা সাপ থেকে সাবধানে থাকতে বলতেন। কমে গেছে, কিন্তু এখনো অনেক বাড়ির সামনে ছোট সাইনবোর্ডে লেখা আছে, 'কুকুর হইতে সাবধান।' বাংলাদেশের মানুষ এখন মনে মনে একটা মন্ত্র উচ্চারণ করে, সেটা হচ্ছে- 'মানুষের মুখ হইতে সাবধান।' এই মানুষের মুখনিঃসৃত বিষের উপশম করে এমন কোনো দাওয়াই এখনো আবিষ্কৃত হয়নি পরমেশ্বর।'
লেখক : সাংবাদিক, habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.