সমকালীন প্রসঙ্গ-সরকারের দমন নীতি ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রসঙ্গে by বদরুদ্দীন উমর

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদিকে বলছেন যে, সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের জানমাল রক্ষা করা, অন্যদিকে মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছাড়তে থাকা লোকদের উদ্দেশে বলেন, তারা নিজের নিজের ঘরে তালা মেরে তারপর যেন বাইরে যান! ঘরে তালা না দিয়ে কেউই বাইরে যান না।


কাজেই এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কথার স্পষ্ট অর্থ, বাসায় অনুপস্থিত থাকলে মালের হেফাজতের দায়িত্ব সরকারের নয়। নিজের মাল রক্ষার জন্য প্রত্যেককেই নিজে দায়িত্ব এবং উদ্যোগ
নিতে হবে


শিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব এবং ঔদ্ধত্য বর্তমান সরকারের সমগ্র নেতৃত্বকে এমন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে যেখানে তাদের কথার ভাণ্ডারে আর বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই। এ জন্য এখন তারা মুখ খুললেই অপ্রাসঙ্গিক কথা, আবোল-তাবোল বা ফালতু কথা এবং নিজেদের বিরোধী শক্তিগুলোকে হুমকি দেওয়া ছাড়া তাদের আর বলার কিছু নেই। এই বচন চর্চাই এখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দলীয় নেতাকর্মী সকলের দ্বারাই চলছে। তাদের মুখে এ ধরনের কথার খৈ ফুটছে। এই ফালতু কথা বলা লোকের মধ্যে যারা আছেন তার মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন। মন্ত্রিত্বের গদিতে সমাসীন হওয়ার পর থেকেই তিনি নিজের গুণাগুণের গল্প বিস্তার করে আসছেন। তার নানা বক্তব্য এখন জনগণের হাস্যরসের খোরাক। কিন্তু বাহ্যত এসব বক্তব্য নির্বোধ ও হাস্যকর মনে হলেও এর বিপজ্জনক দিক কোনোভাবেই উপেক্ষা করার নয়। কারণ এসব নির্বোধ ও হাস্যকর বক্তব্যের মাধ্যমেই সরকারের নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
২৬ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সরকার বিরোধিতার নামে যারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে সরকার তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে বদ্ধপরিকর। এ ধরনের হুমকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এক নিয়মিত ব্যাপার। এই হুমকি দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, সরকারের দায়িত্ব হলো, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করা। কাজেই বিরোধী দল যদি জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করে তাহলে সরকার তাদের কোনো ছাড় দেবে না (ডেইলি স্টার, ২৭.৮.২০১২)। জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের এ কথাটি খাঁটি। কিন্তু যিনি এই কথা বলছেন তিনি ভেজাল। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্য সরকারি লোকদের বাকপটুতা সম্পর্কে এটা সাধারণভাবেই বলা চলে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদিকে বলছেন যে, সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের জানমাল রক্ষা করা, অন্যদিকে মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছাড়তে থাকা লোকদের উদ্দেশে বলেন, তারা নিজের নিজের ঘরে তালা মেরে তারপর যেন বাইরে যান! ঘরে তালা না দিয়ে কেউই বাইরে যান না। কাজেই এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কথার স্পষ্ট অর্থ, বাসায় অনুপস্থিত থাকলে মালের হেফাজতের দায়িত্ব সরকারের নয়। নিজের মাল রক্ষার জন্য প্রত্যেককেই নিজে দায়িত্ব এবং উদ্যোগ নিতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মালের ব্যাপারে একথা বলেছেন। কিন্তু তার আগে তাদের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সাগর-রুনি হত্যার পর সে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করে বলেছিলেন, লোকের বেডরুম পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের নয়! সত্যিই তো এ দায়িত্ব তাদের যে নয়, এটা তাদের কাজকর্মের মাধ্যমে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী বেডরুম পাহারা দেওয়ার ব্যাপারে যা বলেছিলেন, তারপর থেকে দেশে বেডরুম মার্ডার নিয়মিতভাবেই শুরু হয়েছে। এ বছর ঈদের সময় থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকাতেই পরপর চারটি বেডরুম মার্ডারের ঘটনা ঘটেছে।
বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের প্রসঙ্গে সরকার নৈরাজ্য সৃষ্টির কথা বললেও কার্যত জনগণের নিরাপত্তা বিষয়ক দায়িত্ব পালন করতে সরকারকে একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু বাসায় মানুষের জানমালের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য সরকারি লোকেরা যা বলে আসছেন তার ফলে তারা নিজেরাই বৃদ্ধি করছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক নৈরাজ্য। তারাই সব থেকে বড় আকারে বিপন্ন করছেন জনগণের নিরাপত্তা। সরকারের এই অবস্থার কারণে এবং এর দ্বারা উৎসাহিত হয়ে সাধারণ ক্রিমিনালরাও এখন তাদের অপরাধের বিস্তার আরও ব্যাপকভাবে ঘটাচ্ছে। এর দায়িত্ব সরকারকে অবশ্যই নিতে হবে।
সরকার দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করে দেশ শাসন করতে নিযুক্ত হওয়াই বিদ্যমান নৈরাজ্যের মূল কারণ। এ কাজ ১৯৭২ সাল থেকে প্রত্যেকটি সরকারই করে এসেছে। এদিক দিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অভিন্ন এক শ্রেণীকাঠামোর মধ্যে তারা সকলেই একইভাবে নিজেদের ক্ষমতার ব্যবহার করে থাকে। কাজেই ক্ষমতায় থাকার সময় তারা স্বৈরতন্ত্রী এবং বিরোধী দলে থাকার সময় গণতন্ত্রী? বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় তাদের স্বৈরতন্ত্রী চেহারায়ই আমরা এখন দেখছি।
একের পর এক সরকার স্বৈরতন্ত্রী হিসেবে শাসন পরিচালনা করা এবং এদিক দিয়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকার কারণে সামগ্রিকভাবে সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আচরণই এখন সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়েছে। তারা ক্ষমতায় বসার ঠিক পর থেকেই যেভাবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দলগত স্বার্থে চুরি, দুর্নীতি, লুটতরাজ, সন্ত্রাস করতে থাকে তাতে গণতান্ত্রিক শাসন পরিচালনা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা করা তাদের দ্বারা সম্ভব হয় না। কাজেই এই পরিস্থিতিতে কোনো বিদ্যমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। এটা হতে পারে না বলেই ১৯৯১ সালে এবং তারপর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন বাংলাদেশে হয়েছিল। সে প্রয়োজন এখনও শেষ হয়নি। এটাই বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা। কিন্তু এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ক্ষমতাসীন সরকার হিসেবে নিজেদের সরাসরি অধীনে ও তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তাতে ব্যাপক কারচুপির উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদে আইন পাস করেছে। অন্যদিকে এ কাজ যে আগামী নির্বাচনে পরাজয়কে জয়ে পরিণত করারই এক আওয়ামী চক্রান্ত এটা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেন সকল বিরোধী সংসদীয় দল, বিশেষত বিএনপি এর বিরুদ্ধে এখন আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনকে জনবিরোধী এবং জনগণের জানমাল বিপন্নকারী, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার এখন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
কিন্তু শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারই নয় যে কোনো বিষয়ে সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা সহ্য করার মতো অবস্থা সরকারের নেই। কাজেই তারা স্বাধীনভাবে মিটিং-মিছিল করা, আন্দোলন করার সম্পূর্ণ বিরোধী। ইস্যু যাই হোক, তা বিবেচনার বাইরে রেখে যে কোনো বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমন করতে সরকার এখন বদ্ধপরিকর। ক্ষমতায় থাকার জন্য এই যাদের নীতি ও কর্মকাণ্ড তারা একটি নির্দলীয়, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার সম্ভাব্য পরিবর্তনের সর্বাত্মক বিরোধিতা যে করবে এটা যে কোনো গর্দভের কাছেও পরিষ্কার। তবে দেশের পরিস্থিতি যেভাবে এখন মোড় নিচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে সংবিধানে নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে কোনো না কোনো ধরনের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেই হবে। এ কাজ না করলে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতোই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নির্বাচন ভেস্তে দিয়ে ২০০৭ সালের মতো আবার একটি বেনামি সামরিক সরকার কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পথই প্রশস্ত করবে।
২৭.৮.২০১২

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.