পাকিস্তান-দেশের বিদ্যমানতার প্রতিই হুমকি by এম আবদুল হাফিজ

আজকের পাকিস্তান যে আসলে একটি অগি্নকুণ্ডের রূপ নিয়েছে, তা পাকিস্তানেরই ফ্রন্টলাইন মিত্র হয়ে স্বইচ্ছায় কুখ্যাত নয়-এগারোর পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধা। কিন্তু সন্ত্রাসের শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত, যখন আরও আগে পাকিস্তান ১৯৭৯ সালে ওয়াশিংটনের প্রক্সি


যুদ্ধে লড়তে সম্মত হয় বহু বছর ধরেই ওসামা পলাতক ছিলেন। এ সময়ে সবার অঙ্গুলি নির্দেশিত হতো তাকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে পাকিস্তানের দিকেই। কিন্তু পাকিস্তান সবসময়ই ওসামার সম্ভাব্য আশ্রয় হিসেবে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু আল কায়দাপ্রধানের দেশটিতে আশ্রয় পাওয়া কখনোই বিস্ময়কর ছিল না। কেননা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানিরা মার্কিনিদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলেছে অর্থাৎ উভয় প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে একসঙ্গে মিতালি বহাল রয়েছে। ফলে জঙ্গিরা তাদের ঘৃণা করেছে এবং সন্দেহ করেছে মার্কিনিরা।
নির্বাচিত সরকারের এত চাঞ্চল্যকর ঘটনা, যাতে বিশ্বের সবচেয়ে সন্ধানের শিকার একজন জঙ্গিকে হত্যা করা হয় এবং কীভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে তা সম্ভব হয় সে সম্পর্কে একটি কৈফিয়তের প্রশ্ন আছে সে সম্পর্কে সরকার শুধু নীরবই নয়_ সরকার কখনও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ কোন পথে যাচ্ছে সে সম্পর্কে জনগণকে অবহিতও করেনি। কিন্তু এর চেয়ে বিপজ্জনক ক্ষমতাসীন এহেন ত্রুটি-বিচ্যুতি জিহাদিদের আকর্ষণ। কেননা পাকিস্তানের জিহাদিরা এবং যে কোনো উচ্চারণ পাকিস্তানি মনস্তত্ত্বের এত গভীরে চলে গিয়েছে, তার অপসারণ শুধু সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলকে শাণিত করেই সম্ভব।
ইসলামের সামরিক দর্শন সমাজ এতটাই গ্রহণ করেছে যে, তার সঙ্গে তা গোঁড়ামি-ধর্মান্ধতার মতো ব্যাধিতে সংক্রমিত হয়েছে। ফলে যৌক্তিক হলেও সমাজে আর অমত বা ভিন্নমতের কোনো স্থান নেই এবং তা না তাকাতেই যেন ধর্মের মাহাত্ম্য। পাকিস্তানের সামাজিক পরিসরে তাই আজ কোনো যুক্তি, সুস্থ চিন্তা এবং আত্মসংযমের স্থান নেই। এই পরিস্থিতিতে এ কি কোনো আশ্চর্য বিষয় যে, পাকিস্তানের মসজিদ, মাজার, রাজপথ, মার্কেট, শিক্ষাঙ্গন, অফিস, সমতল বা পার্বত্য_ পাকিস্তানের কোনো স্থানই আর নিরাপদ নয়।
উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন পাকিস্তানের নিজস্ব ব্যাপার। কেননা এটা তাদের দেশে ঘটছে এবং এর আসল ধাক্কা দেশবাসীকে সামলাতে হচ্ছে। নারীদের বৈধব্য বরণ করতে হচ্ছে, শিশুরা হচ্ছে অনাথ। ২০০৯-১০-এর ইকোনমিক সার্ভে অব পাকিস্তানের তথ্যানুযায়ী সন্ত্রাসবিরোধী যুুদ্ধে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যয় ৪০ বিলিয়ন ডলার। তবু অনেক পাকিস্তানি এখনও ভাবে যে, এই যুদ্ধ মার্কিনিদের এবং এটা তাদের মাথাব্যথা নয়।
আজকের পাকিস্তান যে আসলে একটি অগি্নকুণ্ডের রূপ নিয়েছে, তা পাকিস্তানেরই ফ্রন্টলাইন মিত্র হয়ে স্বইচ্ছায় কুখ্যাত নয়-এগারোর পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধা। কিন্তু সন্ত্রাসের শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত, যখন আরও আগে পাকিস্তান ১৯৭৯ সালে ওয়াশিংটনের প্রক্সি যুদ্ধে লড়তে সম্মত হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করেছিল। এই যুদ্ধে জিহাদের এক ধর্মীয় রঙ চড়িয়েছিল। সে সময়কার 'ইসলামী' সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া, যার তখনও কোনো বৈধতা ছিল না। একটি আন্তর্জাতিক বৈধতা পেতে উদগ্রীব জিয়া এই যুদ্ধে পাকিস্তানকে ওয়াশিংটনের ইসলামের জন্য যুদ্ধে জড়ায়। জেনারেল জিয়া, ওয়াশিংটন এবং ধর্মীয় দক্ষিণপন্থির সমবেত প্রচেষ্টায় এই যুদ্ধে ইসলাম বনাম কুফরের রূপদান করে।
অতঃপর এক পর্যায়ে যখন ওই জিহাদ শেষ হয় জিহাদিরা তখন তাদের ধর্মান্ধতার ঢাল নিয়ে তাদের অস্ত্রের নল দেশের অভ্যন্তরের দিকে ঘোরায়। সেখানকার অনুমিত 'শত্রুদেরই' তখন যারা নিধন করতে থাকে। এই জিহাদিদের কাছে অন্য কোনো ধর্মের, বিশ্বাসের বা গোষ্ঠীর লোক মাত্রই শত্রু। এসবের সঙ্গে অবশ্য নয়-এগারোর কোনো সম্পর্ক নেই।
পাকিস্তানিদের আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা যে, ধর্মীয় তাৎপর্যের কোনো কিছুতে যখন সন্ত্রাস হয় সন্দেহের তীর নিমেষেই নিক্ষিপ্ত হয় বিদেশি শক্তির দিকে, যারা ইসলাম এবং পাকিস্তানের বিরোধী। তারা বিশ্বের একমাত্র মুসলিম পারমাণবিক শক্তিকে দুর্বল করতে চায় বলে পাকিস্তানে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে। পাকিস্তানিদের অন্ধ বিশ্বাস যে, মসজিদ-মাজারে মুসলমানদের দ্বারা সন্ত্রাস হতেই পারে না। যদিও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসের ঘটনায় বিদেশি শক্তির সম্পৃক্ততা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু যে নরকবাস এখন পাকিস্তানিরা করছে সেটা তাদেরই সৃষ্টি বা কর্মফল।
সন্ত্রাসের বা উগ্রবাদের কারণে সেগুলোর দ্বারা সৃষ্ট অগি্নকুণ্ডে যারাই বসবাস করছে আগে বা পরে তাদের ভস্মীভূত হতেই হবে। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানিদের অস্তিত্ব স্বাভাবিক নয়। যে কোনো সময়ে কেউ কেউ দেশটিতে অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে এবং পড়ছেও। অনেক চিন্তাশীল পাকিস্তানি যে এ নিয়ে ভাবেন না, তা নয়। মুষ্টিমেয় সেসব সুস্থ মস্তিষ্কের পাকিস্তানির মতে, পাকিস্তানকে ইসলামের এক দুর্গে পরিণত করার স্বপ্ন ইতিমধ্যেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে এবং এবার সে দুর্গের বুরুজ ভেঙে পড়ার পালা।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.