খোলা হাওয়া-গণতন্ত্রের রাস্তায় মুড়ির টিনই বা কম কী by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ঞ্চাশ-ষাটের দশকে সোভিয়েত রাশিয়া এবং মিত্রদেশগুলো ছিল এক মেরুতে, অন্য মেরুতে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো। ওই দুই মেরুতে বিভাজিত বিশ্বে সব সময় একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলত। সেই যুদ্ধে শরিক জোটাতে যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়াজুড়ে সমরনায়কদের দিকে সাহায্যের একটা হাত বাড়িয়ে রাখত।


ওই সাহায্যের সামান্য ছিটেফোঁটা পেলেই মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সেনাপতিরা দেশের ক্ষমতা দখল করতেন, অথবা দখল করা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতেন। ওই দুই দশকে সারা বিশ্বে কত যে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটেছে, তার হিসাব নেই। একই সঙ্গে উদ্ভব হয়েছে অনেক বানানা রিপাবলিকের, যেগুলোতে চলত শুধু জঙ্গলের আইন। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক সামরিক শাসক আবার বিপুলভাবে লাভজনক মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তেন। সে রকম দু-এক শাসককে (যেমন পানামার জেনারেল নরিয়েগা) শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনই বিচারের অধীনে এনেছিল। এর কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের পেয়ারের এসব লোক বেছে বেছে যুক্তরাষ্ট্রকেই তাদের মাদকের প্রধান বাজারে পরিণত করেছিল!
বানানা রিপাবলিকগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সেগুলোর নানাবিধ বীভৎসতা। আইনকানুন বলে কিছু ছিল না; নাগরিকদের মানবাধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার এমনকি স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকারও এসব দেশের নাগরিকদের ছিল না। বানানা রিপাবলিকগুলোর সশস্ত্র নানা বাহিনীর হাতে গুম হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এই গুম হওয়া এবং পরবর্তী সময়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া লোকজন বা দেসাপিয়ারেদোসদের তালিকায় ছিলেন প্রতিবাদকারী, রাজনৈতিক কর্মী ও পেশাজীবীদের থেকে নিয়ে পাদরিরা পর্যন্ত। মানবতার এমন বিপর্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন; যার কর্তাব্যক্তিরা কথায়-বক্তৃতায় স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্ব, মানবাধিকার ইত্যাদি ধুয়া তুলতেন; ছিলেন চরমভাবে নির্লিপ্ত। তাদের চোখ থাকত দ্বি-মেরুকেন্দ্রিক সাংঘর্ষিক বিশ্বের বড় ছবিতে; বাড়ির পেছনের উঠানের কদলি-সাম্রাজ্যগুলোর ছোট ছবিতে নয়।
সে অবস্থা পাল্টেছে। দুই মেরুর এক মেরু এখন বিলীন, এখন যুক্তরাষ্ট্রই একক মেরু। এখন সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের পক্ষে বিশাল জনমত সৃষ্টি হয়েছে; যাকে উপেক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের পক্ষেও সম্ভব নয়। তবে সোভিয়েত রাশিয়ার জায়গায় এখন রয়েছে আল-কায়েদা ও তালেবান। এখন ঠান্ডাযুদ্ধ রূপ নিয়েছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে; বা জর্জ বুশের ভাষায়, ওয়ার অন টেরর। এই যুদ্ধের সুযোগে আবার শরিক জোটানোর পুরোনো পথে কখনো কখনো হাঁটছে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য সারা মধ্যপ্রাচ্যে যখন ‘জেসমিন বিপ্লব’ ছড়িয়ে পড়ল, যুক্তরাষ্ট্র তার একনায়ক-মিত্রদের পিঠ থেকে সমর্থনের হাতটা সরিয়ে নিল না। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোর পরিবর্তে সমর্থন দিল সেনাবাহিনীকে—যে সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সিংহভাগ দায়ী। তা জেনেও এবং পরোক্ষে স্বীকার করে নিয়েও। তবে, এত কিছুর পরও মার্কিন প্রশাসন এখন গণতন্ত্রের কথাটা স্বীকার করে নিচ্ছে। ইরাকে মার্কিন অভিযানের মূল কারণ হিসেবে এর গণতন্ত্রায়ণের কথা বলেছে। গণতন্ত্রের তাহলে এতটা শক্তি!
আজকের লেখাটা বাংলাদেশকে নিয়ে; কিন্তু এই দীর্ঘ উপক্রমণিকাটি জরুরি লেখাটির মূল চিন্তার একটি পরিপ্রেক্ষিত তৈরির জন্য। এবং মূল চিন্তাটি হলো, আমাদের দেশের জন্য গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময় যুক্তরাষ্ট্র কোনো সহায়তা তো দেয়ইনি, বরং বিপক্ষেই দাঁড়িয়েছিল। কারণ ছিল ওই শীতল যুদ্ধ, দ্বি-মেরুভিত্তিক বিশ্বের দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতি। তার পরও, যখন দেশটি স্বাধীন হলো এবং একটি চমৎকার সংবিধান হাতে নিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার যাত্রা শুরু করল, যুক্তরাষ্ট্র সেখানেও বাগড়া লাগাল। ১৯৭৪-এ যে দুর্ভিক্ষ হয় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে, তার একটা কারণ নিহিত ছিল খাদ্য সাহায্য দিতে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা। বাংলাদেশ কিউবায় পাট বিক্রি করেছিল, যে কিউবা ছিল শীতল যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার শক্তিশালী মিত্র। এই দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রটি পাল্টে দিয়েছিল। এরই হাত ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অপসারণ এবং তাঁকে হত্যার একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ যে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তান যুগে পুনঃপ্রবেশ করল, তা তাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোনো মহিমা তো দিলই না, বরং দিল বানানা রিপাবলিকের এক নতুন গ্লানি। সেই গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে আমাদের অনেক দিন লেগেছিল, অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছিল।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা পুনরায় শুরু হলো ১৯৯০-এর সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সেই থেকে, মাঝে এক-এগারোর বিপর্যয়ের পরবর্তী দুই বছর বাদ দিলেও, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারই দেশ চালাচ্ছে। আমরা জানি এবং আমাদের মতো ক্লাস ফাইভের একজন শিক্ষার্থীও জানে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয় না। আমাদের দেশের গত কুড়ি বছরের নির্বাচিত সরকারগুলো এমনকি মধ্যমানের গণতান্ত্রিক সরকারও নয়: তার পরও আমাদের তাদের মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে হয় এ কারণে যে জনগণের রায় নিয়েই তারা ক্ষমতায় বসে। সরকারগুলো মুখে যত গণতন্ত্রের কথা বলে, কাজ করে তার উল্টো। ফলে এত দিনেও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সুশাসন দূর অস্ত, অর্থনীতির অগ্রগতি বা উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত বেশির ভাগ মানুষ। সরকারগুলোর (এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী দলের) কারণে ছাত্র ও যুবসমাজে সহিংসতা বেড়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে রণক্ষেত্রে; টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি, আধাসরকারি (এবং অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি) কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং দুর্নীতি হয়েছে সর্বগ্রাসী। তার পরও, মানুষ নিজের কথাগুলো বলতে পেরেছে, মিডিয়া নিজের জন্য একটা স্বাধীনতা তৈরি করে নিয়েছে, মেয়েদের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে, সামাজিক গতিশীলতা বেড়েছে, মানুষ ভোট দিয়ে সরকার বদল করেছে, এমনকি সরকারের সময় সরকারি দলের প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছে। আমাদের এই আধা পাকা, পোকায় খাওয়া গণতন্ত্রও আমাদের আত্মবিশ্বাসের একটা জায়গা করে দিয়েছে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের উন্নতির একটা সুন্দর ছবি সব সময় দেখেন, যা আমরা অনেকে দেখি না, অথবা দেখতে অপারগ এবং সে ছবির কেন্দ্রে আছে শিক্ষার বিস্তার, নারী কর্মক্ষেত্রের বিকাশ এবং নাগরিকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের উৎসার। অনেক ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় তিনি বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখেন। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে আমরা আরও যোগ করতে পারি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকা, যে আন্দোলনের সূচনা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন আমাদের প্রতিবাদী করেছে, মানবিক করেছে এবং সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যে একটা অভিন্ন আদান-প্রদানের জায়গা করে দিয়েছে। ধর্মের নামে পাকিস্তানে যা ঘটে, তা দেখে আমরা স্তম্ভিত হই, কিন্তু ভারতের মতো গণতন্ত্রেও যখন ধর্মীয় উগ্রবাদ জায়গা করে নেয়, নরেন্দ্র মোদি এবং বজরং দল বা হিন্দুত্ববাদের সমর্থন বাড়ে, তখন কি কম হতভম্ব হই? বাংলাদেশে গত কুড়ি বছরে গণতন্ত্রের যে মুড়ির টিন চলছে, তার নিয়ন্ত্রণ নিতে উগ্রবাদীরা যে সচেষ্ট, তার বহু প্রমাণ আমরা দেখেছি। কিন্তু সেটি হচ্ছে না ওই মুড়ির টিনের চরিত্র ও তার যাত্রীদের জন্যই। যখন যে চালক থাকেন, তাঁকে মেনে নিয়েই যাত্রীরা চলছেন। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় মুড়ির টিন চলছে কোনোমতে, মাঝেমধ্যেই গর্তগাতায় পড়ে এর কাহিল অবস্থা হয়, কিন্তু যাত্রীরা গন্তব্যের আশা ছাড়েন না। তাঁদের কেউ কেউ চালককে গালি দেন, চালক উত্তেজিত হন, কিন্তু তাঁর হাতটা স্টিয়ারিংয়েই থাকে। কেউ কেউ ‘মামা, ভালোই তো চালাইতেছেন’ বলে প্রশংসা করেন। চালকের মেয়াদ শেষে তাঁকে সরিয়ে অন্য চালক বেছে নেন যাত্রীরা, চালকের মুড়ির টিনটি চালিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও। এই যাত্রীরা গায়ের জোরে চালকের সিটে কাউকে বসতে দেবেন না—এটুকু প্রত্যয় আমাদের আছে। এবং প্রত্যয়টা যে খুব দুর্বল নয়, উগ্রবাদীদের ব্যাপক কোনো সাফল্যের অভাব, তাদের চোরাগোপ্তা নানা কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও—তার প্রমাণ। যদিও, উগ্রবাদ বিকশিত হয়েছে তিন-চার দশক ধরে, সেই মধ্য সত্তরের পর থেকে এবং এর পেছনে পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের আর্থিক ও নীতিগত সমর্থন ছিল (এখনো আছে)। তার পরও বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যায়নি।
২.
১৯ জানুয়ারি সেনাসদরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হলো, সেনাবাহিনীতে কর্মরত ‘কতিপয় ধর্মান্ধ কর্মকর্তা কর্তৃক অন্যান্যদের ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার একটি বিফল প্রয়াস চালানো হয়’, যা সেনাবাহিনী প্রতিহত করে। প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এই প্রয়াসে ১৪ থেকে ১৬ জনের মতো অবসরপ্রাপ্ত এবং সক্রিয় কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন এবং বিদেশেও এঁদের সহায়তাকারী রয়েছেন। এটি যে সরকার উৎখাতের একটি ষড়যন্ত্র ছিল, প্রেস ব্রিফিংয়ে তা-ও বলা হয়েছে, তবে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
ঘটনাটি উদ্বেগজনক যেহেতু সেনাবাহিনীর মতো সুশৃঙ্খল একটি সংগঠনের ভেতর যে উগ্রবাদী অনুপ্রবেশ ঘটেছে, এই বিফল প্রয়াসটি তাই আমাদের জানাচ্ছে। আবার একই সঙ্গে উগ্রবাদীদের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা আমাদের উদ্বেগ অনেকটাই নিরসন করে। তা ছাড়া পুরো বিষয়টা যেভাবে সেনাবাহিনী মোকাবিলা করেছে, তাতে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি। এই প্রথম কোনো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিং হলো, এতে স্বচ্ছতা ও দেশবাসীকে আস্থায় নেওয়ার বিষয়টাও গুরুত্ব পেল। গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে উগ্রবাদ গণতন্ত্রের একটি বিকল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে বা দাঁড়াতে পারে, সে সম্ভাবনাটা যে খুব উজ্জ্বল, তা আমাদের মনে হয় না। এ দেশের মানুষ যে গণতন্ত্রের পক্ষেই আছে, গণতন্ত্র থেকে মুখ ফেরায়নি—সরকারগুলোর অনেক ব্যর্থতার পরও আমাদের আশাবাদের জায়গাটা ওইখানেই। এক-এগারোর পর মনে হয়েছিল, গণতন্ত্র বোধ হয় এবার বিদায় নিল অথবা এটি ফিরে এলেও তা হবে প্রক্রিয়াজাত উচ্চফলনশীল জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফাইড) গণতন্ত্র। সেই লক্ষ্যে এক-এগারোর কুশীলবেরা কাজও শুরু করেছিলেন। তারা ‘মাইনাস-টু’ ও কিংস পার্টির মতো উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু মুড়ির টিনের যাত্রী বলে কথা—তারা এসি বাসে আরাম পাবে কেন? ফলে সদর্পে সেই মুড়ির টিনের গণতন্ত্রই ফিরে এল।
৩.
১৯ জানুয়ারি সেনাসদরের প্রেস ব্রিফিং যদি একটা সাবধানবাণী হয়, যার মর্মকথা, গণতন্ত্রের জন্য আমাদের জেগে থাকতে হবে তাহলে পাশাপাশি অন্যান্য সাবধানবাণীকেও আমাদের আমলে আনতে হবে। আমাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, শিক্ষাকে আরও সর্বজনীন করতে হবে, অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে, কর্মসংস্থান করতে হবে—অর্থাৎ কোনো ধরনের অগণতান্ত্রিক পটপরিবর্তনের জন্য যেন ক্ষেত্র প্রস্তুত না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এই সাবধানবাণী গণতন্ত্রের সব অংশীদারের জন্য। বিএনপি-জামায়াত জোট যে মাঝে মাঝেই সরকার পতনের ডাক দেয়, ‘ধাক্কা মেরে সরকারকে ফেলে দেয়ার’ হুমকি দেয় (যা আগে আওয়ামী লীগও তার বিরোধী-ভূমিকায় দিয়েছে) সেই চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকার পতনের যেসব গৃহীত পদ্ধতি সব গণতন্ত্রে স্বীকৃত সেগুলো হচ্ছে নির্বাচন, মধ্যবর্তী নির্বাচন অথবা সংসদে আস্থা ভোটে পরাজয়। এর বাইরে গণ-আন্দোলন ঘটিয়ে সহিংসতার মাধ্যমে সরকারের পতন কোনো বিবেচনাতেই গণতান্ত্রিক নয়। ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের এক সভায় খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘দেশ ও সমাজের পরিবেশ নির্বিঘ্ন, নিরাপদ, শান্তিময় ও স্থিতিশীল না হলে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব নয়।’ খুবই খাঁটি কথা। কিন্তু এখনই সরকার পতনের সহিংস আন্দোলন শুরু হলে এই পরিবেশ কেথায় নিয়ে দাঁড়াবে? এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারিয়ে (বিএনপি-জামায়াত) সরকারের পতনের জন্য যখন আন্দোলনের ডাক দেবে, তখনই বা পরিবেশের কী হবে?
বিএনপিকে বরং এখন সংসদে যেতে হবে, ধৈর্য ধরে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তার আগে একটা নির্বাচন কমিশন গঠন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য যথাসময়ে যখন দলটি আন্দোলন করবে, তখন অবশ্যই জনসমর্থন পাবে। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় মেয়র নির্বাচনে বিএনপি জিতেছে, অর্থাৎ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় দলটি এ দুটি শহরে জয়যুক্ত হয়েছে। মানুষ সবগুলো পৌরসভায় নির্বিঘ্নে এবং সুন্দরভাবে ভোট দিয়েছে, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এখন দলটির এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত অথবা বাতিল হয়ে যায়।
গণতন্ত্রের যে মুড়ির টিনটি চলছে, ঢিমেতালে হলেও, তাতে গতিসঞ্চারের জন্য যা যা করা দরকার, সরকার ও বিরোধী দলের তা-ই করা উচিত। এটি জনবান্ধব বাস, একে আরও উন্নত করা যায়। এর চালক দক্ষ হলে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে না। কিন্তু একে ছুড়ে ফেললে বিড়ম্বনা শুধু যাত্রীর হবে না, বিড়ম্বনা হবে বর্তমান ও সম্ভাব্য চালকেরও। কথাটি মনে রাখলে ভালো হয়।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.