আইভরি কোস্টে লাল-সবুজের পাশে-প্রশংসা পেশাদারির গল্প আতিথেয়তার by আনিসুল হক

বাঙালির আতিথেয়তার তারিফ কে না করবে? সঙ্গে প্রশংসা শোনা গেল বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর পেশাদারির। শোনালেন জনাব নেডালাম্ব নেগাকুয়ে। তাঁকে বলা হয় জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ উপদূত। ২৪ জানুয়ারি আমাদের সঙ্গে সেবরোকোর জাতিসংঘ দপ্তরে মোলাকাত করলেন তিনি।


প্রধান অপারেশন কর্তা মি. এসডি বালা বললেন, বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলকে সময় দিতে আপনাকে কি মধ্যাহ্নভোজ সংক্ষিপ্ত করে ছুটে আসতে হলো?
জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের এই প্রতিনিধি বললেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের জন্য মধ্যাহ্নভোজ বাদ দিতে হলেও তিনি খুশি মনেই দিতেন। কারণ বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সবচেয়ে বড় অংশগ্রহণকারী দেশ। তারা খুব ভালো করছে। আইভরি কোস্টে শান্তি প্রতিষ্ঠার পেছনে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক সমঝোতা কাজ করেছে, কিন্তু সেটা সম্ভব হতো না যদি না শান্তিরক্ষীরা সক্রিয় থাকত। বাংলাদেশের মিশনের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি অন্য একটা গল্প বলি। একবার আমি মন্ত্রীসমেত পশ্চিম অঞ্চল সফরে গেছি হেলিকপ্টারে। কিন্তু ফেরার সময় খারাপ আবহাওয়ার কারণে হেলিকপ্টার চলবে না। আমাদের রাতে ওখানে থাকতে হবে। কোথায় থাকব, কী খাব? বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে বলা হলো, আমাদের এখানে আসুন। এসে দেখুন আমরা কী করছি। আমি মন্ত্রীসমেত গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা স্থানীয় বিশিষ্টজনদের দাওয়াত করেছেন। আমরা সেখানেই খেলাম। কিন্তু তারও চেয়ে বড় কথা, শান্তিরক্ষার জন্য স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করাটা যে গুরুত্বপূর্ণ তা আরেকবার উপলব্ধি করলাম। আরেক দিনের কথা। তখন এই দেশে খুব যুদ্ধবিগ্রহ চলছে। আমার নিরাপত্তার স্বার্থে আমি এই অফিসেই পাঁচ-ছয় মাস ধরে দিনরাত থাকি। একদিন রাত ১০টার দিকে জাতিসংঘের একটা টহল দলের পেছনে পেছনে বিদ্রোহী অস্ত্রধারীরা চলে এল এই কার্যালয় পর্যন্ত। চৌকিতে প্রহরায় ছিল বাংলাদেশের সৈন্য দল। আক্রমণকারীরা গুলি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি সৈন্যদের অস্ত্র গর্জে উঠল। একজন আততায়ী মারা গেল। আরেকজন আহত। তখন পত্রপত্রিকায় খবর বেরোল, জাতিসংঘ বাহিনী বিনা উসকানিতে গুলি করেছে। আমি ওই সময় দপ্তরে ছিলাম। আমি জানি ঘটনা কী ঘটেছে। আমি বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাছে নানাভাবে ঋণী। কাজেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি দুপুরের খাবার বাদ দিতে রাজি আছি।
২৪ জানুয়ারি সকালে আবিদজানের জাতিসংঘ দপ্তরে বাংলাদেশের লে. ক. মাহবুব সরওয়ার আমাদের জানালেন আইভরি কোস্টে শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে।
২০০৫ সালে আইভরি কোস্টে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট লরেন্ট বাগবো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শক্তিশালী। আর তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আলাসানে ওয়াতারার ঘাঁটি দেশের উত্তরাঞ্চল। ওয়াতারার বাবা আইভরিয়ান নন, এই অজুহাতে তাঁকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুপযুক্ত ঘোষণাও করা হয়েছিল একবার। যুদ্ধ দেখা দিল এই দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে। উত্তরাঞ্চলে কর্তৃত্ব ওয়াতারার অনুগতদের। দক্ষিণাঞ্চলে বাগবোর সমর্থকদের আধিপত্য। নিয়মিত সৈন্যদের চেয়ে মিলিশিয়াদের অত্যাচারের মাত্রাটা বেশি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হলো এই দেশে। ২০১০ সালে নির্বাচন হলো। বিরোধী নেতা ওয়াতারা বিজয়ী হলেন। বাগবো সেই ফল মানতে নারাজ। জাতিসংঘ বাহিনী তাঁকে সেই ফল মানতে বাধ্য করেছে। আইভরিয়ান বাহিনী, ফরাসি সৈনিক দল আর জাতিসংঘ বাহিনী ২০১১ সালে আইনসভার নির্বাচনও সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছে। বাগবোকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ধরে আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে সমর্পণ করা হয়েছে বিচারের জন্য।
কিন্তু এখনো অনেক কাজ বাকি। বিদ্রোহীরা সবাই অস্ত্র সমর্পণ করেনি, সবাইকে সৈন্যদলে আত্মস্থ করা যায়নি। জঙ্গলে জঙ্গলে এখনো মিলিশিয়ারা রয়ে গেছে। সীমান্ত অরক্ষিত, অস্ত্র ও অস্ত্রধারীরা যাতায়াত করতে পারে সহজে। ১২ হাজার সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি জেল ভেঙে পালিয়ে গেছে। আর দোজো নামের একটা গোত্র শিকারের জন্য অনেক শক্তিশালী অস্ত্র সঙ্গে রাখে, যা অন্য উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা যায়।
যদিও দেশটা এখনো শান্ত। কিন্তু কখন কী ঘটবে কেউ বলতে পারে না।
এসব তথ্য আমরা জানলাম আইভরি কোস্টের জাতিসংঘ কার্যালয়ে বসে।
আরও দুটো পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা দেখি। লে. ক. আফজাল বলেন, জাতিসংঘ দপ্তরের নিরাপত্তায় বাংলাদেশের দলটি কী কী করছে তা নিয়ে। তাঁরা এ কাজে নানা ধরনের প্রশংসা পেয়েছেন, বিশেষ করে সেতু ভেঙে পানিতে পড়ে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার শিকার মানুষদের উদ্ধার করতে এগিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা, সেটা জাতিসংঘ আর সরকার দুই তরফেই প্রশংসিত হয়েছে। আর সিগন্যাল দলের পক্ষ থেকে মেজর মাশরেক জানালেন কীভাবে চমৎকার যোগাযোগ স্থাপন করেছেন তাঁরা, জাতিসংঘের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে, পার্শ্ববর্তী লাইবেরিয়ার সঙ্গে এবং প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের সঙ্গে।
শহরটা ঘুরে দেখতে বের হই। পথের দুধারে কলাগাছ, দেবদারু গাছ, আমগাছ—মনেই হয় না এটা বাংলাদেশ নয়। দোকানপাটে যাই, লেবানিজরা এখানে ভালো ব্যবসা করছে। ভারতীয়রাও ব্যবসা নিয়ে ছুটে এসেছে। এ দেশের পাট আসে ভারত থেকে। চীনা পণ্যে তো বাজার ভরাই। বাংলাদেশ কি এসব সুযোগ নিতে পারে না? এখানে যে বিস্তীর্ণ জমি পড়ে আছে, বাংলাদেশ থেকে এসে সেখানে কি কৃষিখামার করা যায় না?
এটা করতে হবে ব্যবসায়ীদের, উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। এখানে উপস্থিত শান্তিরক্ষী মিশনের কর্তারা, আমাদের দলের প্রতিনিধিরা আমরা ঘুরে ফিরে এসব কথা আলোচনা করি।

No comments

Powered by Blogger.